আখলাখউর রহমান কিদওয়াই

আখলাখউর রহমান কিদওয়াই

ভারতীয় রাজনীতির জগতে প্রতিভাবান সমাজদরদী রাজনীতিবিদ হিসেবেই খ্যাতিলাভ করেছেন আখলাখউর রহমান কিদওয়াই (Akhlaqur Rahman Kidwai)। বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে জৈব রসায়ন বিষয়ে গবেষণা করেছেন তিনি৷ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামেও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন আখলাখউর রহমান। নারীদের শিক্ষা, স্বনির্ভরতা এবং মর্যাদার বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছিলেন তিনি। বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, হরিয়ানার মত একাধিক রাজ্যের রাজ্যপালের দায়িত্ব সামলেছেন তিনি দক্ষ হাতে। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন আখলাখউর রহমান। ভারতবর্ষের রাজনীতিতে একেকজন এমন মানুষ এসেছেন কখনও কখনও যাঁরা নিজেদের উচ্চশিক্ষা এবং উচ্চচিন্তার আলোকে আলোকিত করেছেন গোটা দেশকে,আখলাখউর রহমান কিদওয়াই তেমনই একজন মানুষ ছিলেন। এমন উচ্চশিক্ষিত, সমাজসেবী একজন মানুষ সক্রিয় রাজনীতিতেও নিজের দক্ষতা প্রদর্শন করেছিলেন। সারাজীবনে রাজনীতি এবং শিক্ষাসংক্রান্ত বিভিন্ন জাতীয় কমিটি, সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ অলঙ্কৃত করেছেন। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে আখলাখউর রহমানকে ‘পদ্মবিভূষণ’ সম্মানে ভূষিত করা হয়। 

১৯২১ সালের ১ জুলাই উত্তরপ্রদেশের বড়াবাঁকি জেলার বড়াগাঁও গ্রামে আখলাখউর রহমান কিদওয়াইয়ের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম আশফাকুর রহমান কিদওয়াই (Ashfaqur Rehman Kidwai) এবং মায়ের নাম নাজিম-উন-নিসা (Nasim-un-nisa)। আখলাখউর রহমান যখন বেড়ে উঠছেন এবং পড়াশোনা করছেন তখন ভারতবর্ষের চারদিকে এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামকে কেন্দ্র করে। ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইয়ের সেই আঁচ আখলাখউরকেও স্পর্শ করেছিল। তিনি ১৯৪২ সালে সংঘটিত ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে আখলাখউর রহমান বিবাহ করেছিলেন জামিলা নামের এক মহিলাকে। জামিলা কিদওয়াই (Jamila Kidwai) এবং আখলাখউর রহমান কিদওয়াইয়ের মোট ছয় সন্তানের মধ্যে চারটি কন্যা এবং দুইটি পুত্র সন্তান।

১৯৪০ সালে আখলাখউর বিখ্যাত জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় (University of Illinois) থেকে ১৯৪৮ সালে জৈব রসায়নে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। উচ্চশিক্ষার দিকে ঝোঁক ছিল আখলাখউরের এবং তাঁর অনুসন্ধিৎসু মন তাঁকে গবেষণা কর্মের দিকে নিয়ে যায়। ১৯৫০ সালে তিনি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রেরই কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় (Cornell University) থেকে জৈব রসায়নের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি বিষয়ের ওপর গবেষণা শেষ করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। 

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

ড. কিদওয়াই একজন অধ্যাপক হিসেবে নিজের পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন। তিনি আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের একজন অধ্যাপক এবং পরবর্তীকালে বিভাগীয় প্রধান ও পাশাপাশি বিজ্ঞান ফ্যাকাল্টির ডিন হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করেছিলেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। পরবর্তীকালে ১৯৮৩ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত তিনি আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন। আখলাখউর রহমান ভারত সরকারের অধীনস্থ ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (UPSC) চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছিলেন এবং ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত এখানকার দায়িত্ব সামলেছিলেন। ১৯৭৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৮৫ সালের ১৫ মার্চ এবং ১৯৯৩ সালের ১৪ আগস্ট থেকে ১৯৯৮ সালের ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত মোট দুবার আখলাখউর রহমান বিহার রাজ্যের রাজ্যপালের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন বিহারের দশম রাজ্যপাল। বিহারের রাজ্যপাল থাকাকালীন পশুখাদ্য কেলেঙ্কারির জন্য মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদবের বিচারের অনুমতি দিয়েছিলেন তিনি সিবিআইকে (CBI)। এরপর ১৯৯৮ সালে ২৭ এপ্রিল তিনি পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হিসেবে নির্বাচিত হন। পশ্চিমবঙ্গের উনবিংশতম রাজ্যপাল হিসেবে তিনি একবছর কাজ করেছিলেন। ১৯৯৯ সালের ১৮ মে পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালের পদে আসীন ছিলেন তিনি। 

আখলাখউর রহমান ভারতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন ১৯৯৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০০৪ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত। খুবই অল্প সময়ের জন্য জরুরি ভিত্তিতে শূন্যস্থান পূরণের জন্য আখলাখউর পাঞ্জাব এবং রাজস্থানের রাজ্যপালের দায়িত্বও পেয়েছিলেন। ২০০৪ সালের ৩ নভেম্বর থেকে ঐ বছরই ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি পাঞ্জাবের রাজ্যপাল পদে বহাল ছিলেন। রাজস্থানের তৎকালীন রাজ্যপাল প্রতিভা পাটিল ইস্তফা দিয়ে দিলে আখলাখউরকে রাজ্যপালের শূন্যপদটি গ্রহণের অনুরোধ করা হয়। ২০০৭ সালের ২১ জুন  থেকে ২০০৭ সালেরই ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, যতদিন না শীলেন্দ্রকুমার সিং রাজ্যপালের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, ততদিন ড. কিদওয়াই রাজস্থানের রাজ্যপালের পদে বহাল ছিলেন। এছাড়াও ২০০৪ সালের ৭ জুলাই থেকে ২০০৯ সালের ২৭ জুলাই পর্যন্ত তিনি হরিয়ানার রাজ্যপাল হিসেবেও নির্বাচিত হয়েছিলেন। এভাবে বিভিন্ন রাজ্যের রাজ্যপাল হিসেবে মোট ১৭ বছর তিনি দায়িত্ব সামলেছেন, যা ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব রেকর্ড।   

কেবলমাত্র একজন রাজনীতিবিদই নন, তাঁকে একজন শিক্ষাবিদ বললেও ভুল হবে না। তিনি দিল্লি পাবলিক স্কুল সোসাইটির সদস্য এবং পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন। মেয়েদের শিক্ষা এবং স্বনির্ভরতা নিয়ে যথোপযুক্ত মর্যাদাসহ তাঁদের উন্নতির জন্য তিনি চিন্তা করেছিলেন। তিনি ছিলেন দক্ষিণ দিল্লির ‘উওমেনস পলিটেকনিক এবং ভোকেশনাল এডুকেশনাল সোসাইটি ফর উওমেন’-এর সভাপতি। এছাড়াও নয়াদিল্লির ‘ইন্সটিটিউট অফ মার্কেটিং অ্যাণ্ড ম্যানেজমেন্ট’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। জম্মু ও কাশ্মীর ব্যাঙ্কের পরিচালক হিসেবেও তিনি কাজ করেছেন একসময়। 

বিভিন্ন জাতীয় সংস্থা এবং কমিটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ড. আখলাখউর রহমান কিদওয়াই যার অধিকাংশই ছিল শিক্ষা বিষয়ক কমিটি বা প্রতিষ্ঠান। সেগুলির মধ্যে ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত তিনি ‘ন্যাশনাল কমিটি অন সায়েন্স অ্যাণ্ড টেকনোলজি’-র সদস্য ছিলেন। ‘ইণ্ডিয়ান কাউন্সিল অফ এগ্রিকালচারাল রিসার্চ’-এর কাউন্সিল এবং গভর্নিং বডির সদস্য ছিলেন তিনি ১৯৭০ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত, এছাড়া জম্মু-কাশ্মীরের ‘রিজিওনাল ইমব্যালেন্সেস এনকোয়ারি কমিশন’, ‘ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশন’ এবং ‘সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটিস রিভিউ কমিটি’র চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি ১৯৮৫-৮৬ সালে। ভারত সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রকের ‘রিভিউ কমিটি অন ইউনানি মেডিসিন’ দপ্তরের চেয়ারম্যান ছিলেন আখলাখউর। ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত ‘সিলেকশন বোর্ড অব সায়েন্টিস্টস পুল’-এর চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। এছাড়া আখলাখউর রহমান কিদওয়াই আরও যে যে সংস্থায় বা দপ্তরে কাজ করেছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – ‘সেন্ট্রাল অ্যাডভাইসারি বোর্ড অফ এডুকেশন’, ‘অনারারি ফেলো অফ দ্য ইন্সটিটিউশন অফ ইঞ্জিনিয়ারস্’, ‘দ্য আমেরিকান, ব্রিটিশ অ্যাণ্ড ইণ্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটিজ’, ‘আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অফ সায়েন্স’ ইত্যাদি। 

একজন সুন্নি মুসলমান হয়েও ধর্ম নিয়ে গোঁড়ামি কোনকালেই ছিল না আখলাখউর রহমান কিদওয়াইয়ের। হরিয়ানার রাজ্যপাল থাকাকালীন গুরু নানক খালসা কলেজে গুরু নানকের ৫৩৫তম প্রকাশ উৎসব এবং একই সঙ্গে কলেজের ৩৬তম প্রতিষ্ঠা দিবসের উৎসবে গিয়ে তিনি গুরু নানকের শান্তির বার্তা দিকে দিকে ছড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। গুরু নানককে স্মরণ করে তিনি আরও বলেছিলেন যে, নানক গোটা বিশ্বকে শিখিয়েছেন যে সমস্ত মানুষ সমান এবং ঈশ্বর বহুধাবিভক্ত নন, ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। 

এমন মানবদরদী, উচ্চশিক্ষিত এবং উদার চিন্তার রাজনীতিবিদ আখলাখউর রহমান কিদওয়াইকে জনসেবামূলক কাজের জন্য ভারত সরকার সম্মান জানাতে ভোলেনি। ২০১১ সালের ২৫ জানুয়ারি আখলাখউরকে ভারতবর্ষের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘পদ্মবিভূষণ’ প্রদান করা হয়েছিল। 

প্রবল শ্বাসকষ্টের জন্য ড. কিদওয়াইকে এসকর্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২০১৬ সালের ২৪ আগস্ট ৯৬ বছর বয়সে দীর্ঘ অসুস্থতার পরে দিল্লিতে আখলাখউর রহমান কিদওয়াইয়ের মৃত্যু হয়।

2 comments

আপনার মতামত জানান