মাদার টেরেজা

মাদার টেরেজা

মাদার টেরেজা (Mother Teresa) একজন ক্যাথলিক সন্ন্যাসিনী ও ধর্মপ্রচারক যিনি ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন তাঁর সেবামূলক কাজের জন্য। বিশ্ব শান্তিতে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। সম্প্রতি পোপ ফ্রান্সিস তাঁকে কলকাতা শহরের ‘সন্ত টেরেজা’ (Saint Teresa of Calcutta) আখ্যায় ভূষিত করেছেন।

১৯১০ সালের ২৬ আগস্ট উত্তর ম্যাসিডোনিয়ার স্কোপজি শহরের উসকুপ নামক স্থানে মাদার টেরেজার জন্ম হয়। অটোমান সাম্রাজ্যে এই শহরের আগের নাম ছিলো কোসোভো বিলায়েৎ। মাদার টেরেজার সম্পূর্ণ নাম মাদার মেরি টেরেসা বোজাক্সিউ। জন্মের সময় তাঁর নাম ছিল অ্যান্জেজে গোন্সহে বোজাক্সিউ। জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন আলবেনিয়ান। জন্মের পরের দিনই খ্রিস্টধর্মে তাঁর ব্যাপ্টিসম সম্পন্ন হয়। এই দিনটিই তাঁর প্রকৃত জন্মদিন বলে মনে করা হয়। ধর্মীয় আদর্শে ও বিশ্বাসে তিনি ছিলেন ক্যাথলিক। টেরেসা তাঁর বাবা-মায়ের কনিষ্ঠতম সন্তান। তাঁর বাবা নিকোল বোজাক্সিউ ছিলেন রাজনৈতিক কর্মী এবং তাঁর মায়ের নাম দ্রানাফিল বোজাক্সিউ।

১৯১৯ সালে, খুবই অল্প বয়সে তাঁর বাবার মৃত্যু হয়। অনেক ছোট থেকেই টেরেজা বাংলায় কর্মরত মিশনারিগুলি এবং তাঁর সন্ন্যাসিনীদের গল্প শুনে মুগ্ধ হতেন। মাত্র বারো বছর বয়সেই তিনি একপ্রকার ধর্মীয় পথে জীবন-যাপনের সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন। আঠারো বছর স্কোপজি শহরে থাকার পর তিনি লরেটো সন্ন্যাসিনীদের সঙ্গে আয়ারল্যান্ডে চলে যান ১৯২৮ সালে।
১৯২৯ সালে তিনি ভারতবর্ষে আসেন। দার্জিলিঙ কনভেন্টে তাঁকে পাঠানো হলে সেখানে তিনি বাংলা ভাষা শিক্ষা নেন। পরবর্তী সময়ে তাঁর কনভেন্টের কাছেই অবস্থিত একটি বিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষকতাও করেছেন। ১৯৩১ সালের ২৪ মে তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করেন এবং তাঁর নতুন নাম হয় থেরেসে দ্য লিসিয়াক্স (Thérèse de Lisieux)।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

এরপর তিনি পূর্ব কলকাতার এন্টালিতে লরেটো কনভেন্ট স্কুলে শিক্ষয়িত্রী হিসেবে যোগ দেন। দীর্ঘদিন সেখানে চাকরির পর ১৯৪৪ সালে তাঁকে ‌অধ্যক্ষার পদে উন্নীত করা হয়।
এই স্কুলের পাশে অবস্থিত বস্তিগুলিতে বসবাসরত মানুষের দারিদ্র তাঁকে প্রবল বিচলিত করে। এই সময়পর্বেই অর্থাৎ ১৯৪৩ সালে বাংলায় মন্বন্তর এবং ১৯৪৬ সালে কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বাঁধে। ১৯৪৭-এ স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গেই ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি ভূ-খন্ড তৈরি হয়। উদ্বাস্তু চাপ বাড়ে কলকাতার উপর। এই সময়ই কলকাতা থেকে দার্জিলিং কনভেন্টে যাওয়ার পথে টেরেজা ট্রেনের মধ্যে মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার ডাক পান তাঁর হৃদয় থেকে। তাঁর অন্তরের ডাকে সাড়া দিয়ে শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে ১৯৫০ সালে গঠন করেন ‘মিশন্যারিজ অব চ্যারিটি’।

১৯৪৮ সালেই তিনি দুঃখী ও গরীব মানুষদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। তিনি এরপর ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন এবং মানুষের সেবার স্বার্থে পাটনায় চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাধারণ জ্ঞান লাভ করেন। পরবর্তীতে কলকাতার মোতিঝিলে তিনি একটি বিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রথম দিকে সেবা কর্মের জন্য তাঁর কাছে কোন আয় ছিল না। তিনি মানুষের কাছে বহু হাত পেতেও সেভাবে কিছু পাননি। ১৯৫২ সালে কালীঘাটের কাছে তিনি ‘নির্মল হৃদয়’ নামে একটি সেবা প্রতিস্থান প্রতিষ্ঠিত করেন। মরণাপন্ন মানুষেরা এখানে চিকিৎসা পেতেন এবং মৃত্যুর সময় লাভ করতেন স্ব-ধর্মানুসারে সেবা। মাদার টেরেজা মনে করতেন, যাঁরা এতদিন পাশবিক একটি জীবন কাটিয়েছে, তাঁদের মৃত্যুতে যেন স্নেহ ও প্রেম লেগে থাকে।

মিশনারিজ অব চ্যারিটি কুষ্ঠ রোগীদের চিকিৎসার স্বার্থে কলকাতার স্থানে স্থানে গড়ে তোলে কুষ্ঠ চিকিৎসালয়। পরবর্তী সময়ে এই সংগঠন এইডস, শিশু ও অভিভাবকদের সমীক্ষা, যক্ষা ইত্যাদি নিয়েও কাজ করেছে। ব্যবস্থা করা হয়েছে চলমান ক্লিনিকেরও। অনাথ শিশুদের সেবা-দায়িত্বের জন্য তাঁরা ১৯৫৫ সালে ‘নির্মলা শিশুভবন’ গড়ে তোলেন। টেরেজা এরপর বিদেশেও তাঁর সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। ভেনেজুয়েলা, ইতালি, তানজানিয়া, অস্ট্রিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকা, এশিয়ার স্থানে স্থানে তাঁর সাহায্য পৌঁছে যেতে থাকে। মানবিক কারণে তিনি বহুবার বিদেশে পাড়িও দেন। ১৯৯৬ সালের মধ্যে একশোটি দেশে তাঁর নেতৃত্বাধীন ৫১৭টি মিশন প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৬২ সালে ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ সম্মানে ভূষিত করেন। ১৯৮০ সালে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ‘ভারতরত্ন’ লাভ করেন। ১৯৬২ সালে তিনি শান্তি ও আন্তর্জাতিক সৌভ্রাতৃত্ব স্থাপনে অবদানের জন্য পান রামন ম্যাগসেসে পুরস্কার। পোপ ষষ্ঠ পল তাঁকে পোপ ত্রয়োবিংশ জন শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করেন ১৯৭১ সালে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বহু বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডক্টরেটে ভূষিত করে। ১৯৯৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে সাম্মানিক নাগরিকত্বও প্রদান করে। ১৯৭৯ সালে মাদার টেরেজা লাভ করেন নোবেল শান্তি পুরস্কার। নোবেল বক্তৃতায় তিনি তুলে ধরেন দুঃখ ও দারিদ্রের স্বরূপটিকেই। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর বিলাসবহুল ভোজনসভার আয়োজন হলে, তিনি সেই আমন্ত্রণ নাকচ করে সেই অর্থ ভারতবর্ষের মানুষের সেবায় খরচের জন্য উদ্যোগী হন।

২০১৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর ভ্যাটিকান সিটিতে পোপ ফ্রান্সিস মাদার টেরেজাকে ‘সন্ত’ উপাধিতে ভূষিত করার কথা ঘোষণা করেন। ২০১৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয় মাদার টেরেজার ‘সন্ত টেরেজায়’ ভূষিত হওয়ার অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে প্রতিনিধিত্ব করেন পোপ ফ্রান্সিস।

১৯৮৩ সালে পোপ দ্বিতীয় জন পলের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সময়ই তিনি প্রথমবার হৃদরোগে আক্রান্ত হন। ১৯৮৯ সালে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার পর কৃত্রিম পেসমেকার লাগানো হয়। মেক্সিকো ভ্রমণকালে ১৯৯১ সালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পর তাঁর হৃদযন্ত্র্র সমস্যা বাড়তেই থাকে। ১৯৯৭ সালের ১৩ মার্চ মাদার টেরেজা মিশনারিজ অব চ্যারিটির প্রধান পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। সেই বছরই ৫ সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়।

তাঁর মৃত্যুতে ভারত সরকার থেকে শুরু করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। ইউনাইটেড নেশনস মাদার টেরেজাকে ‘পৃথিবীর শান্তি’ বলে উল্লেখ করেন।

4 comments

  1. মাদার সম্পর্কিত লেখাটির সূত্রগুলি যথেষ্ট নয়।মাদার সম্পর্কে বহু গুরুতর অভিযোগ আছে।

    সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট প্রামাণ্য গ্রন্থগুলি সহজে পাওয়াও যায়। লেখাটি নিরপেক্ষ হলে ভাল হত।

আপনার মতামত জানান