সুনীতা উইলিয়ামস

সুনীতা উইলিয়ামস

সুনীতা লিন উইলিয়ামস (Sunita Lyn Williams) একজন সুবিখ্যাত ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান মহাকাশচারীএবং নৌ-আধিকারিক (Navy Officer) যিনি বিশ্বের প্রথম মহিলা মহাকাশচারী হিসেবে সর্বাধিক সময় (১৯৪ দিন) মহাকাশে অবস্থান করবার রেকর্ড করেছেন।  নাসার (NASA) বিভিন্ন  মহাকাশ অভিযানের সঙ্গে যুক্ত থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন তিনি।

সুনীতা উইলিয়ামসের জন্ম হয় ১৯৬৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বরে আমেরিকার ওহিও রাজ্যের ইউক্লিড শহরে। তাঁর বাবা দীপক পান্ড্যা ছিলেন একজন স্নায়ুতন্ত্রবিদ এবং মা উরশুলিন বনি(জলোকর) পান্ড্যা ছিলেন স্লোভেনীয় বংশোদ্ভূত। তিন সন্তানের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন সুনীতা। দাদা জে থমাস তাঁর থেকে চার বছরের বড়ো এবং দিদি দিনা আন্নাদ্জ তিন বছরের বড়ো। সুনীতার পিতৃপরিবার গুজরাটের ঝুলাসানে অবস্থিত। সুনীতা উইলিয়ামস পরবর্তীকালে মাইকেল. জে. উইলিয়ামসকে বিবাহ করেন। প্রথমে পেশাজীবনে তাঁরা দুজনেই হেলিকপ্টার-চালক ছিলেন। দৌড়, সাঁতার, বাইকিং, বো-হান্টিং ইত্যাদি খেলা সুনীতার অবসর বিনোদনের সঙ্গী।

১৯৮৩ সালে ম্যাসাচ্যুসেটসের নীডহ্যামে অবস্থিত নীডহ্যাম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন সুনীতা। তারপর ১৯৮৭ সালে পদার্থবিদ্যায় স্নাতক হন মেরিল্যান্ডে অবস্থিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌ আকাদেমি থেকে। পরবর্তীকালে ১৯৯৫ সালে তিনি ফ্লোরিডা ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজমেন্টে মাস্টার ডিগ্রি লাভ করেন ।

নৌ-আকাদেমি থেকে উত্তীর্ণ হয়ে সুনীতা ১৯৮৭ সালের মে মাসে মার্কিন নৌবাহিনীতে নিযুক্ত হন। তারপর ‘ন্যাভাল কোস্টাল সিস্টেম কম্যান্ডে’ ছয়মাসের অস্থায়ী নিয়োগের পর তাঁকে বেসিক ডাইভিং অফিসার হিসেবে মনোনীত করা হয়। এরপর তিনি ‘ন্যাভাল এয়ার ট্রেনিং কম্যান্ডের কাছে রিপোর্ট করেন এবং ১৯৮৯ সালের জুলাই মাসে তাঁকে একজন নৌ-বিমানচালক হিসেবে মনোনীত করা হয়। তখনই তিনি যুদ্ধবিমান চালনার প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। ‘অপারেশন ডেসার্ট শিল্ড’ (Operation Desert Shield) এবং ‘অপারেশন প্রোভাইড কমফোর্ট’-এ(Operation Provide Comfort) সুনীতা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৯২ সালে ‘হারিকেন আন্ড্রু’ (Hurricane Andrew)  নামক বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ফ্লোরিডা, মিয়ামি প্রভৃতি স্থানে সংঘটিত ত্রাণ অভিযানেও সুনীতা সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। ১৯৯৩ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি ‘আমেরিকার ন্যাভাল টেস্ট পাইলট বিদ্যালয়ে’ প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করেন এবং সেই বছর ডিসেম্বরে স্নাতক হন। ১৯৯৫ সালে এই বিদ্যালয়ের রোটারি উইং বিভাগের নির্দেশক এবং বিদ্যালয়ের নিরাপত্তা অফিসার হয়েছিলেন সুনীতা । সেখানে ‘ইউএইচ-৬০’ ( UH-60), ‘ওএইচ-৬’ (OH-6) এবং ‘ওএইচ-৫৮’ (OH-58) নামের হেলিকপ্টার উড়িয়েছিলেন তিনি। তিনি ‘ইউএসএস সাইপান’ (USS Saipan) নামক মার্কিন নৌসেনা জাহাজের বিমান পরিচালকের(Air Crafts Handler) এবং সহকারী এয়ার বসের(Assistant Air Boss) দায়িত্বেও নিযুক্ত ছিলেন। প্রায় ৩০ রকমের আলাদা আলাদা বিমানে কমপক্ষে ৩০০০ ঘন্টা বিমান ওড়ানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে সুনীতার।

১৯৯৮ সালের জুন মাসে সুনীতা মার্কিন মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্র নাসা কর্তৃক নির্বাচিত হন এবং অগাস্ট মাসে ‘জনসন মহাকাশ কেন্দ্রে’ (Johnson Space Centre) প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। তাঁর এই প্রশিক্ষণের অন্তর্ভুক্ত ছিল বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত উপদেশাবলি অধ্যয়ন, অল্প সময়ের ব্যবধানে চলাচলকারী যান বা শাটল্ (Shuttle)-এর নিয়মাবলি জানা, শারীরবৃত্তীয় প্রশিক্ষণ, টি-৩৮(T-38) উড়ানের প্রশিক্ষণ, জলহীন নিঃসঙ্গ জায়গায় কীভাবে জীবনধারণ করতে হয় ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়। সুনীতা ‘আইএসএস’ (International Space Station, ISS) বা আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রে (মহাকাশচারীদের বসবাসের জন্য তৈরি একটি কৃত্রিম উপগ্রহ) রাশিয়ার সহযোগী হিসেবে ‘অভিযান-১’ (Expedition-1) এর কুশলীদের সঙ্গে কাজ করেন। এছাড়া ২০০২ সালের মে মাসে জলতলে জলজ প্রাণীদের বাসস্থানে ন’দিন কাটিয়েছিলেন সুনীতা। ২০০১ সালে যন্ত্রবিদ শ্রেণীর অনুমতিপত্র প্রাপ্তির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি একজন অপেশাদার রেডিওচালক হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ২০০৮ সাল নাগাদ তিনি নাসার নভোশ্চর কার্যালয়ের উপ-প্রধান হিসেবেও কাজ করেছিলেন।

সুনীতা মহাকাশ ‘অভিযান-১৪’ (Expedition-14) এবং  ‘অভিযান-১৫’ (Expedition-15) তে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। ২০০৬ সালের ৯ই ডিসেম্বর তাঁকে ‘শাটল্ ডিসকভারির মাধ্যমে ‘এসটিএস-১৬’ (STS-16)-এর সাহায্যে ‘আইএসএস’-এ পাঠানো হয়েছিল ‘অভিযান-১৪’ এর সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য। উৎক্ষেপণের পরে সুনীতা তাঁর চুলের একটি বিশেষ অংশ ‘লক্স অব লাভ’ (Locks of Love) নামে এক প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যে দান করেন। ‘এসটিএস-১৬’ এর সঙ্গে সেটি পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হয়। ২০০৭ সালে ‘অভিযান-১৫’ এ পরিবর্তনের জন্য রুশ সদস্যদের ফিরিয়ে আনা হয়। ‘এসটিএস-১৬’ অভিযানের অষ্টম দিনে সুনীতা প্রথম তাঁর যানের বাইরে কাজ করেন। ২০০৭ সালের ৩১ জানুয়ারি, ৪ঠা ফেব্রুয়ারি এবং ৯ই ফেব্রুয়ারি  তিনবার মহাকাশে পদচারণা সম্পূর্ণ করেন এই ন’দিনের মধ্যে। তৃতীয়বার তিনি প্রায় ৬ ঘন্টা ৪০ মিনিট কাটিয়েছিলেন আইএসএস মহাকাশ কেন্দ্রের বাইরে। ব্যক্তিগত জিনিস হিসেবে সুনীতা আইএসএস এ নিয়ে গিয়েছিলেন একটি ভাগবত গীতার সংকলন, একটি গণেশের মূর্তি ও কিছু সিঙ্গাড়া। প্রথম মহাকাশচারী হিসেবে কক্ষপথে ম্যারাথন দৌড়ে অংশ নিয়েছিলেন তিনি ১৬ এপ্রিল ২০০৭ সালে। এই ২০০৭ ‘বস্টন ম্যারাথন দৌড়টি ৪ ঘন্টা ২৪ মিনিটে সম্পূর্ণ করেছিলেন। ২৬ এপ্রিল ২০০৭-এ যখন ‘এসটিএস-১১৭’ তে ‘অ্যাটলান্টিস’-এর মাধ্যমে সুনীতাকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হয় তখন সুনীতা ‘এসটিএস-১১৭’ এর অভিযান বিশেষজ্ঞ (Mission Specialist) হিসেবে কাজ করেছিলেন। এই মহাকাশ অভিযান থেকে ফিরে সুনীতা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবেন, এই ধরনের কিছু কথা ছড়িয়ে পড়েছিল। বলা হয়েছিল মহাকাশে থাকাকালীন তিনি পৃথিবীর সমস্ত অংশ অন্ধকার দেখলেও মক্কা এবং মদিনাকে একমাত্র উজ্জ্বল দেখেছিলেন। যদিও এসব গুজব নিতান্তই ভিত্তিহীন।

পরবর্তীকালে ‘অভিযান-৩২’এবং ‘৩৩’ এও তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। ২০১২ সালের ১৫ই জুলাই ‘অভিযান-৩২’ ও ‘৩৩’ এর সদস্য হিসেবে সুনীতা পুনরায় পাড়ি দিয়েছিলেন ‘আইএসএস'(ISS)-এর উদ্দেশ্যে ‘ সয়ুজ টিএমএ-০৫এম’ নামক রাশিয়ান মহাকাশযানের সাহায্যে। তিনি ‘অভিযান-৩২’ যানের ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করেছিলেন। ‘আইএসএস’ পৌঁছনোর পরই ‘অভিযান-৩৩’ এর দায়িত্ব পান। ১৬ সেপ্টেম্বরে সুনীতা ‘আইএসএস’ এর অধিনায়কত্ব লাভ করেন। সুনীতা উইলিয়ামসই বিশ্বের দ্বিতীয় মহিলা যিনি কোন মহাকাশ অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন। সেই বছরই অর্থাৎ ২০১২ সালের ১৯শে নভেম্বর তাঁরা পৃথিবীর মাটিতে পদার্পণ করেছিলেন। ২০১২ সালের অগাস্ট পর্যন্ত সুনীতা ৫০ ঘন্টা ৪০ মিনিট ধরে সাতবার মহাশূন্যে পদচারণা করেছেন। সবচেয়ে অভিজ্ঞ মহাকাশ পদচারণাকারীদের (Spacewalkers) তালিকায় সুনীতা রয়েছেন নবম স্থানে। ‘আমেরিকান দূতাবাস বিদ্যালয়ে’ (American Embassy School) ভাষণ দিয়েছিলেন সুনীতা। ‘সোসাইটি অব এক্সপেরিমেন্টাল টেস্ট পাইলট’ -এর(Society of Experimental Test Pilot) সদস্য পদেও ছিলেন তিনি। এছাড়াও আমেরিকান হেলিকপ্টার অ্যাসোসিয়েশন  এবং ‘সোসাইটি অব ফ্লাইট টেস্ট ইঞ্জিনিয়ার’ সংস্থার সঙ্গেও যুক্ত হয়েছেন তিনি।

২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সুনীতা গুজরাটের ‘সবরমতী আশ্রমে’ গিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে তাঁর পিতৃপুরুষদের গ্রাম ঝুলাসানে যান। ‘বিশ্ব গুজরাটী সমাজ’ তাঁকে ‘সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল বিশ্ব প্রতিভা পুরস্কার’ প্রদান করে। তিনিই প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত যিনি ভারতের নাগরিক না হওয়া সত্ত্বেও এই পুরস্কার পেয়েছেন। সুনীতা দুবার ‘নৌসেনার প্রশংসামূলক পদক’ ( Navy Commendation Medel) পেয়েছেন। এছাড়াও তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রাপ্তিগুলি হল ‘নৌসেনা ও সমুদ্র বিভাগীয় বিষয়ে বিশেষ কীর্তির  পদক’ ( Navy and Marine Corps Achievement Medel), ‘মানবতাবাদী সেবার পদক’ (Humanitarian Service Medel),  ‘নাসার স্পেসফ্লাইট পদক’ (NASA Spaceflight Medel), ২০১১ সালে  রাশিয়া সরকারের ‘মহাকাশ পরিভ্রমণ ও অনুসন্ধানে যোগ্যতার পদক’ ( Medel ‘For Merit in Space Exploration’) ইত্যাদি। ২০০৮ সালের ২৫ জুন ভারত সরকার প্রদত্ত ‘পদ্মভূষণ’ সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন সুনীতা।

৪৭ বছর বয়সে ‘ন্যাশানাল সায়েন্স সেন্টারে’ (National Science Centre) এসে সুনীতা উইলিয়ামস বলেছিলেন ”মহাকাশ অপূর্ব জায়গা…এখন মহাকাশকেও বাড়ি বলে মনে হয়।” তিনি আরও বলেছিলেন ”আমি কোনোদিন ভাবিনি আমি মহাকাশচারী হব। আমারও অনেক ব্যর্থতা আছে। শেষ পর্যন্ত এখানে পৌঁছিয়েছি।” ‘ইসরো’র প্রশংসা করে সুনীতা উইলিয়ামস বলেছিলেন এই সংস্থা আরও অনেক মহিলাকে মহাকাশে যেতে উৎসাহিত করবে।

আপনার মতামত জানান