জন ড্রাইডেন (John Dryden) সপ্তদশ শতকের ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম আলোচিত লেখক ও কবি যিনি ত্রিশটিরও বেশি নাটকের রচয়িতা। তাঁর আবির্ভাবকালকে ‘ড্রাইডেনের যুগ’ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
১৬৩১ সালের ৯ আগস্ট ইংল্যান্ডের নর্থহামটনশায়ারের অল্ডউইংকল নামক গ্রামে জন ড্রাইডেনের জন্ম হয়। তাঁর বাবা ইরাসমাস ড্রাইডেন এবং মা মেরি পিকারিং-এর চোদ্দ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন বড় সন্তান। ড্রাইডেনের শিক্ষাজীবন শুরু হয় গ্রামের স্কুলে। কিন্তু শিক্ষা সমাপ্তির আগেই তাঁর বয়স যখন মাত্র ১১ বছর, তখন দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। অলিভার ক্রমওয়েলের নেতৃত্বে ইংল্যান্ডের প্রজারা রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই বিদ্রোহীদের পক্ষে ড্রাইডেনের বাবা মাও ছিলেন। ড্রাইডেনের কিন্তু এই বিদ্রোহে সমর্থন ছিলনা। ১৬৪৪ সালে তাঁকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয় ওয়েস্টমিনস্টার স্কুলে। এখানে পড়ার সময় তিনি তাঁর সহপাঠী হিসেবে পান জন লককে।
এই স্কুলে সাহিত্যের ছাত্রদের বিশেষ করে পড়ানো হতো ক্লাসিক্যাল সাহিত্য। ফলত ড্রাইডেন প্রাচীন ইংরেজি সাহিত্যের প্রায় সব বড় বড় লেখকের লেখার সাথে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তাঁর কবিতা ও নাটকে পরবর্তী সময়ে যে ক্লাসিক্যাল সাহিত্যের প্রভাব লক্ষ করা গিয়েছিল, তার গোড়াপত্তন এখান থেকেই। ১৬৫০ সালে তিনি কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে ভর্তি হন। এখানে থেকে তিনি ১৬৫৪ সালে বি. এ. ডিগ্রি লাভ করেন। ১৬৬৩ সালে তাঁর যখন মাত্র ৩২ বছর বয়স, তখন তিনি সদ্য প্রতিষ্ঠিত রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন।
কলেজে পড়ার সময় থেকেই ড্রাইডেন কিছু কিছু কবিতা লিখতে শুরু করেন। ১৬৪৯ সালে যখন লর্ড হেস্টিংস এর মৃত্যু হলে তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে তিনি একটি কবিতা রচনা করেন। এর পরের বছর রচনা করেন জন হডেসডন (John Hoddesdon) নামে আরেক ব্যক্তির স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদিত একটি কবিতা। ১৬৫৯ সালে অলিভার ক্রমওয়েলের স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটি বীরগাথা রচনা করেন তিনি।
অলিভার ক্রমওয়েলের পর দ্বিতীয় চার্লস সিংহাসনে আরোহণ করলে কবি এই তরুণ রাজাকে অভিনন্দন জানিয়ে একটি দীর্ঘ কবিতা রচনা করেন। ৩০০ লাইনের এই দীর্ঘ কবিতার নাম দেন তিনি ‘অ্যাস্ট্রায়া রেডাক্স’ (Astraea Redux)। রাজা দ্বিতীয় চার্লস ১৬৬০ সালে সিংহাসনে আরোহণ করলেও তাঁকে কেন্দ্র করে ড্রাইডেন রাজার প্রশস্তি গেয়ে একটি দীর্ঘ কবিতা রচনা করেন – ‘টু হিস সেক্রেড ম্যাজেস্টি’ (To His Sacred Majesty)। পরপর এই দুটি কবিতা রচনা করার জন্যই তিনি রাজপরিবারের নজরে পড়ে যান। ১৬৬৬ সালে তিনি “অ্যানাস্ মিরাবিলিস’ Annus Mirabilis) নামে আরও দীর্ঘ একটি কবিতা রচনা করেন। ইংরেজ ও পর্তুগিজদের মধ্যে হওয়া নৌযুদ্ধ এবং লন্ডন শহরের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ছিল তাঁর এই কবিতার বিষয়বস্তু। লন্ডনের অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের রাজা যেভাবে সাহায্য করেছিলেন, তারই চমৎকার বর্ণনা ড্রাইডেন তুলে ধরেন এই কবিতায়। ফলে ড্রাইডেন রাজার সুদৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন এবং রাজার অধীনে একটি সাম্মানিক পদ লাভ করেন রাজদরবারে। ১৬৬৮ সালে স্যার ইউলিয়াম ডাভেনান্টের (Sir William Davenant) মৃত্যু হলে ড্রাইডেন রাজার সভাকবির পদ লাভ করেন। এই সময়ে তাঁর মাসিক বেতন ছিল ৩০০ পাউন্ড যেটা বেড়ে শেষে দাঁড়িয়েছিল ১০০০ পাউন্ডে। ১৬৬৩ সালে ড্রাইডেন তাঁর প্রথম নাটক ‘দি ওয়াইল্ড গ্যালান্ট’ (The Wild Gallant) মঞ্চস্থ করেন। এটি ছিল একটি কমেডি নাটক। তাঁর পরবর্তী ট্র্যাজেডি নাটক ‘দি ইন্ডিয়ান কুইন’ (The Indian Queen) বেশ সাফল্য লাভ করে এবং নাট্যকার হিসেবে ড্রাইডেনের নাম ছড়িয়ে পড়ে।
এরপর প্লেগ মহামারীর কারণে থিয়েটার বন্ধ হয়ে যায় কিছুদিনের জন্য। আবার যখন থিয়েটার হল খোলা হয়, তখন প্রথম অভিনীত হয় ড্রাইডেনের বিখ্যাত নাটক ‘সিক্রেট লাভ’ (Secret Love), যার আরেক নাম “দি ম্যাডেন কুইন’ (The Malden Queen)। ১৬৬৮ সালে তিনি কিলিগ্রিও কোম্পানির সাথে এক চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তির শর্ত মোতাবেক তাদেরকে প্রতি বছর কমপক্ষে তিনটি নাটক লিখে দিতে হবে এবং তার বিনিময়ে তিনি পাবেন মোট আয়ের ১০% রয়্যালটি। এতে করে তাঁর প্রতি বছর আয় হবে ৩০০ থেকে ৪০০ পাউন্ড। ড্রাইডেন অবশ্য বছরে তিনটি নাটক দিতে পারতেন না। একটি করে দিতেন। কিন্তু এই একটি নাটক দিয়েই তিনি বছরে ৩০০-৪০০ পাউন্ড রয়্যালটি পেতেন।
চুক্তি মোতাবেক তিনি ১৬৬৯ সালে লেখেন টাইরানিক লাভ’ (Tyrannick Love ) নামের একটি নাটক। এই একই বছরে (১৬৬৯) ডিসেম্বরে লেখেন “দি কনকুয়েস্ট অব গ্রানাড়া বাই দি স্প্যানিয়ার্ডস’ (The Conquest of Granada by the Spaniards)। তিনি ১৬৭৩ সালে লেখেন ‘ম্যারেজ আ-লা- মোড’ (Marriage A-La Mode) শীর্ষক একটি নাটক। ১৬৭৬ সালে লেখেন তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটক ‘আওরঙ্গজেব’। ১৬৭৭ সালে লেখেন ‘অল ফর লাভ’ (All for love)। এটি তিনি রচনা করেন শেক্সপীয়রের অ্যান্টোনিও ক্লিওপেট্রা নাটকের কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে। ১৬৯০ সালে তিনি রচনা করেন ‘ডন সেবাস্টিয়ান, কিং অব পর্তুগাল’ (Don Sebastian, King of Portugal), ১৬৯১ সালে লেখেন ‘কিং আর্থার’ (King Arthur)। ড্রাইডেন ১৬৬০ সাল থেকে ১৬৮০ সাল পর্যন্ত প্রায় একনিষ্ঠভাবে নাটক লিখেছেন।
কেবল নাটক নয় কবিতা লেখাতেও ড্রাইডেন আগেই তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। ১৬৮১ সালের লেখেন ‘অ্যাবসালোম অ্যান্ড অ্যাচিটোফেল’ (Absalom and Achitophel)। ১৬৮২ সালে প্রকাশিত হয় ড্রাইডেনের সর্ব শ্রেষ্ঠ কীর্তি – ম্যাক ফ্লেকনো (Mac Flecknoe )। ড্রাইডেনের নিজের ভাষায়, ১৬৮২ সালটি ছিল তাঁর কবিতা রচনার ক্ষেত্রে একটি বিস্ময়কর বছর। ১৬৮৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর আরেকটি বিখ্যাত কাব্য ‘দি হিন্দ অ্যান্ড দি প্যান্থার’ (The Hind and the Panther)। ১৬৯৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘আলেকজান্ডার’স ফিস্ট’ (Aliexander’s Feast)। ১৭০০ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর একটি অনুবাদমূলক রূপকথার গদ্যগ্রন্থ ‘ফ্যাবলস্ অ্যানসিয়েন্ট অ্যান্ড মডার্ন’ (Fables Ancient and Modern)।
১৭০০ সালের ১২ মে লন্ডনে জন ড্রাইডেনের মৃত্যু হয়।
One comment