দেবী দুর্গার বাহন

দেব-দেবীর পুজো করতে গিয়ে অনেকেই লক্ষ্য করেছি যেকোন দেব-দেবীর সঙ্গে কোন না কোন পশু-পাখি সংলগ্ন থাকে। পুরাণের গল্পে আমরা জেনেছি যে সেইসব পশু-পাখির পিঠে চড়েই দেব-দেবীরা নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন আর তাই ঐ পশু-পাখিগুলিকে নির্দিষ্ট দেব-দেবীর বাহন বলা হয়। সরস্বতীর হাঁস, লক্ষ্মীর পেঁচা, কার্তিকের ময়ূর, গণেশের ইঁদুর ইত্যাদি আরো অনেক রয়েছে। আর এই চার দেব-দেবীর মাতৃস্বরূপা যিনি, সেই মহামায়া আদ্যাশক্তি দেবী দুর্গার বাহন? আমরা সকলেই এখন বলতে পারি, দেবী দুর্গার বাহন হল সিংহ। কিন্তু আমরা দেবীদুর্গার যে রূপ দেখি, তাতে সিংহের পিঠে চড়ে দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করছেন। কিন্তু ইতিহাসের পিছন দিকে ফিরে গেলে দেখতে পাবো, যখন বাংলায় দুর্গাপূজা চালু হয়, তখন বাংলার মৃৎশিল্পীরা সিংহকে দেবীর বাহন হিসেবে প্রতিমায় স্থান দেননি। এর প্রধান কারণ তৎকালীন বাংলার মৃৎশিল্পীরা সিংহ তখনো চাক্ষুষ করেননি। এই বিষয়টা বেশ ভাবনার যে দেব-দেবীর বিগ্রহ নির্মাণে মানুষের প্রজ্ঞা, চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা এবং শিল্পীর মনন সবই ভীষণভাবে সক্রিয় থাকে। মোটামুটিভাবে এক থেকে দেড়শো বছরের মধ্যেই দেবীর বাহনরূপে সিংহকে দেখা যায় যদিও তা বহু বিবর্তনের ফসল।

দেবীর বাহন হিসাবে সিংহ। চিত্রসূত্রঃ ইন্টারনেট

একেবারে শুরুর দিকে দেবী দুর্গার হাতে না ছিল অস্ত্র, না ছিল দশটি হাত – দুই হাতেই শত্রু নিধন করতেন তিনি। ক্রমে হাতের সংখ্যা যেমন বাড়তে থাকলো, তেমনই তাঁর অস্ত্রের সংখ্যাও বাড়তে থাকলো। দশটি হাতে দশ রকম অস্ত্রে সজ্জিতা হলেন দেবী। সাধারণভাবে তিনি ছিলেন দ্বিভুজা, তবে অসুরনিধনে সময়বিশেষে দেবীর কখনো চতুর্ভুজা, ষড়ভুজা, কখনো অষ্টভুজা বা দশভুজা রূপ দেখা গেছে। আবার কখনো দ্বাদশভুজা, ষোড়শভুজা বা অষ্টাদশভুজা দেবীপ্রতিমাও প্রাচীনকালে নির্মিত হয়েছে। ধীরে ধীরে দেবীকে বাংলার ঘরের মেয়ে, পরিবারের অঙ্গ হিসেবে গরে তোলার আকাঙ্ক্ষায় তাঁর পৌরাণিক কাহিনির পরিপ্রেক্ষিতে স্বামী ও সন্তান-সন্তুতি সহ একত্রিত পরিবারের মধ্যে দেবীর রূপ কল্পনা শুরু হয়। ফলে দেবীর পাশেই স্থান পায় লক্ষ্মী, গণেশ এবং কার্তিক, সরস্বতীর বিগ্রহ আর থাকেন মহেশ্বর শিব। শরৎকাল এলেই দেবীপক্ষের সূচনায় এক বৃহৎ বনেদি পরিবারের মেয়ে হয়ে মর্ত্যে আসেন দেবী তাঁর সন্তান-সন্তুতি সহকারে।

পুরাণে বলা হয়েছে হিমালয় রাজ দেবীকে সিংহ দিয়েছিলেন বাহন হিসেবে। মনে করা হয় যে দেবীর প্রবল শৌর্য ও তেজের কারণে সিংহের মতো বলবান পশুকেও তিনি নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন। এখানে আরো একটা ব্যাপার উল্লেখ করা যায়, তা হল টোটেমের অনুষঙ্গ। আদিমযুগের গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ নিজেদের গোষ্ঠীর সদস্যদের মানসিকতা, মন-মেজাজ বা চরিত্র অনুযায়ী কিছু কিছু প্রাণীকে গোষ্ঠীর প্রতীক হিসেবে রাখতো যাকে টোটেম বলে। দেবী দুর্গাই হোক আর অন্য দেব-দেবীই হোক প্রত্যেকের বাহন আসলে সেই টোটেম যা ঐ দেব-দেবীর মানসিকতা ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের একটা প্রতীক মাত্র। এই ধারণা থেকে বলা যেতে পারে দুর্গার অসীম তেজ ও শৌর্য-বীর্যের প্রতীক হল পশুরাজ সিংহ। কিন্তু সমস্যা হল, ঐতিহাসিকরা দেখেছেন যে প্রাচীন কালে সিন্ধু সভ্যতায় কোথাও সিংহকে পশু হিসেবে পাওয়া যায়নি, অন্য অনেক জীবজন্তুর প্রতিকৃতি দেখা গেছে বিভিন্ন সীলমোহরে কিন্তু তাতে সিংহের আদল একেবারেই খুঁজে পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে মৌর্য শাসনকালে সর্বত্র সিংহকে নানা স্থানে প্রতীক হিসেবে লক্ষ করা যায়। ঋগ্বেদে সিংহ এবং সিংহনাদের উল্লেখ পাওয়া গেলেও বাঘের উল্লেখ নেই। আবার অন্যদিকে অথর্ববেদে বাঘ এবং সিংহ দুয়ের উপস্থিতিই রয়েছে। বহু সময় দেখা গেছে উত্তর ভারতের অনেক জায়গায় দেবীর বাহন বাঘ। বাংলার প্রাচীন মূর্তিগুলিতে আবার দেখা যায় দেবীর বাহন ঘোড়ার মতো দেখতে একটি পশু যার মুখটা ড্রাগনের মতো অনেকটা। গো-সাপের মুখ আর ঘোড়ার শরীর এই দুই মিলিয়ে নির্মিত এই পশুকে গোধা বলা হয়।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

বিবর্তনের সূত্র ধরে দেখা যায় প্রাচীন কালে বাঙালি বলতে এদেশে ছিল অস্ট্রিক গোষ্ঠীর মানুষরা। বাঙালিদের নৃতাত্ত্বিক বিবর্তন লক্ষ করলে অস্ট্রিকদের উপস্থিতির কথা জানা যায়। তারাই দীর্ঘ হাজার চারেক বছর ধরে দেবী দুর্গার পুজো করে আসছে আর তাদের দেবী হিসেবেই দেবীর বাহন হয়েছে গো-সাপ। অস্ট্রিকদের কাছে গো-সাপ হল কৃষির শুভ প্রতীক। অস্ট্রিকরা কৃষিপ্রধান জাতি ছিল আর পরে দ্রাবিড়দের সংস্পর্শে নগর নির্মাণ বা রাজ্যশাসনের পর্ব এলে তখন দেবীর বাহন হিসেবে ঘোড়ার উপস্থিতি দেখা যায়। কারণ ঘোড়া ছিল রাজকীয়তার প্রতীক, যুদ্ধের সহায়ক প্রাণী। এভাবে এত দীর্ঘ বিবর্তনের কারণে সঠিক করে বলা শক্ত যে কোন সময় এবং কেন দেবী দুর্গার বাহন সিংহ হল।

এ প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় রয়েছে। পঞ্জিকা খুললেই দেখা যায় দেবী প্রতি বছরই বিশেষ কোনো বাহনে চড়ে মর্ত্যে আসেন। কখনো নৌকায়, কখনো দোলায়, কখনো ঘোড়ায় আবার কখনো বা হাতির পিঠে চেপে। একইভাবে এই বাহনগুলিতে তিনি আবার ফিরেও যান কৈলাসধামে। অনেকেই খেয়াল করেছেন যে দেবী কোন বাহনে চেপে আসছেন আর কোন বাহনে ফিরে যাচ্ছেন তার উপর জ্যোতিষচর্চায় একটি অনুমান করা হয় যে সেই বছরের অবস্থা কেমন যেতে পারে। এখানে দেবীর বাহন চারটি – নৌকা, পালকি বা দোলা, ঘোড়া এবং হাতি। যে বাহনে চেপে মা আসেন মর্ত্যধামে, সেই একই বাহনে কখনোই তাঁকে ফিরতে দেখা যায় না। লোকবিশ্বাসে রয়েছে হাতিতে আগমন ও গমন ঘটলে তা খুবই শুভ আর নৌকায় যদি আগমন হয় তাহলে প্রভূত ধন-সম্পদের আগমন হয় জীবনে। অন্যদিকে মনে করা হয়, নৌকায় দেবীর গমন হলে তা বন্যা ও প্রবল ক্ষয়ক্ষতিকে নির্দেশ করে আর দোলা বা পালকিটিও একইভাবে মহামারী, ভূমিকম্পের নির্দেশক। সবশেষে ঘোড়ায় আগমন হোক বা গমন দুই ক্ষেত্রেই দেবী যেন মানুষকে ক্ষয়-ক্ষতি কিংবা যুদ্ধের বার্তা দিয়ে যেতে চান। দেবীর এই চার বাহন বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক পরিবর্তন বা অবস্থার পূর্বাভাস দেয় বলেই মানুষের বিশ্বাস। বিভিন্ন তিথি-নক্ষত্র অনুযায়ী এই বাহনের প্রকৃতি নির্ণয় করে থাকেন জ্যোতিষচর্চাকারীরা।    

  এ প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় রয়েছে। পঞ্জিকা খুললেই দেখা যায় দেবী প্রতি বছরই বিশেষ কোনো বাহনে চড়ে মর্ত্যে আসেন। কখনো নৌকায়, কখনো দোলায়, কখনো ঘোড়ায় আবার কখনো বা হাতির পিঠে চেপে। একইভাবে এই বাহনগুলিতে তিনি আবার ফিরেও যান কৈলাসধামে। অনেকেই খেয়াল করেছেন যে দেবী কোন বাহনে চেপে আসছেন আর কোন বাহনে ফিরে যাচ্ছেন তার উপর জ্যোতিষচর্চায় একটি অনুমান করা হয় যে সেই বছরের অবস্থা কেমন যেতে পারে। এখানে দেবীর বাহন চারটি – নৌকা, পালকি বা দোলা, ঘোড়া এবং হাতি। যে বাহনে চেপে মা আসেন মর্ত্যধামে, সেই একই বাহনে কখনোই তাঁকে ফিরতে দেখা যায় না। লোকবিশ্বাসে রয়েছে হাতিতে আগমন ও গমন ঘটলে তা খুবই শুভ আর নৌকায় যদি আগমন হয় তাহলে প্রভূত ধন-সম্পদের আগমন হয় জীবনে। অন্যদিকে মনে করা হয়, নৌকায় দেবীর গমন হলে তা বন্যা ও প্রবল ক্ষয়ক্ষতিকে নির্দেশ করে আর দোলা বা পালকিটিও একইভাবে মহামারী, ভূমিকম্পের নির্দেশক। সবশেষে ঘোড়ায় আগমন হোক বা গমন দুই ক্ষেত্রেই দেবী যেন মানুষকে ক্ষয়-ক্ষতি কিংবা যুদ্ধের বার্তা দিয়ে যেতে চান। দেবীর এই চার বাহন বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক পরিবর্তন বা অবস্থার পূর্বাভাস দেয় বলেই মানুষের বিশ্বাস। বিভিন্ন তিথি-নক্ষত্র অনুযায়ী এই বাহনের প্রকৃতি নির্ণয় করে থাকেন জ্যোতিষচর্চাকারীরা।      

2 comments

আপনার মতামত জানান