উনিশ শতকের ভারতের সমাজসংস্কার আন্দোলনের এক অন্যতম আইরিশ সমাজসেবী ও শিক্ষাবিদ ছিলেন অ্যানি বেসান্ত (Annie Besant)। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। সমাজসেবার পাশাপাশি তিনি একইসঙ্গে সুবক্তা ছিলেন। আয়ারল্যাণ্ড এবং ভারত দুই দেশেরই স্ব-শাসন এবং সার্বভৌমত্ব চাইতেন অ্যানি বেসান্ত। দরিদ্র মানুষদের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করা, তাদের জীবনযাপনের মানোন্নয়ন ঘটানো এবং দরিদ্র জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার করার লক্ষ্যে বহু প্রচেষ্টা ছিল তাঁর। ইংল্যাণ্ডে দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে অ্যানি বেসান্ত নাস্তিকতা এবং বস্তুবাদের প্রচারক ছিলেন। ফেবিয়ান সোসাইটি এবং মার্ক্সিস্ট সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক ফেডারেশন-এর অন্যতম মুখ্য বক্তা ছিলেন তিনি। ১৮৯০ সালে হেলেনা ব্লাভাটস্কির সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের পর থেকেই ধর্মতত্ত্বের প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়েন তিনি এবং থিওসফিক্যাল সোসাইটির একজন সদস্য হন অ্যানি বেসান্ত। ১৯০৭ সালে থিওসফিক্যাল সোসাইটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের একজন সদস্য হিসেবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় হোমরুল লিগ চালু করে ভারতে গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলন করেন তিনি। এর ফলেই ১৯১৭-তে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন অ্যানি বেসান্ত। আমৃত্যু ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য জনমত গঠনের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তিনি।
১৮৪৭ সালের ১ অক্টোবর লণ্ডনে একটি উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারে অ্যানি বেসান্তের জন্ম হয়। তাঁর আসল নাম ছিল অ্যানি উড। তাঁর বাবার নাম উইলিয়াম বার্টন পার্সে উড এবং মায়ের নাম এমিলি রোচে মরিস। তাঁদের আদি নিবাস ছিল ইংল্যাণ্ডের ডেভনে। তাঁর বাবা ডাবলিনের ট্রিনিটি কলেজ থেকে মেডিকেল ডিগ্রি পেয়েছিলেন। তাঁর মা ছিলেন একজন আইরিশ ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তাঁর বাবা মারা যান, সেই সময় তাঁর পরিবারের আর্থিক সংগতি একেবারে তলানিতে এসে ঠেকে। হ্যারো স্কুলে ছেলেদের একটি হস্টেল চালিয়ে তাঁর মা তখন পরিবারের অন্নসংস্থানের দায়িত্ব নেন। অ্যানির দায়িত্ব নিতে না পেরে তাঁর মা তার এক বন্ধু এলেন ম্যারিয়টের হাতে অ্যানির লালন-পালনের ভার দেন। ছোটবেলা থেকেই তাঁকে সামাজিক দায়িত্বের কথা শিখিয়েছিলেন তাঁর মা এবং একজন স্বাধীনচেতা স্বাবলম্বী নারীর ক্ষমতার ধারণা সম্পর্কে অবগত করেছিলেন তাঁকে। সমগ্র ইউরোপে ঘুরে ঘুরে রোমান ক্যাথলিক ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন অ্যানি বেসান্ত। ১৮৬৭ সালে কুড়ি বছর বয়সে ওয়াল্টার বেসান্তের ছোটো ভাই ফ্র্যাঙ্ক বেসান্তের সঙ্গে বিবাহ হয় তাঁর। পরে কিছুদিনের মধ্যেই ফ্রাঙ্ক লিঙ্কনশায়ারে সিবসে অঞ্চলের ভাইসার পদে অধিষ্ঠিত হন এবং অ্যানিও সিবসেতে চলে আসেন। আর্থার এবং মার্বেল নামে তাঁদের দুই সন্তানও হয়। কিন্তু স্বামী ফ্রাঙ্কের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ ঘটে অর্থ উপার্জন ও অ্যানির স্বাধীনতার ব্যাপারে। সে কালে বিবাহিত নারীর কোনো সম্পত্তির অধিকার ছিল না। তাই অ্যানি টুকটাক প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখে যা উপার্জন করতেন, সবই ফ্র্যাঙ্ক নিয়ে নিতেন। ক্রমে খামারের শ্রমিক-কৃষকদের সমর্থন করলে উভয়ের মধ্যে রাজনৈতিক কারণে বিচ্ছেদ ঘটে যায়। তার উপর ফ্র্যাঙ্কের কমিউনে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব অস্বীকার করে ১৮৭৩ সালে সংসার ছেড়ে অ্যানি বেসান্ত চলে আসেন লণ্ডনে। কেবল মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন অ্যানি।
১৮৮০-এর দশকের শেষ দিকে অ্যানি বার্কবেকের সাহিত্য ও বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেন। কিন্তু সেখানে তাঁর ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কার্যকলাপ প্রতিষ্ঠানের আধিকারিকদের কাছে আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বেসান্ত চিন্তার স্বাধীনতা, নারীর অধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা, জন্ম নিয়ন্ত্রণ, শ্রমিকের অধিকারের দাবিতে সংগ্রাম করে গিয়েছেন আজীবন। ‘ন্যাশনাল সেকুলার সোসাইটি’ এবং ‘সাউথ প্লেস এথিকাল সোসাইটি’-র সদস্য ছিলেন তিনি। বিবাহ বিচ্ছেদ হলেও প্রথম দিকে তাঁর ছেলে মার্বেলকে মাঝেমধ্যেই নিজের কাছে এনে রাখতেন অ্যানি, স্বামী ফ্র্যাঙ্ক এতে কোনো বাধা দেননি। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর মধ্যেকার সমস্ত পুরাতনী বিশ্বাস-সংস্কারের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুললেন অ্যানি। গির্জার পোপতন্ত্র যেভাবে মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে, তার বিরুদ্ধাচরণ করে লেখালিখি শুরু করেন অ্যানি বেসান্ত। এনএসএস-এর পত্রিকা ‘ন্যাশনাল রিফর্মার’-এ নিয়মিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখে খুব সামান্য আয় হতে থাকে তাঁর। খ্রিস্টান ধর্মের বিলোপ ঘটিয়ে পৃথিবী তথা সকল দেশকে ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে গড়ে তোলার কথা প্রচার করা হতো এই পত্রিকায় এবং এই পত্রিকার তরফে অ্যানি বেসান্তকে বক্তা নির্বাচিত করা হয়। কয়েকদিনের মধ্যেই সুবক্তা অ্যানির জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। উন্নয়ন, সংস্কার এবং স্বাধীনতার কথাই তিনি সমগ্র দেশ জুড়ে নিজের বক্তৃতার মাধ্যমে প্রচার করতে থাকেন। চার্লস ব্র্যাডলাফের সঙ্গে অ্যানির বন্ধুত্ব হয়। ক্রমে তাঁর বাড়িতেই নিজের মেয়েকে নিয়ে থাকতে শুরু করেন বেসান্ত। জন্ম নিয়ন্ত্রণের প্রচারক চার্লস নর্টনের লেখা ‘ফ্রুটস অফ ফিলোজফি’ নামে একটি বই ব্র্যাডলাফ এবং বেসান্ত প্রকাশ করেন ১৮৭৭ সালে। তারপর থেকেই তাঁদের দুজনেরই খ্যাতি শীর্ষে পৌঁছায়। এই বইতেই প্রথম বলা হয়, শ্রমিক পরিবারের সদস্যদের সর্বাগ্রে নিজেদের সক্ষমতা ও সামর্থ্যের ব্যাপারে স্বচ্ছ ধারণা নিয়ে আলোচনা করে সন্তান ধারণ করা উচিত। পরিবারের আয়তন সীমায়িত রাখা যায় কীভাবে সে বিষয়ে এই বইতে দীর্ঘ আলোচনা করা হয়। এই প্রকাশের অপরাধে ব্র্যাডলাফ ও বেসান্ত উভয়কেই গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলেও কিছুদিন পরে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়। জন্ম নিরোধকের প্রচারের জন্য আগে যে শাস্তি নির্ধারিত ছিল তার বিরুদ্ধে বেসান্তের হয়ে বিচারসভায় সওয়াল জবাব করেছিল ম্যালথুসিয়ান লিগ। বিচারে তাঁদের কারাদণ্ড হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু প্রযুক্তিগত একটা বিষয়ে কিছুতেই এই অপরাধ প্রমাণ না করতে পারায় তাঁদের কারাবাস হয়নি। ১৮৮১ সালের ৬ মার্চ হাম্বারস্টোন গেটে লেসিস্টার সেকুলার সোসাইটির নতুন প্রেক্ষাগৃহে বক্তব্য রাখেন অ্যানি বেসান্ত।
১৮৯৩ সালে বিশ্ব ধর্মমহাসভায় থিওসফিক্যাল সোসাইটির হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন অ্যানি বেসান্ত। সেখানেই স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর। ১৮৯৫ সালে শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে বৌদ্ধ স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তাঁর। বিখ্যাত নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ অ্যানি বেসান্তকে ইংল্যাণ্ডের সর্বশ্রেষ্ঠ বক্তা বলে মনে করতেন। বার্নার্ড শ’য়ের প্রেরণাতেই ফ্যাবিয়ান সোসাইটিতে যোগ দেন তিনি। ১৮৮৭ সালে লণ্ডনে সম্মিলিত বেকার যুবসমাজের একটি প্রতিবাদ সভায় বক্তব্য রাখেন অ্যানি বেসান্ত। ১৮৮৮ সালে দেশলাই কারখানার মহিলা কর্মীদের হয়ে দাবি আদায়ের ধর্মঘটে নেতৃত্ব দেন এবং নিজের মূল্যবান বক্তব্য রাখেন তিনি। এমনকি সেই কারখানার শ্রমিকদের একটি সংগঠিত ইউনিয়ন গড়ে তুলতেও সাহায্য কররেন অ্যানি। ১৮৮৮ সালে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্য হন অ্যানি বেসান্ত। ১৮৮৯ সালে লণ্ডনের বন্দর-কর্মীদের ধর্মঘটেও নেতৃত্ব দেন তিনি।
এইচ. পি. ব্লাভাটস্কির সঙ্গে দেখা করার পর তাঁরই অনুপ্রেরণায় থিওসফির ধারণায় আকৃষ্ট হন বেসান্ত। থিওসফির সঙ্গে জড়িত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ফ্যাবিয়ান সোসাইটি এবং মার্কসবাদীদের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেন। ১৮৯১ সালে ব্লাভাটস্কি মারা গেলে তাঁকেই থিওসফিক্যাল সোসাইটির প্রধান দায়িত্ববাহক হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। ১৮৯৩ সালে থিওসফিক্যাল সোসাইটির সদস্য হিসেবে প্রথম ভারতে আসেন তিনি। ভারতের চেন্নাইতে এই সঙ্ঘের মূল কেন্দ্র ছিল। ভারতে এসে ১৯১১ সালে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় মদন মোহন মালব্যের এবং তাঁর সঙ্গে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অ্যানি বেসান্তের যথেষ্ট অবদান ছিল। ১৯০২ সালের শেষ দিকে ভারতের স্বশাসনের দাবিতে আন্দোলনে যোগ দেন তিনি এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সদস্যপদ অর্জন করেন। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ‘নিউ ইণ্ডিয়া’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে ভারতের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারকে কটাক্ষ করেন তিনি। ১৯১৬ সালে লোকমান্য তিলকের সঙ্গে সর্বভারতীয় হোম রুল লিগ স্থাপন করেন অ্যানি বেসান্ত। সমগ্র ভারতের নানা স্থানে এই সংস্থার শাখা খোলা হয় এবং সারা বছর ধরেই নানাবিধ কর্মকাণ্ড চলতে থাকে। ১৯১৭ সালে বেসান্তকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ এবং একটি পার্বত্য অঞ্চলের কারাগারে বন্দী করে রাখে। ঐ বছরই সেপ্টেম্বর মাসে বেসান্ত জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতির পদে অধিষ্ঠিত হন।
১৯৩৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ৮৫ বছর বয়সে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির অধ্যারে অ্যানি বেসান্তের মৃত্যু হয়।
One comment