অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি

অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি

আঠারো-উনিশ শতকের বঙ্গসংস্কৃতির একটি অন্যতম ধারা ছিল কবিগান। জমিদার বা বিত্তশালী বাবু-ব্যক্তির প্রাঙ্গণে কবি লড়াইয়ের আসর সেই সময়কার এক উল্লেখযোগ্য বিনোদন ছিল। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে কবিগানের আসরে আবির্ভূত হয়ে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন যে গোরা সাহেব, তিনি জনমানসে ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ নামে পরিচিত ছিলেন। যদিও তাঁর জন্মগত নাম হেনসম্যান অ্যান্টনি (Hensman Anthony)। কবিগানের একজন জনপ্রিয় প্রতিভা ছিলেন বলে, অ্যান্টনি কবিয়াল হিসেবেও পরিচিতি লাভ করেছিলেন তিনি। দেবী দুর্গা এবং মা কালীকে উদ্দেশ্য করে ভক্তিমূলক গীত রচনার জন্য সেসময় বিখ্যাত ছিলেন অ্যান্টনি। তবে কেবলমাত্র ভক্তের আকুতি ও বিহ্বলতাই নয়, তাঁর বেশ কিছু গানে সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতামুক্ত উদারতা এবং মানবতার কথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। এক হিন্দু বিধবা রমণীকে তিনি বিবাহ করেছিলেন বলেও শোনা যায়। কবিগানের লড়াইতে বিখ্যাত কবিয়াল ‘ভোলা ময়রা’কে পরাজিত করায় তাঁর নাম দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল।

জন্মসাল নিয়ে দ্বিধা থাকলেও অনুমান করা হয় ১৭৮৬ সালে পর্তুগিজ বংশোদ্ভূত হেনসম্যান অ্যান্টনির জন্ম হয়। যেহেতু তাঁর সম্পর্কে, বিশেষত তাঁর পূর্বজীবন সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায়নি, সে কারণে অ্যান্টনির জন্মস্থান নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতান্তর রয়েছে। তবে উনিশ শতকের প্রথম দিকে তিনি চন্দননগরের ফরাসডাঙ্গার ফরাসি উপনিবেশে বসবাস করতেন৷ আসলে তাঁর বাবা পর্তুগিজ একজন ব্যবসায়ী হিসেবে এখানে আসেন এবং ফরাসডাঙ্গায় বসবাস শুরু করেন। জানা যায় লবণের একটি পারিবারিক ব্যবসা ছিল তাঁদের। প্রভূত বিত্তশালী মি. কেলির ভাই ছিলেন অ্যান্টনি। তাঁর ঠাকুরদাও ছিলেন যথেষ্ট প্রভাবশালী এক ব্যক্তি যিনি নাকি জমিদার সাবর্ণ চৌধুরীদের পক্ষ নিয়ে জব চার্নকের সঙ্গে সমানে-সমানে পাল্লা দিতেন। উচ্চতায় বেশ দীর্ঘ এবং মুখটি বাজপাখির মতো তীক্ষ্ণ ছিল অ্যান্টনির৷ তিনি নিজে একজন ভাল ব্যবসায়ীও ছিলেন।

আঠারো-উনিশ শতকের নাগরিক বিত্তবান সমাজে কবিগান ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়। কবিগানের আসর সাধারণত দুই বিবদমান পক্ষকে কেন্দ্র করেই জমে উঠত। গানের মাধ্যমে দুই পক্ষের মধ্যে বাদ-প্রতিবাদ উত্তর-প্রত্যুত্তরের পালা ততক্ষণ পর্যন্ত চলত, যতক্ষণ না একটি পক্ষ আর জবাব না পেয়ে কুপোকাত হয়ে পড়ছে। কবিগানের গায়কেরা সাধারণত ‘কবিয়াল’ নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁদের চটজলদি গান বেঁধে দেওয়ার জন্য যে লোকটি থাকতেন, তাঁকে বলা হত বাঁধনদার। সাধারণত কবিয়ালদের একটি করে দল থাকত। মূল গায়ক গাইতেন এবং তাঁর দলের সাঙ্গ-পাঙ্গরা বিশেষ বিশেষ লাইনের বা শব্দের পুনরাবৃত্তি করে ধুয়ো দিতেন। ঢোল, কাঁসি ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র সহযোগে দুই দলের এই সঙ্গীতযুদ্ধ সত্যিই দেখবার মতো ছিল। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বিচরণ করে কবিয়ালরা কবির লড়াইতে অংশ নিতেন। এক অর্থে যেন তাঁরা কবিতা ফেরি করে বেড়াতেন, সেকারণেই তাঁদের কবিওয়ালা বলা হত। কবিওয়ালা থেকে কবিয়াল। কোনও অভিজাত ও বিত্তশালী জমিদার বা প্রভাবশালী বাবুদের প্রাঙ্গণে কোনও উৎসব উপলক্ষে, কখনও বা নিছক বিনোদনের উদ্দেশ্যেই এমন কবির লড়াইয়ের আয়োজন করা হত। দুই গায়েনের এই দ্বন্দ্ব দেখতে সারা অঞ্চলের মানুষ ভিড় করে আসতেন। সাধারণত মুর্শিদাবাদ, কৃষ্ণনগর, শান্তিপুরের মতো কিঞ্চিৎ অগ্রসর নাগরিক অঞ্চলে এই স্থূলরসের গীতিসাহিত্য বিশেষরকম জনপ্রিয় হয়েছিল। কবিয়াল বা কবিওয়ালাদের শিক্ষা-দীক্ষা তেমন ছিল না। প্রকাশ্য সভায় চূড়ান্ত অশ্লীল প্রসঙ্গের উত্থাপনে তাঁদের কোনও সংকোচ ছিল না, বরং এই ধরনের অশালীনতাই সেসময়ে মানুষ নেশার মতো উপভোগ করতেন। গানের মধ্যে খেউড়, অপর পক্ষকে অশ্লীল ভাষায় ব্যক্তিগত আক্রমণ এসবই ছিল কবিগানের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। অধিকাংশ গানই অশিষ্ট, গ্রাম্য ও কুরুচিপূর্ণ হলেও রাম বসু, হরু ঠাকুরের মতো কিছু অভিজাত কবিওয়ালা আগমনী-বিজয়া পর্বের ধরনে উমা-হৈমবতীর প্রসঙ্গ নিয়ে গীত রচনাতেও পারদর্শী ছিলেন। বাংলাদেশে যখন এইরকম কবিগানের আসর এবং চর্চা পুরোদমে চলছিল, তেমনই এক সময়ে ফরাসডাঙায় এসে বসবাস শুরু করেন অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি।

চন্দননগরের বৈষ্ণব এবং ফরাসি সংস্কৃতির সংমিশ্রণের ফলে ব্রিটিশদের অনেক আগেই সেখানে সতীদাহ প্রথা এবং দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়েছিল। শোনা যায় অ্যান্টনি নিজে সৌদামিনী নামের এক হিন্দু ব্রাহ্মণ বিধবাকে সতীদাহ থেকে উদ্ধার করেছিলেন এবং গবেষকদের মতে তাঁকে নিয়ে চন্দননগরের কাছে বরুটিতে বসবাস করতেন। সৌদামিনীকে অ্যান্টনি বিবাহ করেছিলেন কিনা সে নিয়ে অবশ্য ধন্দ রয়েছে। অনেকের মতে, অ্যান্টনির স্ত্রীয়ের নাম নিরুপমা। কিন্তু ভোলা ময়রার গানে পাওয়া যায়, অ্যান্টনিকে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে ‘তোর বামনি সৌদামিনী’। অতএব এই বিষয়টা নিয়েও যেমন অস্পষ্টতা রয়েছে, তেমনি এই ছোট্ট অংশটি থেকে এও মনে হয়, যে, অ্যান্টনি সৌদামিনীকে (বা নিরুপমা) হয়তো বা বিবাহ করেছিলেন। অ্যান্টনির পর্তুগিজ ঐতিহ্যের সঙ্গে হিন্দু ঐতিহ্যের কখনও সংঘর্ষ হয়নি, বরং হিন্দু অনুষ্ঠানগুলি নিরবচ্ছিন্নভাবে চলত তাঁদের বাড়িতে। হিন্দুধর্মের প্রতি বিশেষ আকর্ষণও অনুভব করতে শুরু করেছিলেন তিনি, নতুবা দুর্গা-কালী নিয়ে গান রচনায় এতখানি পারদর্শী তিনি হতে পারতেন না। অনেকে বলে থাকেন দুর্গাপূজার মরশুমে স্ত্রী-র প্রচেষ্টায় বাড়িতে একটি কবিসম্মেলন আয়োজন করার সূত্রেই কবিয়ালদের সঙ্গে অ্যান্টনির যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছিল। কেউ কেউ আবার তারও আগে থেকে কবিদের আসরে গিয়ে অ্যান্টনির সারারাত ধরে গান শোনার কথাও উল্লেখ করেন। তথ্যের অপ্রতুলতার কারণে এবং বিশ্বাসযোগ্যতার অভাবে নিশ্চিতভাবে তাঁর সম্পর্কে কিছু বলতে পারা কঠিন৷ এখানে উল্লেখ্য যে, বিধবা হওয়ার কারণে এবং বিধবা হয়ে একজন ম্লেচ্ছ সাহেবের সঙ্গে ঘর করবার অপরাধে বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে অ্যান্টনির সঙ্গিনী সৌদামিনীকে রক্ষণশীল গোঁড়া হিন্দু সমাজের মোড়লেরা হত্যা করেছিল। অ্যান্টনি কবিগানের প্রতি এত বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন যে পারিবারিক লবণের ব্যবসায় আর তাঁর উৎসাহ থাকে না। তিনি বাংলা ভাষা শেখা শুরু করেন, সেইসঙ্গে হিন্দু শাস্ত্রাদি অধ্যয়ন করতে থাকেন নিরন্তর।

ক্রমে একটি কবিগানের দল গঠন করেন অ্যান্টনি। পর্তুগিজ ঐতিহ্যের সাহেবি পোশাক ছেড়ে বাঙালিদের মতো ধুতি, শাল ইত্যাদি পোশাক পরিধান শুরু করেন তিনি। অ্যান্টনি নিজে আগমনী-বিজয়া পর্যায়ের ভক্তিমূলক গান রচনা করেছিলেন, তাতে সুর সংযোগও করেছিলেন। কিন্তু কবিগানের আসরে গোরক্ষনাথ নামে একজন যে তাঁর বাঁধনদারের কাজ করতেন সে বিষয়ে অনেক গবেষকই একমত হয়েছেন। তবে শেষদিকে বেতন নিয়ে মনোমালিন্য হওয়ার কারণে গোরক্ষনাথ অ্যান্টনির সঙ্গ ত্যাগ করেছিলেন বলেই জানা যায়। ক্রমে রাম বসু, ঠাকুর সিংহ, ভোলা ময়রার মতো নামকরা কবিয়ালদের সঙ্গে কবিগানের আসরে অবতীর্ণ হতে থাকেন অ্যান্টনি। তাঁদের পরাজিত করে কবিগানের ধারায় নিজের আসন প্রতিষ্ঠিত করতে থাকেন তিনি এবং এভাবেই তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন ধীরে ধীরে। একটা সময়ে তাঁর গান মানুষের মুখে মুখে ফিরত। উদারনৈতিক এবং সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতামুক্ত মানবতাবাদী গীত রচনার জন্য অ্যান্টনি কবিয়াল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন কবিগানের ধারায়। ‘খৃষ্টে আর কৃষ্টে কিছু ভিন্ন নাই রে ভাই/ শুধু নামের ফেরে মানুষ ফেরে এও কথা শুনি নাই’-এর মতো লাইন অথবা ‘আমার খোদা যে হিন্দুর হরি সে’-এর মতো পংক্তি রচনা করে তিনি সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথাই বলে গিয়েছেন তাঁর গানে। অ্যান্টনি কবিয়াল বলতে চেয়েছেন সবার উপরে মানুষ সত্য। আবার আগমনী গানের ধাঁচে দেবী দুর্গার পিতৃগৃহে আগমনের ঘটনাটিকে অবলম্বন করে গান রচনা করে তিনি বাঙালির মা-মেয়ের সম্পর্কের বাস্তবতাকে তুলে ধরেছিলেন। এইভাবে অ্যান্টনি কবিয়ালের গান ছড়িয়ে পড়েছিল দিকে দিকে।

অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির সঙ্গে আরেকটি কাহিনিও জড়িত রয়েছে। বৌবাজারে অবস্থিত বিখ্যাত ফিরিঙ্গি কালীমন্দির অ্যান্টনি সাহেবের তৈরি বলেই মনে করা হয় দীর্ঘকাল ধরে। যেহেতু সাহেব নিজে কালীভক্ত ছিলেন, শ্যামাকে নিয়ে গীত রচনা করেছেন, অতএব এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা যে অ্যান্টনি নিজেই, এ বিষয়ে অনেকেই নিঃসন্দেহ। কিন্তু ঐতিহাসিক রাধারমণ মিত্রের মতো মানুষ এই তথ্য স্বীকার করেন না। তাঁর মতে ফিরিঙ্গি কালীবাড়ির সঙ্গে আদতেই অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির কোনও সম্পর্ক নেই। মন্দিরের ফলকে খোদাই করা ৯০৫ বঙ্গাব্দ সময়টি থেকে বোঝা যায় তখনও কলকাতারই জন্ম হয়নি৷ যখন পরবর্তীকালে মন্দির এলাকায় ইউরোপীয়দের বসতি গড়ে ওঠে সেখানে অ্যান্টনি আসতেন এবং সেই মন্দিরের দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা বিধবা প্রমীলাদেবীর প্রতি প্রণয়াসক্ত হয়ে পড়েন। এমনই নানা কিংবদন্তি এবং গবেষকদের অনুমানের ভিড়ে আজ এত বছর পরে রহস্যের ধোঁয়াশা কাটিয়ে অ্যান্টনির জীবনবৃত্তান্তের বিশ্বাসযোগ্য বর্ণনা পাওয়া বড়ই মুশকিলের বিষয়। কিন্তু অ্যান্টনি কবিয়ালের রচিত গানগুলির মাধ্যমে তাঁর মনোজগতের কিঞ্চিৎ যে হদিশ পাওয়া যায় তা থেকে বোঝা যায় কতখানি মুক্তমনা একজন মানুষ ছিলেন তিনি।
তাঁর জীবনকে কেন্দ্র করে বাংলায় সুনীল ব্যানার্জির পরিচালনায় নির্মিত এবং মহানায়ক উত্তকুমারের অনবদ্য অভিনয়ে সমৃদ্ধ ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ চলচ্চিত্রটি আজও বাঙালির হৃদয়ে ভালোবাসার আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছে। আজকের প্রজন্মের জনপ্রিয় পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ও অ্যান্টনির গল্প নিয়ে ‘জাতিস্মর’ নামে একটি ছায়াছবি নির্মাণ করেছেন। আবার মদন বন্দ্যোপাধ্যায় অ্যান্টনির জীবনীকে কেন্দ্র করে ‘কবিয়াল অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ নামে একটি উপন্যাসও রচনা করেছিলেন।

আনুমানিক ১৮৩৬ সালে মহান কবিয়াল অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির মৃত্যু হয়।

তথ্যসূত্র


  1. সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু (সম্পা.), 'সংসদ বাঙালী চরিতাভিধান', সাহিত্য সংসদ, মে ১৯৬০, কলকাতা, পৃষ্ঠা - ৬৬
  2. https://www.anandabazar.com/
  3. https://salilhore.wordpress.com/
  4. https://en.wikipedia.org/
  5. https://amp.scroll.in/

আপনার মতামত জানান