বি. সত্যনারায়ণ রেড্ডি

বি.সত্যনারায়ণ রেড্ডি

ভীমরেড্ডি সত্যনারায়ণ রেড্ডি (Bhimreddy Satyanarayan Reddy) ওরফে বি.সত্যনারায়ণ রেড্ডি (B. Satya Narayan Reddy) একজন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী যিনি একাদিক্রমে ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ এবং উত্তরপ্রদেশের রাজ্যপাল হিসেবে দায়িত্ব সামলেছেন। গান্ধীজির দেখানো অহিংস পন্থাই সত্যনারায়ণ রেড্ডির ধ্যানজ্ঞান ছিল, স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত থাকার অপরাধে কারাবাসও করতে হয়েছিল তাঁকে। তিনি উত্তরপ্রদেশের রাজ্যপাল পদে থাকাকালীনই বাবরি মসজিদ ধ্বংস ধ্বংস করা হয়।

১৯২৭ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন অন্ধ্রপ্রদেশে তথা অধুনা তেলেঙ্গানায় মেহেবুব জেলার অন্তর্গত শাদনগরের আন্নারাম গ্রামে একটি কৃষক পরিবারে বি.সত্যনারায়ণ রেড্ডি র জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম ভীমরেড্ডি নরসিরেড্ডি (Bhimreddy Narsireddy) এবং তাঁর মায়ের নাম মানিকম্মা (Manikyamma)।

সত্যনারায়ণের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় রাঙ্গারেড্ডি জেলার অন্তর্গত এদুলাবাদ গ্রামে। তারপর হায়দ্রাবাদের কায়স্থ পাঠশালায় অধ্যয়ন করবার পর কেশব মেমোরিয়াল স্কুলে ভর্তি হন তিনি। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা সম্পূর্ণ করবার পর হায়দ্রাবাদের বিবেকবর্ধিনী হাইস্কুল থেকে উচ্চবিদ্যালয় স্তরের শিক্ষা সমাপ্ত করেন তিনি। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়বার সময় তিনি ‘মুকুল’ নামের একটি হিন্দি পাক্ষিক পত্রিকাও প্রকাশ করতেন। বিদ্যালয় অতিক্রম করবার পর পড়াশোনার জন্য হায়দ্রাবাদের বিখ্যাত নিজাম কলেজে ভর্তি হন তিনি। এরপর আইনের প্রতি অগাধ আগ্রহ এবং উৎসাহ থেকেই হায়দ্রাবাদেরই প্রখ্যাত ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। যেহেতু জনসেবামূলক রাজনীতিতেই সারাজীবন প্রায় উৎসর্গ করেছিলেন মি. রেড্ডি, আইন অধ্যয়ন সেই যাত্রাপথে তাঁর উপযুক্ত সঙ্গী হয়েছিল বলা চলে। 


সববাংলায় সাইটে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য আজই যোগাযোগ করুন
contact@sobbanglay.com


 

যেসময় জন্ম হয়েছিল সত্যনারায়ণ রেড্ডির, ভারতবর্ষে স্বদেশি আন্দোলনের আগুন তখন চতুর্দিকে তার লেলিহান শিখা বিস্তার করে ফেলেছে। গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনের ব্যর্থতা এবং আইন অমান্য আন্দোলনের প্রস্তুতি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা একের পর এক ঘটে চলেছে তখন। এমন স্বাধীনতা সংগ্রামের আবহে বেড়ে উঠতে উঠতে সত্যনারায়ণের মনেও গড়ে উঠছিল জাতীয়তাবাদ এবং দেশাত্মবোধ। কৈশোরকালেই এই লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে এগিয়ে এসেছিলেন তিনি। ১৯৪২ সালে গান্ধীজির নেতৃত্বে সংঘটিত ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন’-এর সময় সক্রিয়ভাবে মি. রেড্ডি আন্দোলনের এক অংশ হয়ে উঠেছিলেন মাত্র ১৪ বছর বয়সেই। গান্ধীজির গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে তিনি ছাত্রদের নিয়ে একটি প্রতিবাদী মিছিল বের করেছিলেন, ফলে ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকেও গ্রেপ্তার করে কারাবন্দী করে। ১৯৪৭ সালে তিনি হায়দ্রাবাদের গণ আন্দোলনে অংশ নেন এবং গান্ধীজির পন্থা মেনে নিজাম সরকারের বিরুদ্ধে ‘সত্যাগ্রহ আন্দোলন’ সংগঠিত করে তোলেন। ফলে ১৯৪৭ সালে নিজাম সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে এবং হায়দ্রাবাদের চঞ্চলগুড়ার সেন্ট্রাল জেলে ছয় মাস বন্দী করে রাখে। এসময় কারাবন্দি থাকাকালীন তিনি ‘পেয়াম-ই-নাভ’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন যেটি তিনি তাঁর কারাসঙ্গীদের মধ্যেই বিতরণ করেন।

১৯৪৭-৪৮ সালে বি.সত্যনারায়ণ রেড্ডি হায়দ্রাবাদ স্টুডেন্টস ইউনিয়নের অ্যাকশান কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। হায়দ্রাবাদের সিটি সিভিল কোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদকের পদও অলঙ্কৃত করেছিলেন তিনি। ১৯৬৯-৭১ সময়কালে তেলেঙ্গানা প্রজাসমিতির চেয়ারম্যান হিসেবেও বহাল ছিলেন সত্যনারায়ণ রেড্ডি। তিনি জয়প্রকাশ নারায়ণ এবং আচার্য বিনোবা ভাবের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ভূমিসংস্কার আন্দোলন যেটি কিনা ‘ভূদান’ নামে পরিচিত সেখানেও অংশগ্রহণ করেছিলেন সত্যনারায়ণ। পরবর্তীকালে তেলেঙ্গানা আন্দোলনে একজন অনুপ্রেরণাদানকারী হিসেবেও সত্যনারায়ণের ভূমিকা প্রণিধানযোগ্য। গান্ধীজি, রাম মনোহর লোহিয়া, আচার্য নরেন্দ্র দেব এবং ‘লোকনায়ক’ জয়প্রকাশ নারায়ণের মতো মানুষদের রাজনীতির অণুপ্রেরণায় রেড্ডি সমাজতন্ত্রী আন্দোলনে এবং সমাজতন্ত্রী দলেও যোগদান করেছিলেন। সমাজতন্ত্রী দল থেকেই সত্যনারায়ণ রেড্ডির রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল বলা যায়। তিনি স্যোশালিস্ট পার্টির কার্যনির্বাহী কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব সামলেছিলেন। ১৯৭৫ সালে জয়প্রকাশ নারায়ণ কমিটির আহ্বায়ক হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন । 

১৯৭৫ সালের ১ আগস্ট জরুরি অবস্থার সময়ে মি. রেড্ডিকে পুনরায় ‘মিসা’ আইনের অধীনে গ্রেপ্তার করে মুশিরাবাদ জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে এবং ১৮ মাস কারাবন্দি অবস্থায় রাখা হয়। জেল থেকে বেরোনোর পর তিনি জয়প্রকাশ নারায়ণের গড়ে তোলা ‘জনতা পার্টি’তে যোগদান করেন। জনতা পার্টির হয়ে ১৯৭৮ সালে তিনি রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তিনি জনতা পার্টির অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পরবর্তীকালে লোকদলে (কেন্দ্রীয় দল) যোগদান করেন তিনি এবং সেই দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ অলঙ্কৃত করেন। ১৯৮৩ সালে  সত্যনারায়ণ রেড্ডি তেলেঙ্গানা দেশম পার্টিতে যোগ দেন এবং সেই দলের হয়ে ১৯৮৪ সালে পুনরায় দ্বিতীয়বারের জন্য রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। সংসদের বিভিন্ন কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন সত্যনারায়ণ রেড্ডি।

১৯৯০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি মি. রেড্ডি উত্তরপ্রদেশের রাজ্যপাল হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরবর্তী তিন বছর ১৯৯৩ সালের ২৫ মে পর্যন্ত এই পদে বহাল ছিলেন তিনি। এই সময়কালের মধ্যেই উত্তরপ্রদেশের রাজ্যপাল থাকাকালীন বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মতো ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছিল। সেবছরই অর্থাৎ ১৯৯৩ সালেই ১ জুন সত্যনারায়ণ ওড়িশার রাজ্যপাল হিসেবে নিযুক্ত হন এবং পরবর্তী দুই বছর ১৯৯৫ সালের ১৭ জুন পর্যন্ত এই পদ সামলেছিলেন তিনি দক্ষ হাতে। মাঝখানে ওড়িশার রাজ্যপাল পদে আসীন থাকাকালীনই পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালের শূন্যপদে অল্প সময়ের জন্য অতিরিক্ত দায়িত্বগ্রহণকারী হিসেবে কাজ করেছিলেন তিনি। ১৯৯৩ সালের ১৩ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজ্যপাল হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি এবং মাত্র একমাস অর্থাৎ ১৪ আগস্ট পর্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এই দায়িত্ব সামলান।  

বি. সত্যনারায়ণ রেড্ডি ‘সমাজবাদী যুবজন সভা’, ‘ন্যাশনাল হাইস্কুল’, ‘স্যোশালিস্ট ইউথ উইং’য়ের মতো প্রতিষ্ঠান স্থাপনের মূল কাণ্ডারি ছিলেন। তিনি নিজের গ্রামে অঞ্জনস্বামীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং দলিতদের জন্য পাকা বাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। কেবলমাত্র মন দিয়ে মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখবেন বলে সারাজীবন অবিবাহিত ছিলেন তিনি। 

দীর্ঘদিন ফুসফুসের সমস্যায় ভোগার পর ২০১২ সালের ৬ অক্টোবর ৮৬ বছর বয়সে বি. সত্যনারায়ণ রেড্ডির মৃত্যু হয়। 

One comment

আপনার মতামত জানান