সববাংলায়

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

বিখ্যাত বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক এবং প্রথিতযশা কবি হিসেবে বিখ্যাত বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত (Buddhadeb Dasgupta)। ‘উত্তরা’, ‘তাহাদের কথা’, ‘দূরত্ব’, ‘কালপুরুষ’, ‘চরাচর’, ‘টোপ’, ‘উড়োজাহাজ’ ইত্যাদি তাঁর নির্মিত বিখ্যাত সব চলচ্চিত্র। এর মধ্যে ‘দূরত্ব’, ‘তাহাদের কথা’, ‘উত্তরা’ ইত্যাদি ছবির জন্য পুরস্কৃতও হয়েছিলেন তিনি। এছাড়াও ‘হিমযুগ’, ‘রোবটের গান’, ‘ছাতা কাহিনি’, ‘গভীর আড়ালে’ ইত্যাদি তাঁর লেখা বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। বাংলা ভাষায় ছবি করলেও, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের বেশিরভাগ ছবিই আন্তর্জাতিক স্তরে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেছে। ষাটের দশকের বাঙালি কবিদের মধ্যে তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য। সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর হিসেবেও বহুদিন কাজ করেছেন তিনি। স্বপ্ন, জাদু বাস্তবতার মিশেলে তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রগুলি যেন নিজেই একেকটি আস্ত কবিতা।

১৯৪৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পুরুলিয়ার আনাড়া গ্রামে এক বৈদ্য পরিবারে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের জন্ম হয়। তাঁর বাবা তারাকান্ত দাশগুপ্ত ভারতীয় রেলওয়ে বিভাগের একজন ডাক্তার ছিলেন। তাঁর নয় সন্তানের মধ্যে বুদ্ধদেব ছিলেন তৃতীয় সন্তান। পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুরে তাঁদের আদি বাড়ি ছিল। দেশভাগের পর প্রথমে তাঁদের পরিবার এসে ওঠে কলকাতার হাজরা রোডে তাঁর মামার বাড়িতে। তাঁর মামা ছিলেন বিখ্যাত কবি ও সম্পাদক সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত। সেখানে শৈশবে ফেরিওয়ালাদের হাতে বানানো বাংলাদেশের বাখরখানি খাওয়ার স্মৃতি তাঁর কাছে অক্ষয় হয়েছিল বহুদিন। পরে পুরুলিয়া গ্রামে বসবাস করতে শুরু করেন তাঁরা। সেখানকার আনাড়া গ্রাম ছিল একটি রেলওয়ে কলোনি যেখানে তাঁর বাবাই ছিলেন একমাত্র ডাক্তার। রেলওয়ে বিভাগে চাকরি করার সুবাদে বাবার বদলির চাকরির জন্য শৈশবে অনেক জায়গাতেই ঘুরেছেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। মাত্র ১২ বছর বয়সে তাঁকে কলকাতায় পড়তে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পরে প্রথমে পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়গপুরে এবং পরে ছত্তীশগড়ের মনীন্দ্রগড়ে তাঁর বাবার বদলি হয়। বিন্ধ্য পর্বতের কাছাকাছি একটা জায়গা ছিল এই মনীন্দ্রগড় যেখানে সেই সময় নাকি প্রায়ই বাঘের ডাক শোনা যেত। শৈশবে মনীন্দ্রগড়ের জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোই ছিল বুদ্ধদেবের অবসর যাপনের একমাত্র পন্থা। আর দিদি ও অন্যান্য সঙ্গী-সাথীদের সঙ্গে তিনি পিঁপড়ে নিয়ে খেলা করতেন। তিনি দেখেছেন সেই সময় গ্রামে গাছের গায়ে একটা বাক্স ঝোলানো থাকত যেখানে লোকেরা নিজেদের চিঠি ফেলে আসতো আর তারপর বাক্সের গায়ে কান লাগিয়ে সেই সব চিঠির কথা শুনত তারা। আবার খড়গপুরে থাকার সময়েই বাঘের নাচ দেখেছিলেন তিনি। এইসব দৃশ্যপট পরবর্তীকালে তাঁর অনেক ছবিতেই ধরা পড়েছে। পরবর্তীকালে তাঁর কন্যা অলকানন্দা দাশগুপ্ত একজন স্বনামধন্য ধ্রুপদী পিয়ানোবাদক হিসেবে বিখ্যাত হন।   

আরও পড়ুন:  নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

প্রথমে তিনি শিবপুর এসএসপিএস বিদ্যালয়ে এবং পরে হাওড়ার দীনবন্ধু স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। পরবর্তীকালে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন বুদ্ধদেব। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার ইচ্ছে থাকলেও অঙ্ক নেওয়ার ভয়ে তিনি প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হননি। স্কটিশ চার্চ কলেজে রাশিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক তরুণ সান্যাল বুদ্ধদেবকে নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন। তাঁর বাড়িতে বসেই দীর্ঘক্ষণ ধরে মোৎসার্ট, বেঠোভেন, বাখের সঙ্গীত শুনতেন তিনি। পশ্চিমি ধ্রুপদী সঙ্গীতের প্রতি সেই সময় থেকেই বুদ্ধদেবের আকর্ষণ বেড়ে ওঠে। অর্থনীতির প্রতি তাঁর ভালবাসা জন্মেছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন অর্থনীতির অধ্যাপক অসীম দাশগুপ্তের হাত ধরে। বুদ্ধদেব ভেবেছিলেন বৃত্তি নিয়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পড়াশোনা করবেন, কিন্তু স্নাতকোত্তরে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হতে না পারায় তা আর হয়ে ওঠেনি।  

বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে শ্যামসুন্দর কলেজের একজন অর্থনীতির লেকচারার হিসেবে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। তারপর তিনি কলকাতার সিটি কলেজেও অধ্যাপনা করেছেন। ১৯৭৬ সাল নাগাদ অর্থনীতি পড়ানোর প্রতি আর আগ্রহ পাচ্ছিলেন না তিনি, তাছাড়া সেকালের সমাজ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিও তাঁকে অন্য কিছু ভাবতে বাধ্য করেছিল। ফলে সেই সময় থেকেই তিনি ছবি বানাতে শুরু করেন। ইতিমধ্যে ছোটবেলা থেকেই কাকার সঙ্গে তিনি যে কলকাতা ফিল্ম সোসাইটিতে যেতেন, সেখানে একের পর এক আন্তর্জাতিক স্তরের বিখ্যাত চিত্র-পরিচালকদের ছবি দেখতে থাকেন। আকিরা কুরোসাওয়া, চার্লি চ্যাপলিন, ইঙ্গমার বার্গম্যান, ভিত্তোরিও ডি সিকা, রবার্তো রোসেলিনি, আন্তোনিওনি প্রমুখদের ছবি দেখতে শুরু করে তাঁর চিন্তা-চেতনাও বদলাতে শুরু করে। ক্রমে ক্রমে নিজেকে প্রকাশের অন্যতম শক্তিশালী পথ হিসেবে ছবি বানানোকেই স্বীকৃতি দেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। ১৯৬৮ সালে ‘দ্য কন্টিনেন্ট অফ লাভ’ নামে একটি ১০ মিনিটের তথ্যচিত্র নির্মাণের মধ্য দিয়েই তিনি চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন। পরে ১৯৭৮ সালে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন ‘দূরত্ব’ নামে। এরইমধ্যে কবিতা লেখাও চলছে তাঁর। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ‘অন্তর্জলী’ নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু এর একটা সংখ্যা বেরিয়েই পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। তবে একথা অনস্বীকার্য যে চলচ্চিত্রের আগে কবিতাই ছিল বুদ্ধদেবের প্রথম প্রেম। মাত্র উনিশ বছর বয়সে তাঁর প্রথম কবিতার বই প্রকাশ পায়। ভাস্কর চক্রবর্তী, সুব্রত চক্রবর্তী প্রমুখদের সঙ্গে তাঁর গাঢ় সখ্যতা ছিল।

আরও পড়ুন:  আখলাখউর রহমান কিদওয়াই

তাঁর বেশিরভাগ ছবিতেই প্রাধান্য পেয়েছে জাদু-বাস্তবতা এবং ফ্যান্টাসি। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের নির্মিত বিখ্যাত ছবিগুলির মধ্যে অন্যতম হল ‘নিম অন্নপূর্ণা’ (১৯৭৯), ‘গৃহযুদ্ধ’ (১৯৮২), ‘ফেরা’ (১৯৮৮), ‘বাঘ বাহাদুর’ (১৯৮৯), ‘তাহাদের কথা’ (১৯৯২), ‘চরাচর’ (১৯৯৩), ‘লাল দরজা’ (১৯৯৭), ‘উত্তরা’ (২০০০), ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’ (২০০২), ‘কালপুরুষ’ (২০০৮), ‘জানালা’ (২০০৯), ‘অর্জুন’ (২০১২), ‘আনোয়ার কা আজব কিস্‌সা’ (২০১৩), ‘টোপ’ (২০১৭), ‘উড়োজাহাজ’ (২০১৮) ইত্যাদি। এছাড়াও টেলিভিশনের জন্যেও কিছু ছবি, তথ্যচিত্র ইত্যাদি নির্মাণ করেছিলেন তিনি। তার মধ্যে অন্যতম হল ‘ঢোলের রাজা ক্ষীরোদ নট্ট’ (১৯৭৩), ‘ফিশারমেন অফ সুন্দরবন’ (১৯৭৪), ‘রিদ্‌ম অফ স্টিল’ (১৯৮১), ‘বিজ্ঞান ও তার আবিষ্কার’ (১৯৮০), ‘সেরামিক্স’ (১৯৮৬), ‘আরণ্যক’ (১৯৯৬), ‘কন্টেম্পোরারি ইন্ডিয়ান স্কাল্পচার’ (১৯৮৭), ‘হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়ান জুট’ (১৯৯০) ইত্যাদি।

২০০৭ সালে এথেন্স আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন এথিনা পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। ২০০৮ সালের ২৭ মার্চ মাদ্রিদে আয়োজিত স্পেন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট পান। এছাড়া নানা সময় তাঁর বিভিন্ন ছবির জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। ‘বাঘ বাহাদুর’, ‘চরাচর’, ‘লাল দরজা’, ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’, ‘কালপুরুষ’ ইত্যাদি শ্রেষ্ঠ ছবির তালিকায় পুরস্কার পায়। ‘উত্তরা’ এবং ‘স্বপ্নের দিন’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ পরিচালকের সম্মান পান তিনি। ‘ফেরা’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যের পুরস্কার পান তিনি। এছাড়া ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে ‘উত্তরা’ সিলভার লায়ন ও গোল্ডেন লায়ন এবং ‘গৃহযুদ্ধ’ ছবিটিও গোল্ডেন লায়ন পুরস্কার পায়। বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘ফেরা’ এবং ‘চরাচর’ ছবিটি গোল্ডেন বিয়ার পুরস্কার পায়। এশিয়া প্যাসিফিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘জানালা’ ছবিটি, ব্যাঙ্কক আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’ ছবিটি শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে পুরস্কৃত হয়।  

২০২১ সালের ১০ জুন ৭৭ বছর বয়সে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের মৃত্যু হয়।    

error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন।

Discover more from সববাংলায়

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

চৈতন্যদেবের অসামান্য জীবনী দেখুন

চৈতন্য জীবনী

ভিডিওটি দেখতে ছবিতে ক্লিক করুন