প্রতি বছর প্রতি মাসের নির্দিষ্ট কিছু দিনে বিভিন্ন দেশে কিছু দিবস পালিত হয়। ওই নির্দিষ্ট দিনে অতীতের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে স্মরণ করা বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতেই এই সমস্ত দিবস পালিত হয়। পালনীয় সেই সমস্ত দিবস গুলির মধ্যে একটি হল বিশ্ব স্ট্রোক দিবস (World Stroke Day)।
প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে ২৯ অক্টোবর বিশ্ব স্ট্রোক দিবস পালিত হয়ে থাকে। স্ট্রোক এমন একটি রোগ যা যেকোনো মুহূর্তে মানুষকে আক্রমণ করতে পারে এবং প্রাণহানি পর্যন্ত ঘটতে পারে যদি নিজের স্বাস্থ্য বিষয়ে মানুষ সচেতন না হয়। প্রাণহানি ছাড়াও স্ট্রোকের কারণে পক্ষাঘাতে পঙ্গু হয়ে পড়ে মানুষ অনেকসময়। জীবিত অবস্থাতেও তা মৃত্যুরই সামিল। সাধারণত উচ্চরক্তচাপের কারণে মস্তিষ্কে রক্তচলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়াই স্ট্রোক হওয়ার অন্যতম কারণ। এছাড়াও রক্তে কোলেস্টেরোল বেশি থাকলে, অতিরিক্ত মদ্যপান বা ধুমপান করলে, জাঙ্কফুড বেশিমাত্রায় খেলে কায়িক পরিশ্রম কম পরিমাণ হলে স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। সমীক্ষা বলছে বিশ্বে প্রতি ৬ জনের মধ্যে একজন মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। সর্বোপরি স্ট্রোকের কারণে সারাবিশ্বে প্রতিবছর ২ কোটি মানুষের মৃত্যু হয় এবং প্রায় দেড়কোটি মানুষ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তাই স্ট্রোক বিষয়ে মানুষকে সচেতন করে তোলবার জন্যই প্রত্যেক বছর এই বিশেষ দিনটি পালন করা হয়ে থাকে। উপযুক্ত চিকিৎসার সাহায্যে এই রোগ যে প্রতিরোধ করা সম্ভব মানুষের কাছে সেই বার্তাটি পৌঁছে দেওয়ার কাজ করে এবং স্ট্রোকের পর তা থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা মানুষদের আরও বেশি যত্ন ও দেখাশোনা করার ওপর জোর দেওয়ার কথা বলে এই বিশ্ব স্ট্রোক দিবস।
২০০৬ সালে ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক অরগানাইজেশান (World Stroke Organization বা WSO) ২৯ অক্টোবরকে বিশ্ব স্ট্রোক দিবস হিসেবে ঘোষণা এবং প্রথম উদযাপন করে। তবে এর আগেই ২০০৪ সালে কানাডার ভ্যানকুবারে (Vancouver) চতুর্থ বিশ্ব স্ট্রোক কংগ্রেসে (World Stroke Congress) বিশ্ব স্ট্রোক দিবস প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। তখন কানাডারই স্নায়ুবিজ্ঞানী ডঃ ভ্লাদিমির হ্যাচিনস্কির (Dr. Vladimir Hachinski) নেতৃত্বে একটি দল গঠিত হয় এই সংক্রান্ত কাজকর্ম পরিচালনার জন্য। এই বিজ্ঞানী ২০০৬ সালে ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক প্রোক্ল্যামেশন (World Stroke Proclamation) সঙ্ঘবদ্ধকরণে সাহায্য করেছিলেন। ২০০৬ সালেই আন্তর্জাতিক স্ট্রোক সোসাইটি (International Stroke Society) প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে বিশ্ব স্ট্রোক ফেডারেশন (World Stroke Federation) যুক্ত হয়ে তৈরি হয় ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক অরগানাইজেশান। তখন থেকে বিশ্ব স্ট্রোক দিবস পালনের দায়িত্ব তুলে নেয় এই সংস্থা এবং ২০০৬ সালের ২৯ অক্টোবরে প্রথম এই দিবস উদযাপন করে। অবশ্য এসবের কিছুর আগেই ১৯৯০-এর দশকে ইউরোপিয়ান স্ট্রোক ইনিশিয়েটিভ (European Stroke Initiative) বিশ্বজুড়ে স্ট্রোক বিষয়ে সচেতনতা তৈরির জন্য একটি বিশেষ দিন নির্বাচনের পরিকল্পনা করেছিল যদিও তখন অর্থনৈতিক কারনে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি এবং সেটা কেবলই ইউরোপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। ২০১০ সালে ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক অরগানাইজেশান স্ট্রোককে জনস্বাস্থ্যের জরুরি অবস্থা (Public health emergency) বলে ঘোষণা করেছিল৷ ২০০৯ সালে এই সংস্থার সদস্যরা কেবল একটি বার্ষিক উদযাপনের মধ্যেই আটকে না থেকে সারাবছর ধরে আরও দৃঢ়ভাবে স্ট্রোক সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে এক অভিযানের পরিকল্পনা করে এবং ২০১০ সাল নাগাদ ‘ওয়ান ইন সিক্স’ (1 in 6 Campaign) নামে এক অভিযান কর্মসূচী আরম্ভ করে।
এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিনটি বিশ্বের নানাপ্রান্তে উদযাপন করা হয় বিবিধ আয়োজনের মাধ্যমে। সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কোথাও বা মেডিকেল কলেজগুলি থেকে শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়, সভা বা সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা স্ট্রোক প্রতিরোধের নানা উপায়ের সন্ধান দেন এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা করেন। কোথাও আবার জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে মানুষের হাতে হাতে রঙীন ছাপানো লিফলেট এবং প্যাম মফ্লেট বা ছোট পুস্তিকা বিলি করা হয় যাতে স্ট্রোক প্রতিরোধ সংক্রান্ত নানা কথা ছবিসহ দেখানো থাকে। এই বিশেষ দিনে গণমাধ্যমেও সরাসরি সম্প্রচার করা হয় স্ট্রোক বিষয়ক বিভিন্ন ধরনের টক শো। এইভাবে আরও বিচিত্র সব আয়োজন করে বিশেষ মর্যাদা সহকারে দিনটি পালন করা হয় সারাবিশ্বে।
প্রতিবছর এই দিনটি উদযাপনের জন্য একটি বিষয় বা থিম নির্ধারণ করা হয়। ২০১৭ সালের থিম ছিল, ‘হোয়াটস ইওর রিজন ফর প্রিভেন্টিং স্ট্রোক?’ (What’s your reason for preventing stroke?)। ২০১৮ সালের বিষয় হিসেবে ঠিক করা হয়েছিল, ‘আপ এগেইন আফটার স্ট্রোক’ (Up Again After Stroke)। ২০১৯ সালে যে থিমটি নির্ধারণ করা হয়েছিল তা হল, ‘ডোন্ট বি দ্য ওয়ান’ (Don’t Be the One)।