সরলা থাকরাল

সরলা থাকরাল

ভারতের প্রথম মহিলা বিমানচালক হিসেবে ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন সরলা থাকরাল (Sarala Thukral)। লাহোর ফ্লাইং ক্লাবের ছাত্রী হিসেবে মাত্র ২১ বছর বয়সে জিপসি মথ নামের একটি বিমান চালিয়ে প্রায় হাজার ঘন্টা উড়ানের রেকর্ড করেছিলেন তিনি। বিমানচালনার পাশাপাশি লাহোরের মেয়ো স্কুল অফ আর্টস থেকে চারুকলা এবং চিত্রশিল্পে দক্ষতা অর্জন করেন তিনি। পরবর্তীকালে একজন দক্ষ অলঙ্কার বিন্যাসকারক ও পোশাকসজ্জা বিশারদ হয়ে ওঠেন সরলা থাকরাল।

১৯১৪ সালের ৮ আগস্ট ব্রিটিশ শাসিত ভারতের দিল্লিতে সরলা থাকরালের জন্ম হয়। তাঁর প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু তথ্য জানা যায় না। ১৬ বছর বয়সে তাঁর বিবাহ হয় পি. ডি. শর্মার সঙ্গে। বিবাহের পর লাহোরে স্বামীগৃহে চলে আসেন সরলা। তাঁর স্বামীর পরিবারের সকলেই ছিলেন বিমানচালক। পি. ডি. শর্মা নিজেও একজন বিমানচালক ছিলেন এবং তিনিই ছিলেন ভারতের প্রথম এয়ারমেল বিমানচালক। সেই সুবাদে তিনিও তাঁর স্ত্রী সরলা থাকরালকে বিমানচালনা শেখার জন্য উৎসাহিত করতে থাকেন। কিন্তু তিনি নিজে এত ব্যস্ত থাকতেন যে নিজে থেকে সরলাকে শেখানোর মতো সময় তাঁর ছিল না। তাই সরলার শ্বশুরমশাই স্থানীয় লাহোর ফ্লাইং ক্লাবে তাঁকে ভর্তি করিয়ে দেন। ধীরে ধীরে একজন দক্ষ বিমানচালক হিসেবে গড়ে উঠতে থাকেন তিনি। ফ্লাইং ক্লাবে মাত্র আট ঘন্টা প্রশিক্ষণের পরেই তাঁকে সম্পূর্ণ একা বিমান চালাতে বলেন প্রশিক্ষক। শাড়ি পরে একটি জিপসি মথ বিমানের ককপিটে উঠে বসেন সরলা থাকরাল। ধীরে ধীরে একা একাই বিমান চালাতে শুরু করেন তিনি এবং উড়ানের শেষে সফলভাবে মাটিতে নেমে আসেন। প্রথম উড়ানেই সফল হয়ে আত্মবিশ্বাস কয়েকগুণ বেড়ে যায় তাঁর। কিন্তু তখনও লাইসেন্স পাননি তিনি। অনেক প্রশিক্ষণ ও পরীক্ষা দেওয়ার পরে ‘এ’ বিভাগের লাইসেন্স অর্জন করতে সক্ষম হন সরলা থাকরাল। তার আগে ঐ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রেই হাজার ঘন্টা উড়ানের রেকর্ড করেন সরলা। অভাবিতভাবে মাত্র ২১ বছর বয়সে ভারতের প্রথম মহিলা হিসেবে একটি জিপসি মথ বিমান চালনা এবং হাজার ঘন্টা আকাশে উড়ানের কৃতিত্ব অর্জন করেন তিনি। সেকালের ভারতে ‘আর্য সমাজ’ গোষ্ঠীর দর্শন দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন তিনি যার ফলে আধ্যাত্ম চিন্তায় বৈদিক ধারণার দ্বারা আকৃষ্ট হন তিনি। আর্য সমাজের সদস্যা হিসেবে দ্বিতীয়বার বিবাহ করতে দ্বিধা করেননি তিনি। ১৯৪৮ সালে আর. পি. থাকরালের সঙ্গে বিবাহ করেন সরলা থাকরাল।

দুর্ভাগ্যবশত ১৯৩৯ সালে একটি বিমান দুর্ঘটনায় সরলা থাকরালের স্বামী পি. ডি. শর্মার মৃত্যু হয়। কিন্তু সরলা এতে থেমে যাননি। তিনি যোধপুরে চলে আসেন বাণিজ্যিক বিমান চালনার লাইসেন্স পাওয়ার জন্য এবং নিজের প্রশিক্ষণ চালিয়ে যান। তাঁর স্বপ্ন ছিল বিমান চালনাকেই পেশা হিসেবে গড়ে তোলা। কিন্তু সেই সময়েই শুরু হয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যার ফলে সমস্ত উড়ান বাতিল করা হয়, বিমান প্রশিক্ষণও স্থগিত হয়ে যায়। ফলে বাধ্য হয়ে লাহোরে ফিরে আসতে হয় সরলাকে। ফিরে এসে লাহোরের মেয়ো স্কুল অফ আর্টে ভর্তি হন তিনি চিত্রকলা ও চারুকলায় প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য। সেখান থেকে বাংলার চিত্রকলার ধারায় শিক্ষিত হয়ে চারুকলার বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। তারপর নিজের উদ্যোগে অলঙ্কার ও গহনার সজ্জা-বিন্যাস (Jewellery Design) এবং পোশাক পরিকল্পনার (Costume Design) ব্যবসা চালু করেন সরলা থাকরাল। ভারতীয় মহিলাদের কাছে সেই সময় এটি খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং ক্রমেই শাড়ি বিন্যাসের কাজকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন সরলা। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সরলা লাহোরেই ছিলেন যা রাজনৈতিকভাবে তখন পাকিস্তানের অধীনে চলে গিয়েছিল। হিন্দু হওয়ার কারণে লাহোরে তাঁর নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন সরলার পরিবারের লোকেরা এবং দ্রুত লাহোর ছেড়ে তাঁর কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে ভারতে ফিরে আসতে বলেন তারা। ফলে শীঘ্রই কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে দিল্লিগামী ট্রেনে করে জন্মভিটেয় ফিরে আসেন সরলা।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

দিল্লিতে এসে নতুন করে পুঁজি বিনিয়োগ করে ব্যবসা শুরু করেন তিনি। বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের মতো মানুষও তাঁর এই কাজকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করেন এবং সরলা থাকরালের বিন্যাস-সজ্জার কাজকে প্রশংসা করেন। সরলার বিন্যাস করা শাড়ি শুধুমাত্র সেকালের মান্য-গণ্য ব্যক্তিরাই পড়তেন তা নয়, বরং ১৫ বছর ধরে তাঁর বিন্যাস করা শাড়ি ‘কটেজ এম্পোরিয়াম’ সংস্থায় সরবরাহ করা হয়ে আসছিল। কিছুদিন পরে সরলা ব্লক প্রিন্টিং শুরু করেন এবং ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার পোশাক তৈরির কাজেও খুশি মনে যোগ দেন তিনি। বেদের বিভিন্ন শ্লোক শাড়িতে লিখে তা বন্ধুদের উপহার দিতে পছন্দ করতেন সরলা। ৯০ বছর বয়সে পৌঁছেও তাঁর শক্তি বা দক্ষতা একটুও কমেনি। নিজের যাবতীয় কাজ তিনি সেই বয়সেও নিজেই করেন এবং তাঁর কাছে এইসব কাজের মধ্যে দিয়ে ব্যস্ত থাকলে একাকিত্ব কখনো গ্রাস করতে পারবে না তাঁকে। একাধারে ব্যবসায়ী, বিমানচালিকা, চিত্রশিল্পী এবং পোশাক-গহনা বিন্যাসকারক হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন সরলা থাকরাল। তাঁর জীবনের অন্যতম আদর্শ হল আনন্দে থাকা, কোনো কিছুর মূল্যেই আনন্দকে হারানো যাবে না। আমাদের সবসময় প্রকৃতি ও সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত আমাদের সকলকে একটি সুন্দর জীবন উপহার দেওয়ার জন্য। জীবনের সমস্ত দুঃখকে আনন্দ দিয়ে ভাসিয়ে দেওয়াই লক্ষ্য হওয়া উচিত।

তাঁর স্মৃতিতে ২০২১ সালের ৮ আগস্ট জন্ম শতবর্ষ হিসেবে গুগল ডুড্ল‌ থাকরালকে সম্মান জানিয়ে একটি ডুড্ল‌ প্রকাশ করেছে।

২০০৮ সালের ১৫ মার্চ ৯৪ বছর বয়সে সরলা থাকরালের মৃত্যু হয়।  

আপনার মতামত জানান