উত্তর কলকাতার পুজো দেখতে ভালোবাসেন আর ছাতুবাবু লাটুবাবুদের পুজো দেখেননি এমন বাঙালি খুব কমই আছেন। কলকাতা শহরের সুপ্রাচীন বনেদি দুর্গাপুজোগুলির মধ্যে এই ছাতুবাবু-লাটুবাবুদের দুর্গাপুজো অন্যতম। বিডন স্ট্রীটের একটা অংশে আজও বসে ছাতুবাবু-লাটুবাবুর বাজার আর এই বাজারের শেষপ্রান্তে গেলেই দেখা মিলবে বিশাল প্রাসাদোপম ছাতুবাবু-লাটুবাবুদের রাজবাড়ি। সাবর্ণ রায়চৌধুরীর পুজো, হাটখোলার দত্তবাড়ির পুজো কিংবা লাহাদের পুজোই হোক, সমান তালে পাল্লা দিয়ে সেই সুদূর ১৭৭০ সাল থেকে পুরনো ঐতিহ্য বজায় রেখে এই পুজো চলে আসছে। সাধারণত বনেদি বাড়ির প্রধান জমিদার বা বংশপ্রধানদের নামানুসারেই পুজোর নামকরণ লোকমুখে চালু হয়ে যায়। এখানেও তার অন্যথা হয়নি। কিন্তু প্রশ্ন হল কে এই ছাতুবাবু-লাটুবাবু? প্রশ্ন যখন জেগেছে, উত্তরও তো জানা চাই। তাহলে চলুন আর দেরি না করে জেনে নিই ছাতুবাবু লাটুবাবুদের পুজোর অন্দরমহলের নানা তথ্য।
ছাতুবাবু লাটুবাবুদের পুজো শুরু করেছিলেন রামদুলাল দে। প্রাচীন কলকাতার এক ধনাঢ্য বাবু ছিলেন এই রামদুলাল দে সরকার। তা এই রামদুলাল ব্রিটিশ আমলে প্রভূত অর্থসম্পদের মালিক হয়েছিলেন। ব্রিটিশরা সে সময় সদ্য দেওয়ানি লাভ করে কলকাতা সহ বাংলার বিভিন্ন জায়গায় মুক্ত বাণিজ্য শুরু করেছে। ফরাসি, ওলন্দাজরা সব অন্তর্হিত। ব্রিটিশদের এই একচেটিয়া বাণিজ্যের সূত্র ধরে কিন্তু রামদুলাল ধনী হননি। তিনি ব্যবসায়ী ছিলেন একথা সত্য, কিন্তু তাঁর ব্যবসা ছিল মূলত আমেরিকানদের সঙ্গে। মার্কিন মুলুকে আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা করে সেই সময় কোটিপতি হয়েছিলেন রামদুলাল দেব। মশলা আর বাংলাদেশি মসলিন কাপড়ের রপ্তানির ব্যবসা করতেন রামদুলাল যা আমেরিকার স্বাধীনতালাভের পর আরো বর্ধিত হয়। এমনকি আমেরিকা থেকেও নানারকম পণ্য আসতো। শোনা যায় আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনও রামদুলালের ব্যবসায়িক সমৃদ্ধির প্রশংসা করতেন এবং আমেরিকার একটি জাহাজের নামকরণ করা হয়েছিল তাঁরই নামে – ‘Ramdulal De’ যে জাহাজটি আমেরিকার বস্টন থেকে কলকাতায় এসে পৌঁছেছিল। তিনিই বাংলার প্রথম ইন্দো-আমেরিকান ব্যবসার পথিকৃৎ। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসেছিলেন রামদুলাল। ঐতিহাসিক তথ্য অনুসারে শৈশবেই মা-বাবার মৃত্যু হলে দাদু-দিদার কাছে মানুষ হন তিনি। হাটখোলার দত্তবাড়িতে রাঁধুনির কাজ করে তাঁর দিদা রামদুলালকে মানুষ করেন। হাটখোলার মদনমোহন দত্তের কাছে প্রথমে পাঁচ টাকা বেতনের কেরানির চাকরি দিয়ে জীবন শুরু হলেও পরে এক লক্ষ টাকায় একটি জাহাজের নিলাম করে দক্ষতা দেখালে, মদনমোহন দত্ত তাঁকেই এই এক লক্ষ টাকা দান করে নিজস্ব ব্যবসা শুরু করতে উৎসাহ দেন। বাংলার প্রথম কোটিপতি হয়েছিলেন এই রামদুলাল দেব আর তিনিই বিডন স্ট্রিটের এই বাড়িতে প্রথম দুর্গাপুজো প্রচলন করেন। বিডন স্ট্রিটে ততদিনে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘রামদুলাল নিবাস’ বাবু সমাজের প্রতিভূ হয়ে উঠেছে। সময়টা ১৭৭০ সাল। রামদুলাল দেবের মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র আশুতোষ নাথ দেব ও প্রমথনাথ দেব এই পুজোর দায়ভার গ্রহণ করেন। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় আশুতোষ নাথ এবং প্রমথনাথই ছাতুবাবু-লাটুবাবু নামে পরিচিত হন লোকসমাজে। রামদুলালের দুই পুত্র কলকাতার বাবুয়ানিতে বেশ দড় হয়ে ওঠেন ক্রমশ। পিতা রামদুলাল উভয়ের জন্যই কোটি টাকার সম্পদ রেখে গিয়েছিলেন। ছাতুবাবু কিংবা লাটুবাবু উভয়েরই বুলবুলির লড়াইয়ের শখ ছিল। জানা যায়, ছাতুবাবুই ছিলেন প্রথম বাঙালি সেতারবাদক, সঙ্গীতের প্রতি তাঁর বিশেষ অনুরাগের কথা সাধারণের মধ্যে বেশ সমাদৃত ছিল। রামদুলাল নিবাসের নাচঘরে নর্তকী গওহরজান, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, গুলাম আলি খান, ভিলায়েত খাঁ, রোশন কুমারী প্রমুখ ধ্রুপদী নৃত্য ও ধ্রুপদী উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তাবড় ব্যক্তিত্ব সকলেই এসে অনুষ্ঠান করে গিয়েছেন। দুর্গাপুজোর ইতিহাসটিও ের সঙ্গেই জড়িয়ে গিয়েছে সেই সুদূর ১৭৭০ সাল থেকে।
অন্যান্য বনেদি বাড়ির পুজোর মতো ছাতুবাবু-লাটুবাবুদের পুজোরও কিছু স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ট্য আছে। এখানে দেবী দুর্গা দশমহাবিদ্যা রূপে পূজিত হন। প্রতিপদ থেকে ষষ্ঠী পর্যন্ত পুজো হয় একটি শালগ্রাম শিলায় এবং ঘটে। সপ্তমীর দিন কলাবউ স্নান করানোর পর থেকে প্রতিমাপুজোর সূত্রপাত হয়। মোট দশদিন ধরে পুজো চলে রামদুলাল নিবাসে। অদ্ভুত বিষয় হল, এখানে শাক্ত, বৈষ্ণব এবং শৈব এই তিন ভিন্ন মতেই পুজো করা হয়। সাবেকি পুজোর মতো একচালার দেবী প্রতিমা এখানে পূজিত হন বৃহৎ নান্দীকেশ্বর পুরাণ অনুসারে। লক্ষ্মী ও সরস্বতী এখানে দেবীর দুই পাশে জয়া ও বিজয়া রূপে অধিষ্ঠিত। লক্ষ্মীর ঝাঁপি কিংবা সরস্বতীর বীণা কোনোটাই এখানে উপস্থিত থাকে না, বরং লক্ষ্মী সরস্বতী উভয় দেবীই এই প্রতিমায় পদ্মাসনে অধিষ্ঠিতা। বহুমূল্য অলঙ্কারে সজ্জিত মা দুর্গার বাহন সিংহের মুখ এখানে ঘোড়ার অনুরূপ। সন্ধিপুজোর সময় রামদুলাল নিবাসে আজও একশো আটটি প্রদীপ জ্বেলে আরাধনা করা হয়। অষ্টমীর দিন এই বাড়িতে কুমারীপুজো হয় নিষ্ঠাভরে। আর এই দিনই পুজো শেষে বাড়ির মহিলারা নিজেদের মধ্যে সিঁদুর খেলেন যা ছাতুবাবু-লাটুবাবুদের পুজোর একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এখানকার দেবী প্রতিমার যে বাঁশের কাঠামো সেটি রেখে দেওয়া হয় এবং রথযাত্রার দিন ঐ কাঠামোটি পুজো করা হয়। দেবীর চালচিত্রের উপরের দিকটি তিনটি অংশে বিভক্ত যাকে মোটাচুরি বলা হয়। জয়া-বিজয়ার উপরে একটি পদ্ম দেখা যায় আর তার পিছনে থাকেন শিব, রামচন্দ্র এবং হনুমান। রিপুবলির প্রথা মেনে চালকুমড়ো, আখ ইত্যাদি বলি দেওয়া হয় এখানে। আগে যদিও এখানে পশুবলি হতো। কিন্তু এক অষ্টমীর দিনে বলিপ্রদত্ত ছাগল একবার ভয়ে রামদুলালের পায়ের কাছে আশ্রয় নিলে, সেইদিন থেকেই রামদুলাল নিজেই দুর্গাপুজোয় বলিপ্রথা বন্ধ করে দেন। তবে এই রামদুলাল নিবাসের পূজায় নীলকণ্ঠের উপাচারটি বেশ আকর্ষণীয়। কোকিলের মতোই দেখতে ধূসর গায়ের একটি পাখি নীলকণ্ঠ যার গলার কাছটা সোনালি বা বাদামি রঙের আর ডানার পালক সব নীল রঙের হয়ে থাকে। দশমীতে দেবী প্রতিমার বিসর্জনের সময় দুটি নীলকণ্ঠ পাখিকে মুক্ত আকাশে উড়িয়ে দেওয়ার প্রাচীন রীতি আজও সমানভাবে চলে আসছে ছাতুবাবু-লাটুবাবুদের পুজোয়। মনে করা হয় যে দুটি পাখির মধ্যে একটি কৈলাশে গিয়ে দেবীর আগমনবার্তা জানায় সকলকে আর অন্য পাখিটি ঘরে ফিরে দেবী যে নিরাপদে পৌঁছেছেন সেই সংবাদ জ্ঞাপন করে। প্রায় ৭৯ রকমের ভোগ নিবেদন করা হয় দেবী দুর্গাকে যার মধ্যে কখনো নুন দেওয়া হয় না। এই সব প্রাচীন রীতি বহন করে আজও ছাতুবাবু-লাটুবাবুর পুজো দেখতে ভিড় জমে যায় বিডন স্ট্রিট জুড়ে।
বিভিন্ন বনেদী বাড়ির পূজা নিয়ে বিস্তারিত তথ্য ভিডিও আকারে দেখুন এখানে
One comment