স্বামী প্রণবানন্দ

স্বামী প্রণবানন্দ

স্বামী প্রণবানন্দ (Swami Pranavananda) তথা স্বামী প্রণবানন্দজী মহারাজ একজন হিন্দু সন্ন্যাসী এবং মহাপুরুষ যিনি ভারত সেবাশ্রম সংঘের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিখ্যাত।

১৮৯৬ সালে ২৯ জানুয়ারি বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার বাজিতপুর গ্রামে প্রণবানন্দের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম বিষ্ণুচরণ ভূঁইয়া এবং তাঁর মায়ের নাম সারদা দেবী। তাঁর মা বাবা দুজনেই খুব শিব ভক্ত ছিলেন। প্রণবানন্দের বাবা তাঁর জন্মের সময় নাম রাখেন জয়নাথ। শৈশবে অনেকে তাঁর ডাকনাম ছিল বিনোদ।

প্রণবানন্দ ছোট থেকেই পরোপকারী ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে আধ্যাত্মিক ভাবধারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রায়শই তাঁকে ধ্যান করতে দেখা যেত এই সময়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ধ্যান করার প্রতি তাঁর ঝোঁক বাড়তে থাকে। এর ফলে তাঁর পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটতে থাকে। তিনি শুধু ভাত এবং আলু সেদ্ধ খেতেন এবং দিনে মাত্র এক ঘণ্টা ঘুমাতেন। সেই সময় তাঁকে শ্মশানে শ্মশানে ঘুরে সাধনা করতে দেখা যেত। এরপর ১৯১৩ সালে তিনি বাবা গম্ভীরানাথজীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৯১৬ সালে মাত্র কুড়ি বছর বয়সে তিনি সিদ্ধি লাভ করেন। সাধারণ মানুষের কাছে প্রণবানন্দ সিদ্ধ পুরুষ হিসেবে গণ্য হতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে তাঁর শিষ্যের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তিনি সবাইকে তাঁর শিষ্য করে নিতেন। জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ নির্বিশেষে তিনি সকলকে শিষ্য করে নিতেন।

১৯১৪ সালে  স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার দায়ে প্রণবানন্দকে কারাবন্দি করা হয়। কিন্তু ব্রিটিশ পুলিশ স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে তাঁর যোগাযোগ প্রমাণ করতে না পারায় পরে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। প্রণবানন্দ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্নেহ করতেন এবং সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁদের সাহস যোগাতেন। এর পাশাপাশি তিনি রাতের অন্ধকারে তাঁদের খাদ্য সরবরাহ করতেন এবং আশ্রয়ও দিতেন। পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্য অনেক বিপ্লবী তাঁর কাছে আশ্রয় নিতেন। ১৯২১ সালে পূর্ববঙ্গের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়লে  আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় সেই সব মানুষদের সাহায্য করবার জন্য প্রচুর পরিমাণে অর্থ সংগ্রহ করেন। কিন্তু সেইসব মানুষদের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার জন্য লোকবলের সমস্যা দেখা দিলে তিনি সেই সংগৃহীত অর্থ প্রণবানন্দের হাতে তুলে দেন এবং তাঁকে যুব সমাজকে সংগঠিত করে দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষদের সাহায্য করতে বলেন। বিশিষ্টজনদের অনুরোধে প্রণবানন্দ মাদারীপুর সেবাশ্রম স্থাপন করেন। এর পরে তিনি খুলনা, নওগাঁ, আশাশুনি ও অন্যান্য জায়গায় আরো কয়েকটি আশ্রম তৈরি করেন।

১৯২৪ সালের জানুয়ারি মাসে প্রয়াগে হওয়া অর্ধ কুম্ভমেলায় তিনি স্বামী গোবিন্দনন্দজী গিরি মহারাজের কাছ থেকে সম্পূর্ণ সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। সেই সময় তাঁর নাম বিনোদ থেকে প্রণবানন্দ রাখা হয়। সেই বছরেই ফেব্রুয়ারি মাসে মাঘী পূর্ণিমার দিন সাতজন শিষ্যকে তিনি সন্ন্যাস মন্ত্রে দীক্ষিত করেন। তাঁর সমগ্র জীবনে তিনি প্রায় ৮৩ জন যুবককে সন্ন্যাস ধর্মে দীক্ষিত করেন। 

প্রণবানন্দ গ্রামের উন্নয়নের হস্তশিল্প উন্নয়ন এবং গ্রামের ঘরে ঘরে ঢেঁকির ব্যবস্থা করা সহ বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বিভিন্ন উপজাতির পিছিয়ে পড়া মানুষদের কর্মসংস্থানের জন্য তিনি সব সময় চেষ্টা করতেন যাতে তারা স্বনির্ভর হতে পারে।

প্রণবানন্দ ছোট থেকে বাংলার পিছিয়ে পড়া গরীব এবং অশিক্ষিত মানুষদের দুর্দশা দেখেছেন। তিনি এও দেখেছেন যে কোন ব্যক্তি বা সংস্থা, এমনকি ব্রিটিশ সরকারও সেই সব মানুষদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসত না। বন্যা, খরা কিংবা মহামারীর সময় সেই সব মানুষেরা অকাতরে মারা যেত। শিক্ষিত এবং ধনী ব্যক্তিরা সেইসব পিছিয়ে পড়া মানুষদের এড়িয়ে চলত। তারা সব সময় উঁচু জাত এবং বিদেশি শাসকের দ্বারা শোষিত হত। তাই তিনি মানুষের সেবা করার জন্য ১৯১৭ সালে একটি সংস্থা তৈরি করেন। যা পরে ১৯২৩ সালে ভারত সেবাশ্রম সংঘ নামে পরিচিত হয়। ১৯২২ সালে কলকাতার বাগবাজারে একটি ঘর ভাড়া করে তিনি ভারত সেবাশ্রম সংঘের প্রথম কার্যালয় তৈরি করেন। পরে সেই কার্যালয়টি শোভাবাজার স্ট্রিটে একটি ভাড়া নেওয়া কোঠা ঘরে স্থানান্তরিত করা হয়। এই সংস্থাটির মূল কাজ হল বাংলার বিভিন্ন গরিব মানুষদের সাহায্য করা, শিশুদের শিক্ষা প্রদান করা এবং মানুষের অসুখ বিসুখে তাদের সেবা করা।

বঙ্গভঙ্গ পরবর্তী সময়ে মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি হলে প্রণবানন্দ সাম্যের বাণী প্রচার করেন। তিনি বাঙালি হিন্দুদের এক জোট করার পরিকল্পনা করেন এবং গ্রামে গ্রামে সামাজিক মিলন ক্ষেত্র তৈরি করতে উদ্যত হন। ইট কাঠ পাথরের তৈরি মন্দির নয় তিনি টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে দেওয়া বাঙালি হিন্দু সমাজকে একত্র করে মহা হিন্দু মন্দির তৈরি করতে চেয়েছিলে। তাঁর মতে সেই মন্দির হবে হিন্দুদের সামাজিক মিলনক্ষেত্র।
শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বাংলার হিন্দু মহাসভা কে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন এবং তিনি স্বামী প্রণবানন্দের সমর্থন লাভ করেন। স্বামী প্রণবানন্দ  ভারত সেবাশ্রম সংঘ এবং হিন্দু মহাসভাকে একে অপরের পরিপূরক করে তুলতে চেয়েছিলেন। তিনি হিন্দু মহাসভার জনভিত্তিক প্রসারে সচেষ্ট হন। মাঝে মাঝেই তিনি হিন্দু মহাসভার অন্যতম সদস্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, মন্মথনাথ মুখোপাধ্যায় এবং এন সি চ্যাটার্জির সাথে হিন্দুদের উন্নতির ব্যাপারে আলোচনা করতেন।

প্রণবানন্দ জীবনের শেষ কিছু বছর  হিন্দুদের পুনঃসংগঠিত করতে অতিবাহিত করেন। হিন্দু সমাজের জাগরণ ঘটানোর জন্য তিনি বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে বেড়াতেন। সেখানে বহু মানুষদের নিয়ে তিনি সভা করতেন। জীবনের শেষ শিবরাত্রির দিন তিনি একটি মহাসভায় নিজের গলার মালা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের গলায় পরিয়ে দিয়ে তাঁকে তাঁর উত্তরসূরি  ঘোষণা করেন। স্বামী প্রণবানন্দের ১৯৪১ সালে ৮ ফেব্রুয়ারি ৪৫ বছর বয়সে কলকাতায় মৃত্যু হয়।

প্রণবানন্দ প্রতিষ্ঠিত ভারত সেবাশ্রম সংঘ এখনো মানুষের সেবা করে চলেছে। দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানো থেকে শুরু করে বন্যার ত্রাণ, চিকিৎসা ব্যবস্থা, শিক্ষা প্রদান, বস্ত্র বিনিময় এবং আরো নানান কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ভারত সেবাশ্রম মানুষের সেবা করে থাকে। ভারত সেবাশ্রমের শাখা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে যেমন বাংলাদেশ, নেপাল, আমেরিকা, কানাডা, ইংল্যান্ড, নিউ গিনি ইত্যাদি জায়গায়। প্রণবানন্দের ১২৫ তম জন্মদিন উপলক্ষে সম্প্রতি ভারত সেবাশ্রম সংঘ এবং ভারত সরকার যুগ্মভাবে ১০০, ৫০ এবং ১০ টাকার তিনটি বিশেষ স্মারক মুদ্রা প্রকাশিত করেছে।

4 comments

আপনার মতামত জানান