সোফিয়া লোরেন

সোফিয়া লোরেন

সোফিয়া লোরেন (Sophia Loren) স্বর্ণযুগের হলিউড ছবির এক অসামান্য সুন্দরী ইতালীয় অভিনেত্রী। আমেরিকান ফিল্ম ইন্সটিটিউটের প্রতিবেদনে তাঁকেই একবিংশ শতাব্দীর ধ্রুপদি হলিউড ছবির সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে স্বীকৃতি জানায়। মাত্র ষোলো বছর বয়সে চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন সোফিয়া লোরেন আর অভিনেত্রী হিসেবে ভিক্টোরিও ডি সিকা পরিচালিত ‘টু ওমেন’ ছবিতে কাজের সুবাদে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে অ্যাকাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। ইয়েস্টারডে, টুডে অ্যাণ্ড টুমরো (১৯৬৩), ম্যারেজ ইটালিয়ান (১৯৬৪), সানফ্লাওয়ার (১৯৭০), এ স্পেশাল ডে (১৯৭৭) ইত্যাদি ছবিতে অনবদ্য অভিনয়ের জন্য মোট সাতবার ডেভিড-ডি-ডোনাটেল্লো পুরস্কার পান সোফিয়া লোরেন। এছাড়া ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসব এবং কান চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। ১৯৯১ সালে অ্যাকাডেমি সম্মাননা পুরস্কারে ভূষিত হন সোফিয়া লোরেন।

১৯৩৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর রোমের ইতালিতে সোফিয়া লোরেনের জন্ম হয়। তাঁর আসল নাম সোফিয়া ভিলেইনি সিসোলোন। তাঁর বাবা রিকার্দো সিসোলোন নিজেকে একজন কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ার বলে পরিচয় দিলেও দিনের বেশিরভাগ সময় তরুণী অভিনেত্রীদের সঙ্গে প্রেমের সুযোগ খুঁজতে অযথা বহিরঙ্গবিলাসে মত্ত থাকতেন। সেই তরুণী অভিনেত্রীদের মধ্যেই একজন ছিলেন তাঁর মা রোমিল্ডা ভিলেইনি। বিখ্যাত অভিনেত্রী গ্রেটা গার্বোর সঙ্গে চেহারার মিল থাকায় তাঁকে একবার গ্রেটার দ্বৈত চরিত্রের অভিনয়ের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছিল, কিন্তু যেতে চাননি রোমিল্ডা। তাঁর মা লোরেনের জন্মের পর তাঁকে নিয়ে চলে আসেন ইতালির নেপল্‌সের তীরে পোজোউলি শহরে যেখানে রোমিল্ডারও জন্ম হয়েছিল। রিকার্দো সিসোলোন আর রোমিল্ডার আরেকটি সন্তান হলেও তাঁরা কখনোই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হননি। দাদু-দিদার বাড়িতে প্রচণ্ড দারিদ্র্যের মধ্যে কেটেছে সোফিয়া লোরেনের বাল্যকাল, এমনকি একটি ঘরে আটজনের সঙ্গে তাঁকে থাকতে হয়েছে সেই সময়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে পোজোউলি শহর বিপন্ন হয়ে পড়ে। দূর্ভিক্ষ গ্রাস করে সমগ্র ইতালিকে। এমনও দিন গেছে যে রোমিল্ডা গাড়ির রেডিয়েটর থেকে জল নিয়ে তাঁর সন্তানদের মুখে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছেন। চোদ্দো বছর বয়সে সোফিয়া লোরেন একটি বিউটি কম্পিটিশনে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। সেসময় লোরেনের দিদা বাড়িতেই একটি পাব খোলেন যেখানে তাঁর মা রোমিল্ডা পিয়ানো বাজাতেন আর লোরেন খাবার ও পানীয় পরিবেশন কিংবা টেবিল পরিস্কারের কাজ করতেন। সেইসঙ্গে বিভিন্ন বিউটি কম্পিটিশনে অংশ নেওয়া শুরু করেন লোরেন এবং অচিরেই মিস ইটালিয়া-র সম্মান অর্জন করেন। ১৯৫০ সালে ১৫ বছর বয়সে লোরেন এবং তাঁর মা রোমের উদ্দেশে রওনা দেন অভিনয় করে জীবন চালানোর জন্য। ১৯৫১ সালে প্রথমবারের জন্য অতিরিক্ত হিসেবে অভিনয় করেন সোফিয়া লোরেন কুয়ো ভেডিস নামের একটি ছবিতে যার পরিচালক ছিলেন মার্ভিন লেরয়। এছাড়াও সে সময় লোরেন বহু ইতালীয় কমিক-পত্রিকার মডেল হিসেবে কাজ করতেন। ছবিতে যোগ দিয়ে সোফিয়া লোজারে হিসেবেই নিজেকে পরিচিতি দেন সোফিয়া লোরেন।

চলচ্চিত্রে অভিনয়ই ক্রমশ তাঁর কর্মজীবনের অঙ্গ হয়ে ওঠে। ১৯৫২ সালে ‘লা ফেভারিতা’ ছবিতে আবারো একটি অতিরিক্ত চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পান সোফিয়া। কিন্তু এর পরের বছর তাঁর জীবনের অন্যতম স্মরণীয় দিন এসে যায়। ১৯৫৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘আইডা’ ছবিতে প্রথম মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেন সোফিয়া লোজারে ওরফে সোফিয়া লোরেন। বলা ভালো এই ছবি থেকেই তিনি সোফিয়া লোরেন হিসেবে পরিচিত হন। তারপরে ‘অ্যানাটমি অফ লাভ’ ছবিতে মার্সেলো ম্যাস্ত্রনির সঙ্গে অভিনয় করেন লোরেন। এরপর ১৯৫৪ সালে বিখ্যাত ইতালীয় চলচ্চিত্র ‘গোল্ড অফ নেপল্‌স’-এ তাঁর অভিনয় খুব দ্রুত তাঁকে উদীয়মান অভিনেত্রী হিসেবে বিশ্বের দরবারে পরিচিতি এনে দেয়। ১৯৫৭ সালে লোরেন প্রথম হলিউডের ‘দ্য প্রাইড অ্যাণ্ড দ্য প্যাশন’ ছবিতে অভিনয় করেন যেখানে তাঁর সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন বিখ্যাত সব অভিনেতৃবর্গ ক্যারি গ্র্যান্ট, ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা প্রমুখ। এই সময়েই ক্যারি গ্রান্ট এবং অন্য আরেক প্রযোজক কার্ল পন্টি উভয়েই প্রেম নিবেদন করেন সোফিয়াকে। কিন্তু উভয়ের মধ্যে কার্ল পন্টিকেই নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেন সোফিয়া লোরেন। সংবাদমাধ্যমগুলি ঠাট্টা করতে থাকে এই মর্মে যে সোফিয়া যাঁকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বাছলেন তিনি বয়সে যেমন তাঁর থেকে দ্বিগুন বয়সী, তেমনি উচ্চতায় অর্ধেক। ১৯৫৭ সালে উভয়ের বিবাহ হয়। কিন্তু কার্ল পন্টির প্রথম বিবাহের কিছু আইনি জটিলতার কারণে সমগ্র ইতালিতে সরকারিভাবে কার্ল পন্টি ও সোফিয়া লোরেনের বিবাহ স্বীকৃতি পায়নি। ২০০৭ সালে কার্ল পন্টির মৃত্যু পর্যন্ত সোফিয়া লোরেন তাঁর সঙ্গেই ছিলেন, উভয়ের এমন অটুট দাম্পত্য সেকালের ফিল্ম-ইণ্ডাস্ট্রিতে একটি বিরল সাফল্যের মতো। ১৯৬০ সালে ভিক্টোরিও ডি সিকা পরিচালিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত ‘টু ওমেন’ ছবিতে অভিনয় করেন আর সেটাই ইতালীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে মাইলফলকে পরিণত হয়। যুদ্ধে বিধ্বস্ত রোমে নিজের কন্যাকে রক্ষা করতে তৎপর এক মায়ের চরিত্রে তাঁর এই অভিনয় অনেকটাই যেন তাঁর নিজের জীবনের সঙ্গে মিলে যায়, লোরেন নিজেও সে কথা স্বীকার করেছেন। এই ছবিতে অভিনয় করে আন্তর্জাতিক স্তরে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন সোফিয়া লোরেন এবং ১৯৬১ সালে শ্রেষ্ঠ মুখ্য অভিনেত্রী হিসেবে অ্যাকাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। অ-ইংরেজি ছবিতে এই পুরস্কার প্রাপ্তির শিরোপা একজন অভিনেত্রী হিসেবে তিনিই প্রথম অর্জন করেছিলেন। ‘টু ওমেন’ ছবিটি অস্কার পুরস্কার পায় সে বছর। ‘সোফিয়া লোরেন : ইন দ্য ক্যামেরা আই’ বইতে স্যাম শ জানাচ্ছেন যে ভিক্টোরিও ডি সিকার কাছ থেকেই অভিনয়শিক্ষা পেয়েছিলেন লোরেন। ভিক্টোরিও ডি সিকার পরিচালনায় আরেকটি ছবি ‘টুউ ব্যাড সি ইজ ব্যাড’-এ ম্যাস্ত্রনির সঙ্গে দ্বিতীয়বার অভিনয় করেন সোফিয়া লোরেন। ১৯৬০-এর দশকে একাধারে আমেরিকান, ইতালীয়, ফরাসি বহু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি। ‘ডিজায়ার আণ্ডার দ্য এলম্‌স’ ছবিতে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে ১৯৫৮ সালে হলিউডে পা রাখেন তিনি। এই ছবির পাশাপাশি অন্য আরো কিছু ছবিতে পিটার স্টেলারের সঙ্গে অভিনয় করার অভিজ্ঞতা রয়েছে লোরেনের ঝুলিতে। ১৯৬৩তে ‘ইয়েস্টারডে, টুডে অ্যাণ্ড টুমরো’ ছবিটি শ্রেষ্ঠ বিদেশি ছবি হিসেবে অস্কার পায় যেখানে সোফিয়া লোরেনের অভিনয় মনে রাখার মতো। ১৯৬৪ সালে ‘ম্যারেজ, ইটালিয়ান স্টাইল’ ছবিতে অভিনয় করেন তিনি যা দ্বিতীয়বার অস্কারের জন্য মনোনীত হয় এবং সোফিয়া লোরেন শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে অস্কারে ভূষিত হন। ঐ বছরই ‘দ্য ফল অফ দ্য রোমান এম্পায়ার’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য প্রথম দশ লক্ষ ডলার পারিশ্রমিক পান লোরেন। এই সময়পর্বের মধ্যে তাঁর অভিনীত শ্রেষ্ঠ ছবিগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – ১৯৬১তে স্যামুয়েল ব্রনস্টনের ‘এল সিড’ এবং তারপরে দশকের শেষ দিকে ১৯৬৭ সালে মার্লন ব্র্যাণ্ডোর সঙ্গে ‘এ কাউন্টিস ফ্রম হংকং’ ছবিতে অভিনয় করেন লোরেন। ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৭ সালের মধ্যে লোরেন ‘বিশ্বের চলচ্চিত্রের প্রিয় অভিনেত্রী’ হিসেবে চারটি গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৭০-এর দশকে তাঁর অভিনীত অন্যতম সেরা চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে ‘দ্য ভয়েজ’ (১৯৭৪), ‘ব্রিফ এনকাউন্টার’ (১৯৭৪), ‘দ্য কাসাণ্ড্রা ক্রসিং’ এবং ‘এ স্পেশাল ডে’ (১৯৭৭) অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

তাঁর লেখা বেশ কিছু বই বিশ্বজুড়ে বহুল চর্চিত হয়। ‘সোফিয়া লোরেন্স রেসিপিস অ্যাণ্ড মেমোরিস’ (১৯৮৮), ‘ওমেন অ্যাণ্ড বিউটি’ (১৯৮৪), ‘ইন দ্য কিচেন উইথ লাভ’ (১৯৭২) এবং ‘ইয়েস্টারডে, টুডে অ্যাণ্ড টুমরো : মাই লাইফ’ (২০১৫) ইত্যাদি বইগুলি খুবই জনপ্রিয়।

সমগ্র অভিনয় জীবনে অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন সোফিয়া লোরেন। শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে সিলভার রিবন অ্যাওয়ার্ড পান তিনি মোট ছয় বার। এছাড়া গ্র্যামি পুরস্কার, সিজার অ্যাওয়ার্ড, হলিউড ওয়াক অফ ফেম, ভেনিস চলচ্চিত্রে ‘অনারারি গোল্ডেন লায়ন অ্যাওয়ার্ড’ এবং মহিলা হিসেবে চলচ্চিত্রজগতে অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবদানের জন্য তিনি ‘অ্যালায়েন্স অফ ওমেন ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাওয়ার্ড’-এ ভূষিত হন। ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসব এবং কান চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। ২০২০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দ্য লাইফ’ ছবিতে গণহত্যায় অক্ষত এক মায়ের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ২০২১ সালে সোফিয়া লোরেন এএআরপি শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী এবং এডব্লিউএফজে গ্র্যাণ্ড ডেম পুরস্কার অর্জন করেন।

বর্তমানে সুইজারল্যাণ্ডের জেনেভার বাসিন্দা সোফিয়া লোরেন বার্ধক্যের উপান্তে এসে উপনীত হয়েছেন এবং স্মৃতিভারাতুর দিন কাটাচ্ছেন।

আপনার মতামত জানান