কামাখ্যা

সতীপীঠ কামাখ্যা

কামাখ্যা অসমের গুয়াহাটি থেকে অনতিদূরেই অবস্থিত। এটি একান্ন সতীপীঠের অন্যতম এবং চার আদি শক্তিপীঠের একটি।  পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে সতীর যোনিভাগ এখানে পড়েছিল। এই কারণে এই পীঠকে যোনিপীঠও বলা হয়। এটি হিন্দুদের পবিত্র তীর্থক্ষেত্র। এখানে অধিষ্ঠিত দেবী কামাখ্যা এবং ভৈরব হলেন উমানন্দ। এই মন্দির চত্বরে দশমহাবিদ্যা অর্থাৎ ভুবনেশ্বরী, বগলামুখী, ছিন্নমস্তা, ত্রিপুরাসুন্দরী, তারা, কালী, ভৈরবী, ধূমাবতী, মাতঙ্গী ও কমলা এই দশ দেবীর মন্দিরও রয়েছে।

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে মাতা সতী নিজের বাপের বাড়িতে বাবার কাছে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে সেখানেই দেহত্যাগ করেছিলেন। মাতা সতীর দেহত্যাগের খবর মহাদেবের কাছে পৌঁছতেই মহাদেব সেখানে উপস্থিত হন। সতীর মৃতদেহ দেখে ক্রোধে উন্মত্ত মহাদেব সেই দেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য চালু করেন। মহাদেবের তাণ্ডব নৃত্যে পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কায় শ্রীবিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দ্বারা মাতা সতীর দেহ একান্নটি খণ্ডে খণ্ডিত করেন। সেই দেহখন্ডগুলোই যে যে স্থানে পড়েছিল সেখানে একটি করে সতীপীঠ প্রতিষ্ঠা হয়। বলা হয় তার যোনিদেশটি কামরূপের নীলগিরি পর্বতে পতিত হলে তার ভার সহ্য করতে না পেরে কম্পিত পর্বত ক্রমশ পাতালে প্রবেশ করতে থাকে। তখন মা কামাখ্যা সেই ভার বহনের দায়িত্ব নেন। বলা হয় যে স্থানে দেবীর যোনিদেশটি পড়েছিল, তার নাম কুব্জিকা। বর্তমানে সেই জায়গাটিই কামাখ্যা নামে পরিচিত।

পুরাণের আরও এক বর্ণনা অনুযায়ী অসুর রাজ নরকাসুর শিকারে বেরিয়ে এক সন্ধ্যায় কামাখ্যা দেবীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কামাখ্যা দেবী তাতে সম্মতি দেন। কিন্তু প্রস্তাব রাখেন ঐ গিরি শৃঙ্গে (কামরূপের নীল পর্বত) অবতরণের জন্য চারদিক দিয়ে চারটি সিঁড়ি সহ ঐ পাহাড়ে একটি বিশ্রামাগার গড়ে দিতে হবে এবং এই কাজ আগামী সূর্যোদয়ের আগেই করতে হবে। শর্তে রাজী হয়ে অসুররাজ সৈন্য সামন্ত নিয়ে সব কাজ সম্পন্ন করলেন কিন্তু কাজ শেষ হবার ঠিক আগের মুহূর্তে কামাখ্যা দেবীর সৃষ্ট মায়াবী মোরগ রাত্রি সমাপ্তির ঘোষণা করলে নরকাসুর রাত শেষ হয়ে গেছে ভেবে কাজে বিরতি দিলেন। পরে আসল কথা জানতে পেরে ভীষণ ক্রোধে নরকাসুর মোরগকে বধ করেন। পরে শ্রী বিষ্ণুর সাহায্যে কামাখ্যা নরকাসুরকে বধ করেন। সেই অনুযায়ী নরকাসুরই এই কামাখ্যা মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। অন্য মতে কামাখ্যা মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা কামদেব।

একটি বর্ণনা অনুযায়ী আবার কোচবিহারের বিশ্বসিংহ স্বপ্নাদেশে কামরূপের নীলপর্বতে অবস্থিত কামাখ্যা মন্দির পুনঃ নির্মাণ করে পূজা আরম্ভ করেন। একসময় তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা রাজাদের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে পথ হারিয়ে এই নীলপর্বতের নিচে উপস্থিত হন। কথিত আছে দেবী স্বয়ং বৃদ্ধার ছদ্মবেশে রাজাকে পূজার কথা বলেন। দেবী জানান এখানে পূজা দিলে রাজার মনকামনা পূর্ণ হবে। দেবীর আশীর্বাদে তিনি যুদ্ধে জয়লাভ করেছিলেন। যুদ্ধ শেষে পণ্ডিতদের পরামর্শে তিনি ঐ জায়গায় মন্দির নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে রাজা নরনারায়ণ এই মন্দিরের পুনঃ নির্মাণ করান। কিন্তু তিনি শুনেছিলেন সন্ধ্যাবেলায় পূজার সময় মা কামাখ্যা নাকি দর্শন দেন। তিনি পূজার সময় দেবীর দর্শনলাভের আশায় আসেন। পূজার সময় প্রচণ্ড আলোয় তাঁর চোখ ঝলসে যায় এবং দেবী তাঁকে অভিশাপ দেন যদি রাজা বা তাঁর পরিবারের কেউ আবার এই মন্দিরের কাছে আসেন, তাহলে তাঁদের বংশলোপ হবে। সেই থেকে কোচবিহারের রাজপরিবারের কেউ এই মন্দিরে আসেন না।

অসমের কামরূপ জেলার কামাখ্যাধাম হল উত্তরপূর্ব ভারতের বিখ্যাত সতীপীঠ। অসমের রাজধানী হল গুয়াহাটি। এই গুয়াহাটি থেকে অনতিদূরেই ব্রহ্মপুত্র নদের গা ঘেঁষে নীলাচল পাহাড়ের ধারে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত এই কামাখ্যাধাম। বিশ্বাস করা হয় এখানে দেবাদিদেব মহাদেব সর্বদা পার্বতীর সাথে বাস করেন। এই মহাপীঠ অতি গোপনীয় বলেও উল্লেখ করা আছে। ভক্তদের বিশ্বাস এই যোনিপীঠ দর্শন, স্পর্শ তথা জলস্বরূপ পান করলে মানুষ সমস্ত রকম ঋণমুক্ত হয়। এই তীর্থে মহামায়া কুমারীরূপে পুজিত হন। বিশ্বাস করা হয় এখানে তিনিও সাধারণ নারীর মতই ঋতুমতী হন। তাই অম্বুবাচীর তিনদিন মন্দির সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে।

কামাখ্যা মন্দিরে চারটি কক্ষ আছে। গর্ভগৃহ ও তিনটি মণ্ডপ। মণ্ডপগুলির স্থানীয় নাম চলন্ত, পঞ্চরত্ন ও নাটমন্দির। গর্ভগৃহটি ছোটো ও গুহার আকৃতিবিশিষ্ট। এখানে কোনো মূর্তি নেই। শুধু যোনি-আকৃতিবিশিষ্ট পাথর ও ভূগর্ভস্থ প্রস্রবন আছে। এই ভূগর্ভস্থ প্রস্রবনের জল বেরিয়ে এই গর্তটি সবসময় ভর্তি রাখে। এই গর্তটিই দেবী কামাখ্যা নামে পূজিত হয়। মন্দিরের তিনটি প্রধান কক্ষ। মাঝের কক্ষটি বর্গাকার যেখানে দেবীর একটি ছোটো মূর্তি আছে। যদিও এই মূর্তিটি পরবর্তীকালে স্থাপিত হয়েছে। এই কক্ষের দেওয়ালে বিভিন্ন দেবদেবী ও তাদের সম্পর্কে শিলালেখা খোদিত আছে। এখান থেকে মূল গর্ভগৃহে যাওয়া যায়।

প্রতিবছর অম্বুবাচী মেলার সময় কামাখ্যা দেবীর ঋতুমতী হওয়ার ঘটনাকে উদযাপন করা হয়। এই সময় মূল গর্ভগৃহের প্রস্রবনের জল লাল হয়ে থাকে। বিশ্বাস করা হয় তখন দেবী রজঃস্বলা হন। তাই মন্দির তিন দিন বন্ধ থাকে এবং মন্দিরে প্রবেশ করা সকলের জন্য নিষিদ্ধ থাকে। বার্ষিক অম্বুবাচী মেলা অনুষ্ঠানে এখানে প্রচুর ভক্তের ভিড় জমে ওঠে। ওই সময় বড় বড় তান্ত্রিক সাধুরাও ওখানে আসে সিদ্ধি লাভের জন্য।

কামাখ্যা দেবী হলেন তন্ত্র সাধনার দেবী। তাই কামাখ্যা হল তান্ত্রিকদের সাধনাস্থল। আর জায়গাটির সাথে তন্ত্রের নাম থাকায় কামাখ্যা নিয়ে বিভিন্ন গল্প প্রচলিত ছিল। সেই গল্পে বলা হয় এ নাকি এক ভয়ংকর জায়গা, জাদুটোনা, তন্ত্র-মন্ত্রের দেশ। ওখানের আশেপাশে জঙ্গলে আর নির্জন পথে নাকি দেখা যায় ভূত-পেত্নী আর ডাকিনী-যোগিনীর।। কামরূপ-কামাখ্যা নারী শাসিত পাহাড়ী ভূ-খন্ড। সেখানকার নারীরা ছলাকলা কামকলায় নাকি ভীষণ পারদর্শী। কামরূপ-কামাখ্যার ডাকিনী নারীরা পুরুষদের মন্ত্রবলে ভেড়া বানিয়ে রাখে। তবে এই গল্পকথা গুলো কতটা সত্যি তা জানা নেই। কিন্তু এটা সত্যি যে কামাখ্যা তান্ত্রিকদের কাছে পবিত্র তীর্থ। শুধু তান্ত্রিকদের কাছেই কেন, হিন্দুদের কাছেই কামাখ্যা হল অত্যন্ত পবিত্র তীর্থ।

তথ্যসূত্র


  1. সত্যের সন্ধানে ৫১ পীঠ - হিমাংশু চট্টোপাধায়, সৃষ্টিতীর্থ কামাখ্যা, পাতা নং ১১৩ - ১২৮
  2. ভাগ্যবার্তা ২০১৪, ফেব্রুয়ারি সংখ্যা, পাতা - ৪৮
  3. ভাগ্যকণ্ঠ ২০১৪, জুলাই সংখ্যা, পাতা-৪২
  4. ভাগ্যফল ২০১৫,  মে সংখ্যা, পাতা ৫০
  5. জ্যোতিষ ও নক্ষত্র ২০১৭, জুন সংখ্যা, পাতা ৮৩
  6. https://en.wikipedia.org/
  7. https://www.thestatesman.com/
  8. https://www.thedivineindia.com/

 

One comment

আপনার মতামত জানান