ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসে বীরেন জে শাহ (Viren J. Shah) কেবল একজন দক্ষ রাজনীতিবিদই ছিলেন না, প্রতিষ্ঠিত এক শিল্পপতি হিসেবেও তিনি ছিলেন সর্বজনবিদিত। পশ্চিমবঙ্গের ২১তম রাজ্যপাল ছিলেন বীরেন জে শাহ। তাছাড়া ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ সাল এবং ১৯৯০ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দুই পর্বে মোট ১২ বছর তিনি রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন। বিভিন্ন জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠান এবং সেবামূলক কাজকর্মের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন ওতপ্রোতভাবে।
১৯২৬ সালের ১২ মে কলকাতার চিৎপুর রোডে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে বীরেন জে শাহের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম জীবনলাল মতিচাঁদ শাহ এবং মায়ের নাম জয়াবেন। ১৯০০ সালের প্রথমদিকে তাঁর বাবা জীবনলাল কলকাতায় এসে হাওড়ার কাছে অ্যালুমিনিয়ামের পাত্র তৈরির উপকরণ একত্র করে একটি কারখানা গড়ে তুলেছিলেন৷ এভাবেই তাঁর বিচিত্র কর্মজীবন শুরু হয়েছিল। জীবনলাল ছিলেন আগাগোড়া গান্ধীবাদে বিশ্বাসী একজন মানুষ। পরবর্তীকালে জয়াবেনের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। বীরেন শাহের শৈশবকালে সমগ্র ভারত জুড়ে শুরু হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের লড়াই এবং এক উত্তপ্ত রাজনেতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তাঁর বাল্য-শৈশব ও কৈশোরের দিনগুলি কেটেছে। ১৯৩৫ সালে বীরেন শাহ বাবার সঙ্গে গুজরাটে চলে যান এবং সেখানে তাঁর বাবা জীবনলাল কাথিয়াওয়াড় হরিজন সেবক সংঘের এবং খাদি প্রচার সংঘের সভাপতিত্ব গ্রহণ করেন। বীরেন শাহের দুই পুত্র এবং একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। তাঁর বড় ছেলে রাজেশ শাহ বর্তমানে ‘মুকুন্দ লিমিটেড’-এর সহ-চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
বাবার সঙ্গে গুজরাট চলে যাওয়ার কারণে বম্বে, নাসিক এবং ওয়ার্ধাতেই বীরেন শাহের প্রাথমিক শিক্ষালাভ সম্পূর্ণ হয়েছিল। পরবর্তীকালে ওয়ার্ধার কমার্স কলেজে ভর্তি হন তিনি। ১৯৪২ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্রদের অংশগ্রহণের জন্য তৎকালীন সরকার এই কলেজ বন্ধ করে দিয়েছিল। অনেক বছর পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলে বীরেন শাহ ছয় সপ্তাহের একটি অ্যাডভান্স ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামে যোগদান করেছিলেন।
১৯৪৪ সালে বীরেন শাহ লাহোরে অবস্থিত ‘মুকুন্দ আয়রন অ্যাণ্ড স্টিল ওয়ার্কস লিমিটেড’-এ একজন অবৈতনিক শিক্ষানবিশ হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৪৬-৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় বীরেন শাহ ছিলেন লাহোরে। ভারত বিভাজনের পর যে রক্তপাত ও হত্যাকাণ্ড চলে তা তাঁকে সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ এবং উদ্বাস্তু আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করবার সুযোগ এনে দিয়েছিল। এই প্রাথমিক অভিজ্ঞতা তাঁকে পরবর্তীকালে ব্যবসা এবং রাজনীতির আন্তঃসম্পর্ক বুঝতে ভীষণভাবে সাহায্য করে। ১৯৪৮ সালে লাহোরের কারখানায় প্রভূত ক্ষতি হওয়ার ফলে কোম্পানি বম্বের উপকণ্ঠে কুর্লাতে একটি নতুন কারখানা নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বীরেন শাহ এই নির্মাণকাজে সহকারি ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব সামলেছিলেন। তারপর পরবর্তী চার বছর তিনি বিক্রয় এবং অ্যাকাউন্টসের দায়িত্বে ব্যবসায়িক ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৬ সালে এই বীরেন শাহই কঠোর পরিশ্রম করে নিজের যোগ্যতায় এই কোম্পানির প্রধান কার্যনির্বাহীর পদে বহাল হয়েছিলেন। কোম্পানির মুখ্য অধিকর্তা হিসেবে তিনি কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যার ফলে কোম্পানি প্রযুক্তিগত অগ্রগতি লাভ করে। ১৯৬৪ সালে তিনি কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের একজন পরিচালক এবং ভাইস চেয়ারম্যান পদে উন্নীত হন। ধারাবাহিকভাবে ১৯৬৮ সাল থেকে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং ১৯৭২ সাল থেকে চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ সামলেছেন বীরেন জে শাহ। ১৯৭২ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ২৭ বছর এই পদ ধরে রেখেছিলেন তিনি। সর্বস্তরের কর্মীদের সঙ্গেই তিনি যোগাযোগ বজায় রাখতেন। কর্মচারীদের বেতনের বিষয়কে কেন্দ্র করে যখন লকআউট, বেআইনি ধর্মঘট ইত্যাদি একের পর এক বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে থাকে এবং কোনোরকম পদক্ষেপই যখন কার্যকর হচ্ছিল না, তখন বীরেন শাহ এমন এক সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন যা শিল্পের ইতিহাসে অভূতপূর্ব। তিনি শ্রমিকদের ইউনিয়নকে একটি আলাদা কমিটি গঠন করবার অধিকার দেন এবং শ্রমিকদের বেতন কী হবে তা সেই কমিটিকেই নির্ধারণ করবার জন্য বলেন। তিনি কথা দিয়েছিলেন, ইউনিয়ন কর্তৃক গঠিত কমিটি যা সিদ্ধান্ত নেবে তাতে তিনি স্বাক্ষর করে দেবেন এবং তিনি সেই প্রতিশ্রুতি রেখেছিলেন। ফলে ১৯৯৪ সালে তিনি পুনরায় কোম্পানির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং ১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত এই পদে বহাল থাকেন।
কয়েক দশক ধরে ভারতীয় শিল্পের প্রধান মুখপাত্র ছিলেন তিনি। ‘অ্যাসোসিয়েটেড চেম্বার অব কমার্স অ্যাণ্ড ইণ্ডাস্ট্রি অব ইণ্ডিয়া’র সভাপতি ছিলেন বীরেন শাহ। ‘ইণ্ডিয়ান মার্চেন্ট চেম্বারস’-এর সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেছেন তিনি। বহু বছর যাবৎ ‘ফেডারেশন অব ইণ্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্স অ্যাণ্ড ইন্ডাস্ট্রি’র ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ছিলেন বীরেন শাহ। ‘ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স’-এর ইণ্ডিয়ান ন্যাশানাল কমিটির সভাপতি ছিলেন তিনি। একসময় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সদস্যপদ ছিল তাঁর। ‘স্টিল ফার্নেস অ্যাসোসিয়েশন অফ ইণ্ডিয়া’র প্রতিষ্ঠাতা-চেয়ারম্যান এবং ‘স্টিল রি-রোলিং মিলস অ্যাসোসিয়েশন অফ ইণ্ডিয়া’র চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছিলেন বীরেন শাহ। মহারাষ্ট্র রাজ্য শিল্প উপদেষ্টা পরিষদ এবং গুজরাট রাজ্য শিল্প উপদেষ্টা পরিষদেও কাজ করেছিলেন তিনি। এছাড়া শিল্প ও ব্যবসা সংক্রান্ত বিভিন্ন নীতি-নির্ধারণী সংস্থার সঙ্গেও যুক্ত থেকেছেন বীরেন জে শাহ।
শিল্প এবং ব্যবসার সঙ্গে যোগাযোগ যাঁর, সেই বীরেন শাহের প্রাথমিক রজনীতি মূলত শিল্প ও অর্থনৈতিক নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বছরের পর বছর আরও পরিণতি লাভ করেছে। ১৯৯০-এর দশকে ভারতবর্ষে যে অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু হয়েছিল, সেই ১৯৬০ থেকে বীরেন শাহ এবং তাঁর রাজনীতির সহকর্মীরা তা নিয়ে আলোচনা এবং প্রচার করে আসছেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির বিস্তৃতির জন্য কমিউনিস্ট, সমাজতন্ত্রী, কংগ্রেসম্যান, জনসংঘ ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শের রাজনীতির ঘেরাটোপে বন্ধুত্ব তৈরি করতে পেরেছিলেন তিনি। মতাদর্শগত পার্থক্য থাকলেও এবং রুক্ষ কাজকর্মের এবং রাজনৈতিক ধাক্কাধাক্কির পরেও ব্যক্তিগত সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে জানতেন বীরেন শাহ। ভারতীয় জনতা পার্টির সঙ্গে যুক্ত হলেও জ্যোতি বসু, এল. কে. আডবাণীর মতো মানু্দের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল মধুর বন্ধুতার।
১৯৬৭ সালে বীরেন শাহ গুজরাটের জুনাগড় থেকে সংসদে নির্বাচিত হন। ‘ভারতীয় জনতা পার্টি’র কোষাধ্যক্ষ হিসেবে বীরেন শাহ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তাঁর দায়িত্ব সামলেছেন। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তিনি লোকসভার সদস্য ছিলেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ এবং ১৯৯০ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দুই দফায় মোট বারো বছর রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন বীরেন শাহ। এনডিএ সরকার ক্ষমতায় আসার পর পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল কে হবেন তাই নিয়ে ধন্ধে পড়েন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবাণী। শেষপর্যন্ত বীরেন জে শাহের নাম বেছে নেওয়া হয়। পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুও এই সিদ্ধান্তে আপত্তি জানাননি। যেহেতু বীরেন শাহ ছিলেন একজন শিল্পপতি তাই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর বিশ্বাস ছিল যে রাজ্যের সঙ্গে শিল্পপতিদের সম্পর্কের উন্নতি হবে ফলে রাজ্যের অগ্রগতি ঘটবে দ্রুত। ১৯৯৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের ২১তম রাজ্যপাল হন বীরেন জে শাহ। ২০০৪ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব সামলেছিলেন তিনি। জ্যোতি বসু থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হাতে পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্ব হস্তান্তরের সময়েও রাজ্যপাল ছিলেন তিনি।
১৯৬০-এর দশকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বীরেন শাহের একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও ধীরে ধীরে তা বদলাতে থাকে জটিল রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে। ট্রেড ইউনিয়নবাদী এবং সমাজতান্ত্রিক নেতা জর্জ ফার্নাণ্ডেজের সঙ্গে সম্পর্ক যত ঘনিষ্ঠ হয় তাঁর, ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সম্পর্কে ততই অবনতি ঘটে।
১৯৭০ সালে জনসাধারণের বিষয়ে বীরেন শাহ এমন একটি ভূমিকা পালন করেছিলেন যা সাধারণত ভারতবর্ষের কোনো শিল্পপতি বা ব্যবসায়ীর সঙ্গে ঠিক খাপ খায় না। মূলত তাঁর কর্মকাণ্ডকে সেই উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিরোধী হিসেবেই গণ্য করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন জারি হওয়া জরুরি অবস্থার বিরোধিতা করার জন্য বীরেন শাহ এবং জর্জ ফার্নাণ্ডেজ একটি আণ্ডারগ্রাউণ্ড আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। একজন শিল্পপতি হিসেবে সরকার-বিরোধী তাঁর এই পদক্ষেপ সত্যিই বিস্ময়ের। বীরেন শাহকে ‘দ্য মেইনটেন্যান্স অফ ইন্টারনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ১৯৭১’-এর অধীনে গ্রেফতার করা হয়। প্রথমে ছয় মাস বম্বের আর্থার রোড জেলে তাঁকে আটকে রাখা হয় এবং পরবর্তীকালে দিল্লীর তিহার জেলে স্থানান্তরিত করে তিন মাস সেখানে বন্দি করে রাখা হয়।
বীরেন শাহের আগ্রহ ছিল বৈচিত্র্যময় এবং তিনি বহু জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অধুনা মুম্বাইয়ের অন্যতম বৃহত্তম সরকারী হাসপাতাল সেন্ট জর্জ হাসপাতালের ‘বোর্ড অব ভিজিটরস’-এর চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। এছাড়া বীরেন জে শাহ বেঙ্গালুরুর ‘ইণ্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স’-এর কাউন্সিলের সদস্য এবং মুম্বাইয়ের ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ট্রেনিং ইন ইণ্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর বোর্ড অফ গভর্নরসের সদস্য ছিলেন। বীরেন শাহ হোম গার্ডের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা কমিটিতেও কিছুদিন কাজ করেছিলেন। ১৯৯০ সালে জাতীয় সংহতি পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। সৌরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে লবণাক্ততার প্রবেশের বিরুদ্ধে প্রতিকারমূলক পদক্ষেপের জন্য সক্রিয়ভাবে প্রচার চালিয়েছিলেন তিনি। এর বাইরে সেখানকার কারাগার সংস্কারের জন্যও তিনি প্রভূত চেষ্টা চালিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর অধস্তন কর্তৃপক্ষদের সঙ্গে এ বিষয়ে চিঠি লেখালেখি হয়েছে তাঁর। ১৯৯৪ সালে রাজ্যসভায় নারীদের প্রতি অত্যাচার বিষয়ে বেসরকারী সদস্যের রেজোলিউশন প্রবর্তন করেন বীরেন শাহ।
২০১৩ সালের ৯ মার্চ জর্ডনে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৮৭ বছর বয়সে বীরেন জে শাহের মৃত্যু হয়।
One comment