ক্যারম খেলা

ক্যারম খেলা

ঘরে বসে খেলা যায় এই রকম যত খেলা রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম একটি জনপ্রিয় খেলা হল ক্যারম (Carrom)। এটি মূলত টেবিলের ওপর রেখে খেলা হয় বলে একে ‘টেবিলটপ গেম’ বলা হয়ে থাকে। সাধারণত মনে করা হয়ে থাকে এই খেলার জন্ম ভারতে তবে এ বিষয়ে কোন লিখিত প্রমাণ নেই। খেলাটি বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন নামে পরিচিত এবং ভারতীয় উপমহাদেশেই সবচেয়ে জনপ্রিয়। দক্ষিণ এশিয়ায় অনেক ক্লাব ও ক্যাফে নিয়মিত ক্যারম টুর্নামেন্টের আয়োজন করে থাকে। এই খেলা সর্বনিম্ন দুজন এবং সর্বোচ্চ চারজনে খেলা যায়। আবার টুর্নামেন্টে দুজনের দলও থাকতে পারে। বিশ শতকের গোড়ার দিকে যুক্তরাজ্য এবং কমনওয়েলথে খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ক্যারম খেলা।

প্রচলিত ধারণা অনুসারে মনে ক্যারম খেলার উৎপত্তি আঠারো শতকে ভারতবর্ষে।  সাধারণত ভারতীয় রাজামহারাজারা এই খেলা খেলতেন। ভারতের পাতিয়ালার একটি প্রাসাদে এখনও কাঁচের তৈরি একটি ক্যারম বোর্ড সংরক্ষিত রয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এটি জনসাধারণের মধ্যে ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতে রাজ্যস্তরের ক্যারম প্রতিযোগিতাও অনুষ্ঠিত হত। ‘ক্যারম’ শব্দটির উৎপত্তি সম্ভবত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তিমুরে। এই খেলা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকমভাবে খেলা হয়ে থাকে। ফলে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন নিয়মকে  একত্রিত করেই ক্যারম খেলার বর্তমান নিয়মগুলিকে তৈরি করা হয়েছে।

১৯৩৫ সালে শ্রীলঙ্কায় প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে ক্যারম খেলা শুরু হয়। ১৯৫৮ সাল নাগাদ ভারত ও শ্রীলঙ্কা উভয়েই ক্যারম ক্লাবের অফিসিয়াল ফেডারেশন গঠন করে। বিভিন্ন দেশে ক্যারমের বিভিন্নরকম রূপ রয়েছে। পাকিস্তানে এই খেলা ‘ডুবু’ নামে পরিচিত, আবার জাপানে এই খেলা ‘টোকিউবান’ নামে খ্যাত। মেক্সিকান ঘরানার ক্যারম আবার ‘ফিচাপুল’ নামে পরিচিত।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

১৯৮৮ সালে ভারতবর্ষের চেন্নাইতে আন্তর্জাতিক ক্যারম ফেডারেশন গঠিত হয় বি বাঙ্গারু বাবুর উদ্যোগে। তিনি ভারতের ক্যারম খেলার জনক হিসেবে পরিচিত। ভারতীয় ক্যারমকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদানের পিছনে এই মানুষটির অবদান ভীষণভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক ক্যারম ফেডারেশনই প্রথম ক্যারমের যাবতীয় নিয়মকানুনকে লিপিবদ্ধ করে। ১৯৮৮ সালে ক্যারম খেলার আনুষ্ঠানিক নিয়মগুলি প্রথম প্রকাশ করা হয়।

ক্যারম খেলাটি একটি চতুর্ভুজ আকৃতির বোর্ডের ওপর খেলা হয়ে থাকে। প্রতি কোণে একটি করে জাল লাগানো পকেট থাকে। বোর্ডের একেবারে কেন্দ্রে থাকে একটি বড় বৃত্ত। সেই বৃত্তকে ঘিরে একটু দূরত্বে চারদিকে দুটি করে রেখার বেসলাইন থাকে। বেসলাইনের চারটি কোনায় চারটি তীর-চিহ্ন আঁকা থাকে। খেলার সময় এই রেখার বাইরে শরীরের কোনো অংশ যাওয়া নিয়মবিরুদ্ধ। প্রতিটি বেসলাইনের দুই প্রান্তে একটি করে বৃত্ত থাকে। খেলার জন্য প্রয়োজন হয় নয়টি সাদা এবং নয়টি কালো সহ মোট আঠারোটি কাঠের গোল ঘুঁটি। এই ঘুঁটিগুলিকে বলা হয়ে থাকে ক্যারমম্যান। সাদা ও কালো ছাড়াও লাল রঙের একটি ঘুঁটি, থাকে যাকে বলা হয় রাণী। উক্ত ক্যারমম্যানদের তুলনায় আকারে কিঞ্চিৎ বড়, সাধারণত প্লাস্টিকের তৈরি গোল স্ট্রাইকার থাকে একটি যেটির সাহায্যে ঘুঁটিগুলিকে আঘাত করে খেলা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রত্যেক খেলোয়াড়ের মূল লক্ষ্যই হল আঙুলের সাহায্যে স্ট্রাইকার দিয়ে মেরে ক্যারমম্যানদের পকেটে ফেলা। একপক্ষের থাকে সাদা ক্যারমম্যান এবং অপরপক্ষের কালো ক্যারমম্যান।

বেশ কিছু নিয়মাবলি মেনে এই খেলা খেলতে হয়। প্রথমত রাণী এবং আঠারোটি ক্যারমম্যানকে কেন্দ্রস্থিত বৃত্তের মধ্যে, সাদার পর একটি কালো ঘুঁটি— সাধারণত এই নিয়ম অনুযায়ী সাজিয়ে রাখা হয়। যাতে সজ্জা বৃত্তের বাইরে না বেরিয়ে পড়ে সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হয়।

একজন রেফারিও থাকেন বড় পেশাদারি টুর্নামেন্টে। তিনি সর্বপ্রথম টস করেন। রেফারি তাঁর একহাতে একটি সাদা ক্যারমম্যান এবং অন্যহাতে কালো একটি ক্যারমম্যান লুকিয়ে রাখেন। যে পক্ষ সঠিকভাবে অনুমান করতে পারে যে কোন হাতে কোন রঙের ক্যারমম্যান রয়েছে সে পক্ষই টস জিতে প্রথম ঘুঁটির বৃত্তে আঘাত করার অধিকার লাভ করে। যে বা যাঁরা প্রথম স্ট্রাইক নেন তাঁদের জন্য সাদা ক্যারমম্যান বরাদ্দ থাকে। তবে টসে জেতা ব্যক্তি চাইলে স্বেচ্ছায় প্রথম স্ট্রাইক বা ব্রেকটি অপরপক্ষের হাতেও তুলে দিতে পারেন এমনকি জায়গাও বদল করার অধিকার রয়েছে টস বিজেতার। তখন প্রতিপক্ষের বরাদ্দ হয়ে যাবে সাদা ঘুঁটি এবং টসে জেতা ব্যক্তিকে কালো ক্যারমম্যান নিয়ে খেলতে হবে। প্রথম স্ট্রাইক নেওয়া ব্যক্তি অর্থাৎ যিনি খেলা শুরু করছেন, তিনি যদি কোনো ঘুঁটি পকেটে ফেলতে না পারেন তবে আপনাআপনিই অপরপক্ষের কাছে স্ট্রাইক চলে যাবে এবং তিনি তখন সাদা বা কালো ক্যারমম্যান, যেকোনো রঙকেই বেছে নিতে পারেন।

লাল ঘুঁটি অর্থাৎ রাণীকে নিজের আয়ত্তে আনার জন্যও রয়েছে কিছু নিয়ম। যে পক্ষ রাণীকে পকেটে ফেলবে তাকে তাঁর নিজের পক্ষের একটি ক্যারমম্যানকে ঠিক তার পরেই ‘কভার’ হিসেবে পকেটে ফেলতে হবে। যদি কেউ তাতে ব্যর্থ হয় তবে রাণীকে পকেট থেকে তুলে এনে পুনরায় বোর্ডের মধ্যস্থিত বৃত্তের কেন্দ্রে স্থাপন করা হয়। আবার ধরা যাক বোর্ডে একটি সাদা, একটি কালো এবং রাণী রয়েছে। সেক্ষেত্রে কেউ যদি রাণীকে পকেটস্থ করার আগে তাঁর নিজের শেষ ক্যারমম্যানটিকে পকেটে ফেলে দেয় তা হবে নিয়মবিরুদ্ধ। কারণ রাণীর জন্য সবসময় একটি ‘কভার’ প্রয়োজন হয়। আবার নয়টির মধ্যে একটি হলেও ক্যারমম্যানকে পকেটস্থ করার পরেই রাণীকে ফেলে পয়েন্ট পাওয়া যাবে, তার আগে নয়। রাণী এবং পক্ষ অনুযায়ী নির্দিষ্ট রঙের কভার ঘুঁটি একই সঙ্গে একটি শটেই যদি পকেটস্থ হয়, তাকেও বৈধ বলে মান্যতা দেওয়া হবে। রাণী কভার হয়ে যাওয়ার পর যে পক্ষ তাঁর বাকি সমস্ত ক্যারমম্যানকে সবার প্রথমে পকেটে ফেলে বোর্ড ক্লিয়ার করতে পারবে সে হবে জয়ী। পরাজিত প্রতিপক্ষের যেকটি ঘুঁটি অবশেষে বোর্ডে থাকবে সেই প্রত্যেক ঘুঁটির জন্য এক পয়েন্ট পাবে জয়ী পক্ষ। উপরন্তু তিনি যদি রাণীকে কভার করতে পারেন তাহলে আরও তিন পয়েন্ট কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাঁচ পয়েন্ট পাবেন তার জন্য। তবে পরাজিত পক্ষ রাণী পেলে কোনো পয়েন্ট সেক্ষেত্রে পাবেন না তিনি৷

একটি খেলা কখনও ২৫ কখনও আবার ২৯ পয়েন্টের হয়। যে প্রথম সেই পয়েন্ট ছুঁতে পারবে সে হবে বিজয়ী৷ ২৫-এ খেলা হলে ২১ পয়েন্টে পৌঁছনোর পর কোনো খেলোয়াড় আর রাণীর জন্য পয়েন্ট পাবেন না। ২৯-এ খেলা হলে কোনো খেলোয়াড় ২৪ পয়েন্টে পৌঁছে গেলে আর রাণীর জন্য পয়েন্ট পাবেন না। বয়স্ক খেলোয়াড়দের জন্য একটি ম্যাচ সম্পূর্ণ করতে মোট আটটি রাউন্ড খেলার নিয়ম আছে। কিন্তু অন্যান্য বয়সীদের জন্য সর্বোচ্চ ৬টি বোর্ড বা রাউন্ডের নিয়ম রয়েছে। একটি শট মারার জন্য একজন খেলোয়াড়কে ১০ সেকেন্ড সময় দেওয়া হয়।

এই খেলায় স্ট্রাইকারটিকে বেসলাইনের দুটি রেখাতেই স্পর্শ করে বসাতে হবে বোর্ডে। কোন কারণে স্ট্রাইকার একটি রেখা স্পর্শ না করলেই তা ফাউল হিসেবে গণ্য হবে৷ বেসলাইনের চারকোণে চারটি যে তীর-চিহ্ন থাকে সেগুলিতেও স্ট্রাইকার স্পর্শ করলে তা নিয়মবিরুদ্ধ কাজ হবে।

শট মারার সময় স্ট্রাইকারটিকে ধাক্কা দিয়ে বা ঠেলে কোনো শট মারা যাবে না। স্ট্রাইকারটি পকেটে পড়ে গেলে তা পেনাল্টি বা ফাউল হিসেবে গণ্য হবে। আবার একটি শটে ঘুঁটিসমেত স্ট্রাইকার পকেটে পড়লে সেক্ষেত্রেও সেই ঘুঁটিটি পুনরায় বোর্ডের মধ্যিখানে এনে স্থাপন করা হয়। আবার নয়টির মধ্যে কোনো ঘুঁটি পকেটে পড়ার আগেই যদি স্ট্রাইকার পকেটে পড়ে যায় প্রথমে, তাহলে প্রথম ঘুঁটি পড়বার পরেই সেটিকে ফাইন হিসেবে বোর্ডে ফেরত দিয়ে দিতে হয়। প্রথম শটেই কোনো ক্যারমম্যানের আগেই যদি রাণীকে পকেটে ফেলা হয় তবে সেটিও ফাইন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কোনো ক্যারমম্যান বোর্ড থেকে ছিটকে বাইরে চলে গেলে তাকে বোর্ডের মাঝে এনে রাখা হয়। যদি কোনো খেলোয়াড় তার প্রতিপক্ষের ঘুঁটি ফেলে দেয় তবে সে তার একটি টার্ন হারায়। একজন ঘুঁটি পকেটস্থ না করতে পারলে স্ট্রাইকটি ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিক অনুযায়ী তার পাশে বসা প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়ের কাছে চলে যায়।

পেশাদার ক্যারম ছাড়াও, পয়েন্ট ক্যারম, ফ্যামিলি-পয়েন্ট ক্যারম, টোটাল পয়েন্ট ক্যারম ইত্যাদি নানারকম ফরম্যাট রয়েছে এই খেলাটির। এই সমস্ত ফরম্যাটগুলিতে প্রত্যেক ক্যারমম্যানের জন্য বরাদ্দ পয়েন্টের হেরফের রয়েছে। তবে অন্যান্য কয়েকটি বিশেষ নিয়মও রয়েছে ফরম্যাটগুলির জন্য।

বিভিন্ন দেশে ক্যারমের জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়। ক্যারম টুর্নামেন্টের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল: ওয়ার্ল্ড ক্যারম চ্যাম্পিয়ন, ওয়ার্ল্ড জুনিয়র ক্যারম চ্যাম্পিয়নশিপ, এশিয়ান ক্যারম চ্যাম্পিয়নশিপ, ইন্টারন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন অব চ্যাম্পিয়নস টুর্নামেন্ট, সার্ক (SAARC) কান্ট্রিজ ক্যারম চ্যাম্পিয়নশিপ প্রভৃতি। কমনওয়েলথ গেমেও ক্যারম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই খেলার একজন বিখ্যাত খেলোয়াড় হলেন এ. মারিয়া ইরুদয়াম। তিনি দুইবার বিশ্ব ক্যারম চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। এছাড়াও আরও কয়েকজন কৃতী ক্যারম খেলোয়াড় হলেন চামিল কোরে, কে শ্রীনিবাস, পিয়েরে ডুবইস, রশ্মি কুমারী, এস ইলাভাজাগি, বি রাধাকৃষ্ণণ, পারমি নির্মলা, রবিবর্মণ শর্মিলা প্রমুখ।

আপনার মতামত জানান