আলেকজান্ডার পুশকিন

আলেকজান্ডার পুশকিন

বিখ্যাত রুশ কবি, নাটককার এবং ঔপন্যাসিক ছিলেন আলেকজান্ডার পুশকিন (Alexandar Pushkin)। রুশ সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি বলা হয় তাঁকে। এমনকি তাঁকে অনেকে আধুনিক রুশ সাহিত্যের প্রতিষ্ঠাতাও মনে করেন। টলস্টয় এবং দস্তয়েভস্কির মত সমান মর্যাদায় আসীন ছিলেন পুশকিন। মাত্র ১৫ বছর বয়সেই তিনি তাঁর প্রথম কবিতাটি প্রকাশ করেন এবং স্নাতক উত্তীর্ণ হওয়ার পরে ‘ওড টু লিবার্টি’ নামে তাঁর একটি বিখ্যাত রাজনৈতিক কবিতা তিনি পাঠ করেন জনগণের সামনে। সেই সময় রাশিয়ার জার প্রথম আলেকজান্ডার তাঁকে নির্বাসিত করেন। তাঁর এই কবিতাটি সেই সময় যথেষ্ট বিতর্কের উদ্রেক করেছিল। আলেকজান্ডার পুশকিন ‘বরিস গডুনভ’ নামে তাঁর একটি বিখ্যাত নাটক লিখেছিলেন। ১৮২৫ সাল থেকে ১৮৩২ সালের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে পুশকিনের লেখা ‘ইউজিন ওয়ানজিন’ কাব্যোপন্যাসটি প্রকাশিত হয়।

১৭৯৯ সালের ২৬ মে রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত মস্কোতে আলেকজান্ডার পুশকিনের জন্ম হয়। তাঁর পুরো নাম ছিল আলেকজান্ডার সের্গেইভিচ পুশকিন। তাঁর বাবার নাম ছিল সের্গেই লুভোভিচ পুশকিন এবং মায়ের নাম ছিল নাদেজদা ওসিপোভনা গ্যানিবাল। পুশকিনের প্রপিতামহ আব্রাহাম পেট্রোভিচ গ্যানিবাল ছিলেন আফ্রিকার রাজার দূত যাঁকে খুব অল্প বয়সেই কনস্ট্যান্টিনোপলের কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছিল অটোমান সুলতানের জন্য একটি উপহার হিসেবে এবং সেখান থেকে রাশিয়ার এক রাজনীতিবিদ তাঁকে মুক্ত করে নিয়ে যান সেন্ট পিটার্সবার্গে রাশিয়ার জার পিটার দ্য গ্রেটের কাছে। অনেকেই মনে করেন যে আব্রাহামের জন্ম হয়েছিল আজকের এরিত্রিয়ার সেরায়া প্রদেশের গেজা-ল্যামজা গ্রামে। তবে পরবর্তীকালে ঐতিহাসিক ও গবেষকরা আবিষ্কার করেছেন যে তাঁর জন্মস্থান ছিল মধ্য আফ্রিকায়, অধুনা ক্যামেরুনে। ফ্রান্সে সামরিক সংক্রান্ত বিষয়ে পড়াশোনা সমাপ্ত করে রেভাল নগরের গভর্নর নির্বাচিত হয়েছিলেন আব্রাহাম গ্যানিবাল। রাশিয়ার বহু অভিজাত পরিবারের মত পুশকিনের পরিবারও ফরাসি সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বাড়িতে একজন পরিচারিকা এবং ফরাসি ভাষার গৃহশিক্ষকের কাছ থেকে ফরাসি ভাষা শিখে নিয়েছিলেন পুশকিন। দশ বছর বয়স পর্যন্ত বেশিরভাগ সময় পুশকিন ফরাসিতেই কথা বলতেন। তবে তাঁর দিদা এরিনা রোডিওনোভনা এবং বাড়ির আরেক পরিচারিকার কাছ থেকে তিনি রাশিয়ান ভাষাটিও রপ্ত করে ফেলেন। পুশকিন তাঁর দিদাকে খুবই ভালবাসতেন, এমনকি নিজের মায়ের থেকেও বেশি। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি তাঁর প্রথম লেখা কবিতাটি প্রকাশ করেন। পরবর্তীকালে ১৮৩১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি নাটালিয়া গনচারোভাকে বিবাহ করেন পুশকিন। নাটালিয়া এবং পুশকিনের চার সন্তান ছিল যথাক্রমে মারিয়া, আলেকজান্ডার, গ্রেগরি এবং নাটালিয়া।

স্কুলের পড়াশোনা সমাপ্ত করে সেন্ট পিটার্সবার্গের কাছে জারস্কোয়ে সেলোতে অবস্থিত ইম্পেরিয়াল লাইসিয়ামে স্নাতক স্তরের পড়াশোনার জন্য তিনি ভর্তি হন। সেখানে ফরাসি বিপ্লবী জ্যঁ পল মারাটের ছোট ভাই ডেভিড মারার ছাত্র ছিলেন আলেকজান্ডার পুশকিন। স্কুলের পরে আলেকজান্ডার পুশকিন সেন্ট পিটার্সবার্গের প্রাণবন্ত ও বুদ্ধিদীপ্ত যুব সংস্কৃতিতে নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৮২০ সালে পুশকিন তাঁর প্রথম দীর্ঘ কবিতা প্রকাশ করেন যার নাম ছিল ‘রুসলান ও রুদমিলা’। লাইসিয়ামে পড়াকালীন তিনি আলেকজান্ডার পেট্রোভিচ কুনিতসিনের কান্টীয় উদারপন্থী মতবাদের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। আলেকজান্ডার পুশকিন নিজেকে ফরাসি বিপ্লবের যুক্তি-সাম্য-মৈত্রী ও স্বাধীনতার আলোয় উদ্ভাসিত করেছিলেন। ভলতেয়ারকে তিনি মনে করতেন বিশ্বে দর্শনের নতুন প্রদীপ প্রজ্জ্বলনকারী।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

ধীরে ধীরে সমাজ সংস্কারমূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতে শুরু করেন আলেকজান্ডার পুশকিন এবং সেইসাথে রাশিয়ার সাহিত্যিক বিপ্লবীদের অন্যতম মুখপাত্র হয়ে ওঠেন তিনি। ১৮১৭ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গের একটি বৈদেশিক অফিসে কাজে যোগ দেন আলেকজান্ডার পুশকিন। সেখানে ‘আরজামেস’ নামের একটি সাহিত্য-চক্রের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। পুশকিনের এই কাজ-কর্ম রাশিয়ার সরকারকে ক্ষুব্ধ করে তুলছিল। ফলে ১৮২০ সালের মে মাসে রাশিয়ার রাজধানী সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে তাঁকে স্থানান্তরিত করে দেওয়া হয়। তারপর আলেকজান্ডার পুশকিন ককেশাস এবং তারপরে ক্রিমিয়ায় চলে যান। ক্রমে প্রথমে কামিয়াঙ্কা এবং মলডাভিয়ায় চলে আসেন পুশকিন যেখানে তিনি রাজমিস্ত্রির কাজও করেছিলেন। ‘ফিল্কি ইটেরিয়া’ নামের একটি গুপ্ত সংগঠনে যোগ দেন পুশকিন যাদের কাজ ছিল গ্রিসে অটোমান রাজত্ব ধ্বংস করা এবং একটি স্বাধীন গ্রিস সাম্রাজ্য গড়ে তোলা। গ্রিসের বিপ্লবের আদর্শ পুশকিনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যখন যুদ্ধ শুরু হল সেই সময় থেকে একটি ডায়েরিতে জাতীয় বিপ্লবের দিনগুলির সমস্ত তথ্য লিপিবদ্ধ রাখতেন আলেকজান্ডার পুশকিন। এছাড়া এই সময়ের ছাপ তাঁর বেশ কিছু কবিতার মধ্যেও লক্ষ্য করা যায়। এই কবিতাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘দ্য ক্যাপটিভ অব ককেশাস’ , ‘দ্য রবার ব্রাদার্স’ (১৮২২) এবং ‘দ্য ফাউন্টেন অব বখছিসারায়’ (The Fountain of Bakhchisaray) ইত্যাদি। এর মধ্যে দ্য ক্যাপটিভ অব ককেশাস ও দ্য ফাউন্টেন অব বখছিসারায় তাঁর লেখা অত্যন্ত বিখ্যাত দুটি রোমান্টিক কবিতা হিসেবে পরিচিত। ১৮২৩ সালে পুশকিন ওডেসাতে চলে আসেন এবং সেখানে আবার সরকারের সঙ্গে বিরোধ বাধে তাঁর। সেই জন্য ১৮২৪ থেকে ১৮২৬ সাল পর্যন্ত তাঁর মায়ের গ্রামের বাড়ি মিখাইলোভস্কোয়েতে আলেকজান্ডার পুশকিন নির্বাসিত হন। এখানে থাকার সময় বহু স্মৃতিভারাতুর প্রেমের কবিতা লিখেছেন তিনি। এই কবিতাগুলি আলেকজান্ডার পুশকিন উৎসর্গ করেছিলেন মালোরোসিয়ার জেনারেল-গভর্নরের স্ত্রী এলিজাবেথা ভোরোন্টোভাকে। এরপরই তিনি তাঁর কাব্যোপন্যাস ‘ইউজিন ওয়ানজিন’ লিখতে শুরু করেন। ১৮২৫ সালে পুশকিন লেখেন ‘টু**’ নামের একটি কবিতা যা সম্ভবত আনা কার্নকে উৎসর্গীকৃত ছিল। অনেকে আবার মনে করেন এই কবিতাটি পুশকিন একজন দাস ওলগা কালাশনিকোভাকে উৎসর্গ করেছিলেন। ১৮২৫ সালে সংঘটিত ডিসেম্ব্রিস্ট বিদ্রোহের বিদ্রোহীদের কাছ থেকে আলেকজান্ডার পুশকিনের লেখা ‘ওড টু লিবার্টি’ কবিতাটি পাওয়ার পরে কর্তৃপক্ষ পুশকিনকে ডেকে পাঠায় মস্কোতে। জার প্রথম আলেকজান্ডারের কাছে পুশকিনের পরিবারের লোকজন এবং বন্ধু-বান্ধবেরা বারবার চিঠি পাঠিয়ে তাঁর নির্বাসন থেকে মুক্তি চেয়েছিল ১৮২০ সালে। এই সময় যখন তাঁকে মস্কোতে ডাকা হয়, একইভাবে তাঁরা চিঠি পাঠিয়ে জার প্রথম নিকোলাসের কাছে পুশকিনের মুক্তির দাবি জানায়। ক্রমে আলেকজান্ডার পুশকিন নির্বাসন থেকে মুক্তি পান এবং জারের অধীনে জাতীয় সংগ্রহশালার টিটুলার কাউন্সেলে কাজ করতে শুরু করেন তিনি। কিন্তু ডিসেম্ব্রিস্টদের সঙ্গে পুশকিনের কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে একথা ভেবে জার পুশকিনের সমস্ত লেখাপত্রের প্রকাশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন এবং অন্যত্র তাঁর স্বেচ্ছায় ভ্রমণও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।

মিখাইলোভস্কোয়েতে থাকার সময় তিনি তাঁর সবথেকে বিখ্যাত নাটক ‘বরিস গডুনভ’ রচনা করেন। লেখার পাঁচ বছর পরেও তা প্রকাশের অনুমতি পাননি পুশকিন। ২০০৭ সাল পর্যন্ত এই নাটকটি কোথাও মঞ্চস্থও হয়নি। ১৮২৫ থেকে ১৮২৯ সালের মধ্যে মধ্য রাশিয়ায় নির্বাসনে থাকাকালীন পোলিশ কবি অ্যাডাম মিকিউইচের সঙ্গে দেখা করেন আলেকজান্ডার পুশকিন। ১৮২৯-এ রুশ-তুর্কি যুদ্ধের সময় পুশকিন রুশ সেনাবাহিনীতে যুদ্ধরত বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে ককেশাসের মধ্য দিয়ে এরজুরুমে পৌঁছান। ১৮৩১ সালে আরেক বিখ্যাত উদীয়মান সাহিত্যিক নিকোলাই গোগোলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন পুশকিন। ১৮৩৬ সালে পুশকিন তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা ‘কনটেম্পোরারি ম্যাগাজিন’-এ গোগোলের বেশ কিছু লেখা প্রকাশ করেন।

আজও বিশ্ব সাহিত্যের বহু সমালোচক পুশকিনের বহু লেখার প্রশংসা করে থাকেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘বোঞ্জ হর্সম্যান’ নামের একটি কবিতা, ‘দ্য স্টোন গেস্ট’ নামের একটি নাটক, ‘দ্য ফল অফ ডন জুয়ান’ নামের একটি আখ্যান এবং কাব্যিক একাঙ্ক নাটক ‘মোৎজার্ট অ্যান্ড স্যালিয়েরি’। এছাড়াও আলেকজান্ডার পুশকিন ‘দ্য টেলস অফ দ্য লেট আইভান পেট্রোভিচ বেলকিন’ নামের ছোটগল্প সংকলনটির জন্যও বিখ্যাত। পুশকিনের লেখা ‘ইউজিন ওয়ানজিন’ উপন্যাসটির অনুবাদ করেছিলেন আরেক বিখ্যাত সাহিত্যিক ভ্লাদিমির নবোকভ।

১৯৩৭ সালে জারস্কোয়ে সেলো অঞ্চলের নাম রাখা হয় পুশকিনের নামানুসারে। রাশিয়ায় মস্কো এবং সেন্ট পিটার্সবার্গে আলেকজান্ডার পুশকিনকে উৎসর্গ করে মোট তিনটি সংগ্রহশালা স্থাপিত হয়েছে। এছাড়াও ১৯৭৭ সালে সোভিয়েত জ্যোতির্বিদ নিকোলাই চেরনিখ একটি বামন গ্রহ আবিষ্কার করেন যার নাম দেন তিনি ‘২২০৮ পুশকিন’।

১৮৩৭ সালের ২৯ জানুয়ারি মাত্র ৩৭ বছর বয়সে সেন্ট পিটার্সবার্গে থাকাকালীনই আলেকজান্ডার পুশকিনের মৃত্যু হয়।   

One comment

আপনার মতামত জানান