ভারতের পঞ্চম জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল (Ajit Doval)। কেরালা ক্যাডারের একজন অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস অফিসার এবং প্রাক্তন ‘ভারতীয় ইন্টেলিজেন্স অ্যাণ্ড ল’ এনফোর্সমেন্ট’ অফিসার অজিত দোভালকে কীর্তিচক্র মেধাবী সেবা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। তাঁর তত্ত্বাবধানেই ২০১৬ সালের সার্জিকাল স্ট্রাইক এবং ২০১৯ সালের বালাকোট বিমান স্ট্রাইকের ঘটনাটি পরিচালিত হয়েছিল। ডোকলাম অঞ্চলে স্থিতিশীলতা কাটিয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিদ্রোহ দমনের জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তিনি। ১৯৯৯ সালে কান্দাহারে হাইজ্যাক হওয়া সি-৮১৪ বিমানের যাত্রীদের মুক্তির ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা পালন করেন তিনি।
১৯৪৫ সালের ২০ জানুয়ারি উত্তরাখণ্ডে পাউরি গাড়ওয়াল অঞ্চলের ঘিরি বানেলসিউন গ্রামে অজিত দোভালের জন্ম হয়। তাঁর বাবা মেজর জি. এন. দোভাল ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন পদস্থ অফিসার ছিলেন।
রাজস্থানের আজমীরে আজমীর মিলিটারি স্কুলে সেনাবাহিনীর প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন অজিত। ১৯৬৭ সালে আগ্রা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ড. ভীমরাও আম্বেদকর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন দোভাল। এরপরে ২০১৮ সালের মে মাসে কুমায়ুন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং ঐ বছরই নভেম্বর মাসে অ্যামিটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও সাম্মানিক পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।
১৯৬৮ সালে ভারতীয় পুলিশ সার্ভিসে কেরালা ক্যাডারে কোট্টায়াম জেলার এসপি পদে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন অজিত দোভাল । সাত বছরের জন্য উত্তর-পূর্ব ভারতে কাজ করেছিলেন তিনি। পাঞ্জাবের বিদ্রোহ দমন অভিযানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিতে যোগদানের আগে অজিত দোভাল ১৯৭২ সালে কয়েক মাসের জন্য কেরালার থ্যালাসেরিতে কাজ করেছিলেন। ১৯৯৯ সালে কান্দাহারে সি-৮১৪ বিমানের যাত্রীদের মুক্তির জন্য অন্যতম আলোচক ছিলেন অজিত দোভাল। ১৯৭১ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ভারতীয় এয়ারলাইন্সের প্রায় ১৫টি বিমান হাইজ্যাকের ঘটনা সম্পর্কে আগাম সতর্কতা দিয়েছিলেন অজিত দোভাল। প্রায় দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর অপারেশন শাখার প্রধান ছিলেন তিনি। তাছাড়া ‘মাল্টি এজেন্সি সেন্টার’ (MAC) এবং ‘জয়েন্ট টাস্ক ফোর্স অন ইন্টেলিজেন্স’-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন অজিত দোভাল । সিকিম সংযুক্তিকরণের সময় অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার নিদর্শন দিয়েছিলেন তিনি। এম. কে. নারায়ণন তৃতীয় জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন তাঁর অধীনে খুব অল্প সময়ের জন্য সন্ত্রাসবাদ বিরোধী অভিযানের জন্য প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর পরিচালক পদে উন্নীত হন হয়েছিলেন তিনি। ২০০৫ সালে এই পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন অজিত দোভাল।
২০০৯ সালে ‘বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউণ্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করেন অজিত দোভাল। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়ে বারবার আলোচনায় অংশ নিয়েছেন তিনি। তাঁকে দেশে ও বিদেশে নিরাপত্তার ‘থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক’ বলা হয়। ২০০৯ এবং ২০১১ সালে ‘ইণ্ডিয়ান ব্ল্যাক মানি অ্যাব্রড ইন সিক্রেট ব্যাঙ্কস অ্যাণ্ড ট্যাক্স হেভেনস’ নামে দুটি প্রতিবেদন লেখেন দোভাল । এই পরিসরে ভারতীয় জনতা পার্টি দ্বারা পরিচালিত টাস্ক ফোর্সের অংশ হিসেবে কাজে নামেন তিনি। বিগত কয়েক বছরের মধ্যে লণ্ডন ক্যাপিটাল হিল, ওয়াশিংটন ডিসি, অস্ট্রেলিয়া-ইণ্ডিয়া ইনস্টিটিউট, মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়, ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ, নয়া দিল্লি ও মুসৌরির লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে নিরাপত্তা কৌশলগত বিষয়ে অতিথি হিসেবে বক্তব্য রেখেছেন।
২০১৪ সালের ৩০ মে ভারতের পঞ্চম জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত হন অজিত দোভাল। ঐ বছরই জুন মাসে আইএসআইএল (ISIL)-এর আওতায় ইরাকের তিকরিতে আটক হওয়া ৪৬ জন নার্সকে উদ্ধার করেছিলেন অজিত। ইরাকের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলতে যান তিনি এবং ইরাক সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন। সেনাপ্রধান দলবীর সিং সুহাগের সঙ্গে তিনি ‘ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কাউন্সিল অফ নাগাল্যাণ্ড’ অর্থাৎ এনএনসিএনকে (NSCNK)-র সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে আন্তঃসীমান্ত সামরিক অভিযান পরিকল্পনা করেছিলেন। এই অপারেশনে ভারত সরকারের দাবি অনুযায়ী ২০ থেকে ৩০ জন সন্ত্রাসবাদী নিহত হয়েছিল। তবে মায়ানমার সরকার সম্পূর্ণরূপে এই অভিযানের কথা অস্বীকার করেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা নীতিতে মতাদর্শগত পরিবর্তন ঘটানোর জন্য অজিত দোভালের কৃতিত্ব অনস্বীকার্য। অনেকে মনে করেন ২০১৬ সালে পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে ভারতের সেনাবাহিনীর হামলার আড়ালে অজিত দোভালের পরিকল্পনা ছিল। তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব এস. জয়শঙ্কর এবং চিনে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত বিজয় কেশব গোখলের সঙ্গে কূটনৈতিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ডোকলামের স্থিতিশীলতা দূর করতে একটি সঠিক পদক্ষেপ নিতে সমর্থ হন। ২০১৮ সালে স্ট্র্যাটেজিক পলিসি গ্রুপের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন অজিত দোভাল যা জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের ত্রিস্তরীয় কাঠামোর প্রথম স্তর ছিল। ২০১৯ সালের বালাকোট বিমান হামলা, জম্মু ও কাশ্মীর বিমান হামলা এবং পরে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী কর্তৃক ভারতীয় বিমানচালক অভিনন্দন বর্তমানকে আটক করার পরে অজিত দোভাল ভারতীয় এই বিমানচালকের মুক্তির জন্য জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে আলোচনা করেন। ২০১৯ সালের ৩ জুন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে পুনরায় পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন অজিত দোভাল এবং ব্যক্তিগত স্তরে ক্যাবিনেট মন্ত্রীর পদ পান। তিনিই প্রথম জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা যিনি এই গুরুত্বপূর্ণ পদে উন্নীত হন। জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের ক্ষেত্রে তিনি যথেষ্ট অগ্রণী হয়েছিলেন। ২০২০ সালের ১৫ মে তাঁরই নেতৃত্বে মায়ানমারের সামরিক বাহিনী আসাম সহ অন্যান্য উত্তর-পূর্ব রাজ্যে সক্রিয় ২২টি জঙ্গি গোষ্ঠীকে ভারত সরকারের কাছে হস্তান্তর করা সম্ভব হয়।
পুলিশ বিভাগে সর্বকনিষ্ঠ অফিসার হওয়ার কারণে এবং তাঁর দক্ষতার কারণে ছয় বছর পুলিশ বিভাগে কাজ করার পর অজিত দোভালকে ‘পুলিশ পদক’-এ ভূষিত করা হয়। পরবর্তীকালে তিনি ‘রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক’ পান এবং ১৯৮৮ সালে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সামরিক সম্মান ‘কীর্তিচক্র মেধাবী’ পুরস্কারে সম্মানিত করা হয় তাঁকে। তিনিই একমাত্র পুলিশ অফিসার ছিলেন যিনি এই সামরিক সম্মান লাভ করেন।
বর্তমানে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদেই অধিষ্ঠিত আছেন অজিত দোভাল।
আপনার মতামত জানান