ভারতবর্ষের মাটিতে কালে-কালে এমন একেকজন নক্ষত্রসম মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে যাঁদের প্রতিভা ও মেধার আলোকচ্ছটায় মুছে গেছে অভিশপ্ত অন্ধকার। তেমনই একজন মানুষ ছিলেন আম্মেম্বল সুব্বা রাও পাই (Ammembal Subba Rao Pai)। পেশায় একজন তুখোড় আইনজীবী হলেও কেবল এক আইন ব্যবসায়ী হিসেবেই তাঁর পরিচয় সমাপ্ত করা চলে না। তাঁকে উনবিংশ শতাব্দীর ভারতবর্ষের একজন গুরুত্বপূর্ণ সমাজ ও শিক্ষাসংস্কারক বলতে হয়। আজ সারা ভারতে অত্যন্ত জনপ্রিয় যে কানাড়া ব্যাঙ্ক তার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সুব্বা রাও। কেবল তাইই নয় শিক্ষার মতো মূল্যবান সম্পদের গুরুত্ব অনুভব করে গঠন করেছিলেন কানাড়া হাইস্কুল। উনিশ শতকে নারীশিক্ষা প্রচলন নিয়ে দেশের কোনায় কোনায় যেভাবে আলোড়ন দেখা দিয়েছিল, সেই আন্দোলনেরই একজন শরিক হিসেবে যেন, সুব্বা রাও গার্লস স্কুলও নির্মাণ করেছিলেন। একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক মানুষ ছিলেন তিনি। আবার গৌড় সারস্বত ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের অগ্রগতিতে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তাঁকে মানবতার এক মূর্ত প্রতীক বললেও অত্যুক্তি হয় না।
১৮৫২ সালের ১৯ নভেম্বর ব্রিটিশ শাসনকালে ম্যাঙ্গালোরের নিকটবর্তী মুলকিতে একটি শিক্ষিত পরিবারে আম্মেম্বল সুব্বা রাও পাই-এর জন্ম হয়। তাঁর পিতা উপেন্দ্র পাই নিজেও পেশায় ছিলেন একজন আইনজীবী, তিনি ম্যাঙ্গালোরের কাছে মুন্সেফ কোর্টে আইনচর্চা করতেন। উপেন্দ্র পাইয়ের চার সন্তানের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন সুব্বা রাও পাই। ছোটবেলা থেকেই ভীষণ দুরন্ত স্বভাবের ছিলেন তিনি। পড়াশুনায় যদিও খুব যে মেধাবী ছিলেন তা বলা যয় না, বরং মাঝারি ধরনের ছাত্র ছিলেন। কিন্তু খেলাধুলা ছিল সুব্বা রাওয়ের প্রাণের জিনিস। ছোটবেলাতেই খেলাধুলাতে ছেলেমেয়েদের নেতা ছিলেন তিনি। নেতৃত্বদানের যে-একটি সহজাত ক্ষমতা রয়েেছে তাঁর মধ্যে, তা সেই অল্প বয়স থেকেই টের পাওয়া গিয়েছিল। প্রচন্ড দামাল একটি ছেলে হলেও তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ ছিল তিনি গুরুজনদের প্রতি ভীষণই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। পিতার প্রতি তাঁর ভক্তি ছিল অতুলনীয়।
সুব্বা রাও ম্যাঙ্গালোরের সরকারী উচ্চবিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। এটা মনে করা হয় যে, মায়ের মৃত্যুর পর তিনি পড়াশোনায় গভীরভাবে মনোযোগী হয়ে পড়েন তিনি এবং গুরুত্ব সহকারে লেখাপড়া করা শুরু করেন। সেই বিদ্যালয় থেকেই এফএ পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন তিনি। এরপর আরও উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য তাঁর পিতা তাঁকে মাদ্রাজে (বর্তমান চেন্নাই) পাঠিয়ে দেন। সেখানে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে কলাবিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে স্নাতক হওয়ার পর তিনি যোগ দিয়েছিলেন মাদ্রাজ ল কলেজে। পিতার পেশার কারণে আইনের প্রতি আকর্ষণ তো ছিলই, সঙ্গে একটি স্থায়ী রোজগারের উৎস, এই সবকিছুই তাঁকে আইনজীবী হওয়ার পথে এগিয়ে দিয়েছিল। এতই মনোযোগী, সিরিয়াস এবং মেধাবী হয়ে উঠেছিলেন পড়াশুনায় যে, ১৮৭৫ সালে ব্যাচেলর অব ল’-এর প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছিলন সুব্বা রাও। মাদ্রাজে এইচএইচ শেফার্ডের অধীনে শিক্ষানবিশীও করেছিলেন কিছুদিন। সেখানে তখন বিচারপতি ছিলেন মিস্টার হলওয়েল। এই জ্ঞানী এবং অভিজ্ঞ হলওয়েলের সংস্পর্শে আসা সুব্বা রাওয়ের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বললে অত্যুক্তি হয় না। তাঁর কাছ থেকে অনেককিছু শেখবার সুযোগ হয়েছিল সুব্বা রাওয়ের। হলওয়েল তাঁকে ইংল্যান্ডে যাওয়ারও পরামর্শ দিয়েছিলেন কিন্তু সুব্বা রাওয়ের সম্প্রদায়ের গোঁড়া পরিবেশে তখন তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
১৮৭৬ সালে পিতার মৃত্যুর পর সুব্বা রাও ফিরে আসেন ম্যাঙ্গালোরে। সেখানে পুরোদমে শুরু করেন আইনচর্চা। কিন্তু কেবল আইনজীবীর জীবন কাটিয়েই ক্ষান্ত হননি তিনি। দেশের গরীব মানুষের জন্য তাঁর ছিল বুকভরা দরদ। আবার হৃদয়ে দেশের প্রতি ছিল অগাধ ভালোবাসা। কয়েকজন বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামীর কাজকে, পথকে ভীষণভাবে সমর্থনও করতেন তিনি। ঋষি অরবিন্দ ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন, সুব্বা রাও যাঁকে খুব সম্মান করতেন। অরবিন্দের বিখ্যাত ‘যুগান্তর’ পত্রিকার নিয়মিত এবং একনিষ্ঠ পাঠক ছিলেন তিনি। তাঁর অফিসঘরে টাঙানো থাকত আর এক জাঁদরেল বিপ্লবী নেতা অশ্বিনীকুমার দত্তের ছবি। এই অশ্বিনীকুমার এমনই প্রভাবশালী একজন নেতা ছিলেন যে, তাঁর এক কথায় শহরের ব্যবসায়ীরা ইউরোপীয়দের কাছে এক গজ কাপড় বিক্রি করতেও অস্বীকার করতে পারত। হৃদয়ের দিক থেকে একজন দেশপ্রেমিক এবং কর্মের দিক থেকে একজন মানবতাবাদী ছিলেন আম্মেম্বল সুব্বা রাও পাই।
তবে তিনি শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতেন। জানতেন এই মূল্যবান সম্পদটিকে দ্বারেদ্বারে পৌঁছে দিতে না পারলে অশিক্ষার অন্ধকারে থেকে দারিদ্র্য কখনও দূর হতে পারে না। ১৮৭৬-এ ম্যাঙ্গালোরে এসে সেখানে দশবছর আইনচর্চা করে তিনি ফিরে যান মাদ্রাজে। মাদ্রাজে থাকাকালীন চারজন শিক্ষকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তাঁর। সেই চার শিক্ষক ১৮৯১ সালে তাঁর কাছে ম্যাঙ্গালোরে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব নিয়ে এলে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি সুব্বা রাও। দক্ষিণ কন্নড়ের যুবকদের প্রাচীন সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সঙ্গে মিশ্রিত আধুনিক শিক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্য নিয়ে সুব্বা রাও কানাড়া হাইস্কুল অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি জানতেন জ্ঞানের আলোতেই দেশের মানুষ উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে পারে। দুবার না ভেবে, ম্যাঙ্গালোরে পিতা উপেন্দ্র পাইয়ের দান করা ২২ একর জমির ওপর গড়ে তুললেন কানাড়া হাই স্কুল। একথায় তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতির মূল চাবিকাঠি হল শিক্ষা। তিনি বুঝেছিলেন শিক্ষা কেবল পুরুষ সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। নারীরা শিক্ষিত না হলে এক বিরাট বড় অসম্পূর্ণতা থেকে যাবে। উনিশ শতকের শেষদিকে তখন বাংলাদেশ-সহ দেশের কোনায় কোনায় নারীশিক্ষা, নারীজাগরণের দামামা বেজেছে। যদিও রক্ষণশীল সমাজের গোঁড়ামি তখনও বেশ প্রবল। সেই লড়াইয়ের শরিক হয়েই যেন সুব্বা রাও পাই ১৮৯৪ সালে কানাড়া গার্লস হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই সময়ে নারী শিক্ষার প্রতি মানুষের প্রচলিত মূল্যবোধ এবং মনোভাব বিবেচনা করলে বোঝা যাবে এটি একটি বৈপ্লবিক পদক্ষেপ ছিল। তিনি এও বুঝেছিলেন যে পেশাগত ও কারিগরি কোর্সে ব্যাপক সাধারণ ও উচ্চশিক্ষা ছাড়া মানুষের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তাঁর অসামান্য প্রচেষ্টার কারণে, বহু যুবককে তখন ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মেডিকেল উভয় ক্ষেত্রেই উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হতে দেখা গেছে।
তবে সুব্বা রাও পাইয়ের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ছিল মানুষকে একটি অর্থনৈতিক অবলম্বনের ব্যবস্থা করে দেওয়া৷ দরিদ্র মানুষের জন্য খুব উদ্বিগ্ন বোধ করতেন তিনি সর্বদা। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে যখন আর্বুথনট কোম্পানি যা, জনগনের থেকে আমানত সংগ্রহ করে এবং ঋণ দেয়, আর্থিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হল তখন ১৯০৬ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কানাড়া হিন্দু পার্মানেন্ট ফান্ড লিমিটেড। অবশ্য এটি প্রতিষ্ঠার পিছনে অন্যান্য ব্যাঙ্কের উচ্চ সুদের হারে নাজেহাল গরীব মানুষদের বিপন্ন অবস্থাও ইন্ধন জুগিয়েছিল৷ এই প্রতিষ্ঠানই পরবর্তীকালে কানাড়া ব্যাঙ্কে পরিণত হয়েছিল৷ এটি প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্যই ছিল সম্প্রদায়ের মানুষজন যাতে স্ব-সহায়তার জন্য নিজস্ব সম্পদ নিরাপদে একত্রিত করে রাখতে পারে। এই অভিপ্রায় নিয়েই গঠিত কানাড়া ব্যাঙ্ক আজ সারাদেশে বিপুল জনপ্রিয়।
তিনি মুষ্টি ফান্ড নামে মহিলাদের জন্য একটি তহবিল গঠন করেছিলেন তিনি। যেখানে মহিলারা প্রতিদিন একমুঠো করে শস্য রাখতেন এবং তারপর বিদ্যালয়ের কার্যক্রমে মনোনিবেশ করতেন। এইভাবে মহিলাদের স্বাবলম্বী হওয়ার পথ দেখিয়েছিলেন তিনি। দারিদ্র্য দূরীকরণের এবং দুঃসময়ের মোকাবিলা করার এটি ছিল এক অভিনব পন্থা।
এছাড়াও তাঁর কর্মকাণ্ডের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল জিএসবি অর্থাৎ গৌড় সারস্বত ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের অগ্রগতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন। তিনি এই সম্প্রদায়ের ছেলেদের শিক্ষার জন্য ‘পুওর বয়েজ এডুকেশন ফান্ড’ গঠন করেছিলেন। পরবর্তীতে ১৯০৯ সালের ১লা আগস্ট ভুবনেন্দ্র হলে অনুষ্ঠিত জিএসবি সম্প্রদায়ের একটি সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে এটি এএসআরপি মেমোরিয়াল ফান্ডে রুপান্তরিত হয়েছিল। এছাড়াও জিএসবি সম্প্রদায়ের সহায়তার জন্য প্রতিষ্ঠিত গৌড় সারস্বত ব্রাহ্মণ পরিষদের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন সুব্বা রাও পাই।
দীর্ঘদিন গেঁটেবাতের সমস্যায় ভুগেছিলেন সুব্বা রাও পাই। বারংবার এই গেঁটেবাতের আঘাতের জীর্ণ হয়ে পড়ে অবশেষে ১৯০৯ সালের ২৫ জুলাই আকস্মিকভাবে আম্মেম্বল সুব্বা রাও পাই-এর মৃত্যু হয়।
2 comments