বড়ু চণ্ডীদাস (Badu Chandidas) প্রাচীন বাংলার একজন বিখ্যাত কবি। চৈতন্য-পূর্ব বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান অর্জন করেছেন তিনি। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘চণ্ডীদাস’ নামে চারজন কবির নাম ইতিহাসে পাওয়া যায়। এঁরা হলেন বড়ু চণ্ডীদাস, দ্বিজ চণ্ডীদাস, দীন চণ্ডীদাস ও পদাবলীর চণ্ডীদাস। কিন্তু ঐতিহাসিকদের মতে চণ্ডীদাস একজনই, ‘বড়ু’ তাঁর পদবি ও তাঁর গুরুপ্রদত্ত নাম হল ‘চণ্ডীদাস’। তবে এ নিয়ে আজও দ্বিমত রয়েছে। বড়ু চণ্ডীদাসের লেখা ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যটি বাংলার আদি-মধ্যযুগের একটি অমূল্য সাহিত্য-সম্পদ। তিনি বাঙালির ভাবরসের জনক। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের প্রথম কবি তিনিই।
বড়ু চণ্ডীদাসের জন্মসাল নিয়ে নানা বির্তক রয়েছে। কোন গবেষকদের মতে বড়ু চণ্ডীদাসের জন্ম হয়েছিল ১৩৭০ সালে বীরভূমের নানুরে। আবার অন্য একদল গবেষকদের মতে, চণ্ডীদাসের জন্ম বাঁকুড়ার ছাতনা গ্রামে। একদল গবেষক জানান তাঁর বাবা দুর্গাদাস বাগচী ছিলেন বারেন্দ্র শ্রেণির ব্রাহ্মণ। ‘চণ্ডীদাস চরিত’ গ্রন্থের রচয়িতা শ্রীযুক্ত ব্রজসুন্দর স্যানাল মহাশয় তাঁর গ্রন্থে চণ্ডীদাসের বাবার নাম ভবাণীচরণ রায় ও মায়ের নাম ভৈরবসুন্দরী দেবী বলে উল্লেখ করেছেন। তবে এ নিয়ে দ্বিমতও রয়েছে। বড়ু চণ্ডীদাস শাক্ত দেবী বাসুলীর পূজারী ছিলেন। বীরভূমের নানুর ও ছাতনা গ্রাম দুটিতেই দেবী বাসুলীর মন্দির রয়েছে। সেই কারণেই চণ্ডীদাসের জন্মস্থান নিয়ে বির্তক থেকেই যায়। চণ্ডীদাস শাক্ত দেবীর পূজারী হওয়া সত্ত্বেও বৈষ্ণব সহজিয়া মতের বিশ্বাসী ছিলেন। পুঁথিগত শিক্ষার বিপক্ষে থাকা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন বিদ্বান এবং পণ্ডিত ব্যক্তি, সুগায়ক হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ছিল বলে জানা যায়। জনমত অনুসারে চণ্ডীদাসের বাবা তাঁকে অপছন্দ করার কারণে চণ্ডীদাসকে তিনি বাড়ি থেকে চলে যেতে নির্দেশ দেন। তাঁদের গ্রামেরই রামী নামে এক রজকিনীকে চণ্ডীদাস আপন সাধনসঙ্গিনী বলে মনে করতেন। রামীর মধ্যেই তিনি রাধাকে অনুভব করেন এবং তাঁর অণুপ্রেরণায় চণ্ডীদাস কবিতা লেখা শুরু করেন। তাঁর ও রামীর প্রেম সম্বন্ধে বিভিন্ন কাহিনী নানুর ও ছাতনা গ্রামের মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়। শোনা যায় তৎকালীন জমিদার এই প্রেমকে ‘অবৈধ’ আখ্যায়িত করে চণ্ডীদাসকে গ্রামছাড়া করেন। একই অপরাধে চণ্ডীদাসকে নিজের বাবার মুখাগ্নি করতেও অসম্মতি জানায় তৎকালীন সমাজ। এত ঘটনার পরেও চণ্ডীদাস রামীকে ত্যাগ করতে অসম্মত হয়। বৈষ্ণব ধর্মালম্বীদের মতে রামী ও চণ্ডীদাসের প্রেম বাস্তবে ছিল ঐশ্বরিক ও পবিত্র। নানুরে এই যুগলের মূর্তিও রয়েছে। কোনও কোনও ঐতিহাসিক চণ্ডীদাসকে ‘রামী চণ্ডীদাস’ বলেও উল্লেখ করেছেন।
চণ্ডীদাসকে নিয়ে সঠিক তথ্য না পাওয়ার কারণে তাঁর কর্মজীবন নিয়েও সঠিক কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। হরেকৃষ্ণ মুখ্যোপাধ্যায় লিখেছেন যে, বড়ু চণ্ডীদাস ছিলেন বীরভূমে নানুরের কীর্ণাহার গ্রামের রাজা কিঙ্কিনের সভাকবি। পাঠানযোদ্ধা কীলগীর খাঁ কিঙ্কিনকে হত্যা করে নানুর দখল করলে তাঁরও মৃত্যু হয়। আবার কারোর মতে বড়ু চণ্ডীদাস ছিলেন নানুর গ্রামের বাসুলী অথবা বিশালাক্ষী দেবীর পূজারী।
চণ্ডীদাসের কাছে মানবতাই ছিল শ্রেষ্ঠ ধর্ম। জাতপাতের উর্ধ্বে গিয়ে মানুষের পারস্পরিক প্রেমকে জাগ্রত করে তোলার লক্ষ্যে তিনি তাঁর কাব্যের পদগুলি সৃষ্টি করেছেন। নর-নারীর প্রেমকথাই তিনি কল্পকাহিনী হিসেবে রচনা করেছেন তাঁর কাব্যে। তাঁর রচনার মধ্যে ‘রাধার কলঙ্কভজন’ ও ‘কৃষ্ণের জন্মলীলা’ উল্লেখযোগ্য। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যটি বড়ু চণ্ডীদাসের সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা। কবি জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ ও ভাগবত পুরাণের দ্বারা প্রভাবিত ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ আদপে একাধারে একটি গীতিকাব্য এবং নাট্যগুণান্বিত হওয়ার কারণে একে নাটগীতিও বলা হয়। চণ্ডীদাসের লেখা ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যটি রাধা-কৃষ্ণের প্রেম কাহিনী নির্ভর পয়ার ও ত্রিপদী ছন্দে রচিত। এই কাব্যটি ঘাত-প্রতিঘাত, রাগ-দ্বেষ, বিরহ-মিলন সংমিশ্রিত একটি গতিশীল নাট্যরূপ। বসন্তরঞ্জন বিদ্বৎবল্লভ ১৯০৯ সালে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এর পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার করেন বাঁকুড়ার কাকিল্যা গ্রামের এক গৃহস্থের গোয়ালঘর থেকে এবং তিনি ১৯১৬ সালে নিজস্ব সম্পাদনায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে এই কাব্য প্রকাশ করেন। মূলত রাধা, কৃষ্ণ ও বৃদ্ধ বড়াইকে নিয়ে ৪১৮টি পদ সম্বলিত এই কাব্যটি। জন্মখণ্ড, তাম্বুলখণ্ড, দানখণ্ড, নৌকাখণ্ড, ভারখণ্ড, ছত্রখণ্ড, বৃন্দাবনখণ্ড, কালীয়দমনখণ্ড, যমুনাখণ্ড, হারখণ্ড, বাণখণ্ড, বংশীখণ্ড ও রাধাবিরহ এই নিয়ে মোট তেরোটি খণ্ডে বিভক্ত ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য। এই গ্রন্থটির সময়কাল হিসেবে ঐতিহাসিকেরা যা তথ্য আবিষ্কার করেছেন তার নিরিখে বলা যায় এটি বাংলার আদি মধ্যযুগের ভাষা ও সাহিত্যের উৎকৃষ্ট নিদর্শন। চণ্ডীদাস রাধার চরিত্রটিকে তাঁর গ্রন্থে বৈরাগ্যময়ী ও তপস্বিনী হিসেবে নির্মাণ করেছেন। গ্রামের এক সহজ সরল কিশোরী যার কোমল রূপের সঙ্গে প্রাত্যহিক জীবনের জটিলতার মিশ্রণ তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন রাধার চরিত্রে। রাধার সহজ সরল জীবনে আকস্মিক প্রেমের আবির্ভাব ও তাঁর প্রেমিকের সঙ্গে বিচ্ছেদের কাহিনী পাঠককুলকে আবেগে সিক্ত করে। এই ক্ষেত্রেই চণ্ডীদাস এই কাব্যের পদগুলিতে তিনি ভক্তিরসের সাথে প্রেমরসের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। বাঙালীর আবেগ ও অনুভূতিকে ফুটিয়ে তুলতে সুনিপুণভাবে কাব্যের মধ্যে অলঙ্কারের প্রয়োগ করেছেন তিনি। রাধার বিরহগাথা সাধারণ মানুষকেও অশ্রুসজল করে তোলে। প্রেমের কোমল মূর্তির সঙ্গে রাধার সর্বত্যাগিনী রূপকে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন সার্থকভাবে। এই কাব্যের জন্মখণ্ডে রাধা ও কৃষ্ণের ধরাধামে আগমণের কারণ তথা জন্মবৃন্তাত্ত বর্ণনা করা আছে, তাম্বুলখণ্ডে আছে রাধার অসামান্য রূপের বর্ণনাসহ শ্রীকৃষ্ণের পূর্বরাগ, দানখণ্ডে শ্রীকৃষ্ণের দানীর অভিনয় কতৃর্ক রাধার সঙ্গে মিলন ইত্যাদি। তাছাড়া নৌকাখণ্ডে শ্রীকৃষ্ণের মাঝি সেজে রাধাসহ গোপীদের যমুনা পার করার কাহিনী রয়েছে, রয়েছে রাধাকৃষ্ণের যমুনা বিহারের বর্ণনাও। ভারখণ্ডে শ্রীকৃষ্ণের ভারবাহক রূপে রাধার সঙ্গে থাকা দুধ ও দইয়ের পসরা বহন করার কথা উল্লেখ আছে। ছত্রখণ্ডে রাধার মাথায় শ্রীকৃষ্ণের ছাতা ধরার কাহিনী বর্ণনা করেছেন বড়ু চণ্ডীদাস। বৃন্দাবনখণ্ডে গোপীদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের বনবিলাস ও রাসযাত্রার উল্লেখ আছে। যমুনাখণ্ডে শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা গোপীদের বস্ত্রহরণ ও জলবিহারের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। হারখণ্ডে রয়েছে শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা রাধার হার চুরির ঘটনা এবং যশোদা মায়ের কাছে শ্রীকৃষ্ণের বিরুদ্ধে রাধার নালিশ জানানোর কাহিনী। কাব্যের বাণখণ্ডে শ্রীকৃষ্ণের বিরুদ্ধে রাধার নালিশের প্রতিশোধ এবং বড়াইয়ের সহযোগিতায় রাধার উপরে শ্রীকৃষ্ণের মদনবাণ প্রেরণ করার কারণে কৃষ্ণের রাধার প্রতি মোহ ও সম্ভোগের কাহিনীর বর্ণিত হয়েছে। বংশীখণ্ডে শ্রীকৃষ্ণের বাঁশি শুনে রাধার চিত্তচাঞ্চল্য এবং রাধার শ্রীকৃষ্ণের বাঁশিটি চুরি করা, তার পরিপ্রেক্ষিতে রাধার কাছে শ্রীকৃষ্ণের কাকুতি, অতঃপর রাধার বাঁশিটি ফেরত দেওয়ার ঘটনাবলীর উল্লেখ রয়েছে। সবশেষে রাধাবিরহ অংশে রাধাকৃষ্ণের মিলন ও সম্ভোগ, কৃষ্ণের মথুরায় যাওয়া ও রাধার বিরহের কাহিনী বর্ণিত আছে। কিন্ত এই অংশটি সম্পূর্ণরূপে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি এবং অনেক ঐতিহাসিক ও গবেষক রাধাবিরহ খণ্ডটিকে প্রক্ষিপ্ত বলেও মনে করেছেন। এই কাব্যে রাধা-কৃষ্ণের দৈবী রূপের পরিবর্তে রক্ত-মাংসের মানুষের রূপ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কাব্যে রাধার প্রতি কৃষ্ণের কামাসক্তি ও মিলনের তথা সম্ভোগের আকাঙ্ক্ষা একেবারে গ্রাম্য পরিবেশের স্থূল আদিরসের পরিচয় দেয়।
চণ্ডীদাসের রচিত পদগুলি খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল যার প্রভাব আমরা পরবর্তী কালে কবিদের রচনায় দেখতে পাই। বাংলায় বৈষ্ণব আন্দোলনে এবং বাংলার সংস্কৃতিতে চণ্ডীদাসের রচনা এক শক্তিশালী প্রভাব বিস্তার করেছিল। তাঁর কাব্যের অনুকরণে অনেক কবিই পরবর্তীকালে গান রচনা করেছিলেন। বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীরা রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকে আদর্শ করে মানুষে মানুষে প্রেম ও ভক্তিবাদ প্রচার করেছিলেন। সমাজের নিম্নস্তরের মানুষের সঙ্গে উচ্চবর্ণের মানুষের ভেদাভেদ দূর করার ক্ষেত্রেও চণ্ডীদাসের জীবন অণুপ্রাণিত করেছিল। বীরভূমে বিভিন্ন অঞ্চলে চণ্ডীদাসের নামে স্কুল ও হাসপাতাল তৈরি হয়েছে। তাঁকে নিয়ে ১৯৩৪ সালে একটি হিন্দি চলচ্চিত্র নির্মিত হয় নীতিন বসুর পরিচালনায় যেখানে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন বিখ্যাত অভিনেতা কুন্দনলাল সায়গল।
চণ্ডীদাসের মৃত্যু নিয়েও বির্তক রয়েছে। কোনও গবেষকের মতে বড়ু চণ্ডীদাস শেষ বয়সে বৃন্দাবনে যান এবং সেখানেই মারা যান। আবার কোনও গবেষকের মতে পাঠান যোদ্ধা কীলগীর খাঁ রাজা কিঙ্কিনকে হত্যা করার সঙ্গে চণ্ডীদাসকেও হত্যা করেন। অন্য একটি তথ্যানুসারে গৌড়ের বেগম চণ্ডীদাসের কবিতায় মুগ্ধ হয়ে তাঁর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন। এই সংবাদ পেয়ে গৌড়ের নবাব চণ্ডীদাসকে হাতির পিঠে বেঁধে চাবুক মেরে হত্যা করা হয়েছিল। তবে কোনও মতকেই প্রামাণ্য বলে সেভাবে ধরা যায় না।
আনুমানিক ১৪৩০ সালে বড়ু চণ্ডীদাসের মৃত্যু হয়।
তথ্যসূত্র
- অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য (সম্পা:), 'বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন সমগ্র', দে'জ পাবলিশিং, জুন ২০১৬, ১৬শ সং, পৃষ্ঠা ৫২, ৬৭, ১৪৫, ১৬১
- https://en.wikipedia.org/
- https://www.anandabazar.com/
- https://www.britannica.com/
- https://bengalrenaissance.org/