ছন্দা গায়েন

ছন্দা গায়েন

ভারতবর্ষ বহু এমন পর্বতারোহীর দেশ যাঁরা সমস্ত বিশ্বের প্রশংসা লাভ করেছে। যাঁদের কৃতিত্ব আগামী প্রজন্মকে দুর্গমের দিকে পা বাড়ানোর সাহস দেয়। এমনই একজন প্রথিতযশা পর্বতারোহী হলেন ছন্দা গায়েন (Chhanda Gayen)। তিনি মূলত পরিচিত দুটি আটহাজার মিটার উচ্চতার পর্বত, মাউন্ট এভারেস্ট এবং মাউন্ট লোটসে একটি অভিযানেই সবচেয়ে দ্রুত জয় করবার জন্য। ভারতবর্ষে এই কৃতিত্ব প্রথম তাঁরই। বাইশ ঘন্টা সময়ের মধ্যে মাউন্ট এভারেস্টের শীর্ষ থেকে মাউন্ট লোটসের শীর্ষে পৌঁছেছিলেন তিনি। কেবল পর্বতারোহীই নন, মার্শাল আর্টে তিনি ছিলেন দক্ষ এবং আত্মরক্ষা পদ্ধতির শিক্ষকতা করতেন। তবে এত প্রতিভাবান একজন পর্বতারোহী আরও নতুন নতুন কৃতিত্ব অর্জনের সুযোগ পাননি। একবার কাঞ্চনজঙ্ঘার শীর্ষ ছোঁবার পরও সবচেয়ে কঠিন পথটি দিয়ে আরেকবার শীর্ষ স্পর্শ করার জন্য নির্ভয়ে এগিয়েছিলেন। কিন্তু সেই অভিযানের সময় তুষারধ্বসে দুজন শেরপাসহ নিঁখোজ হয়ে যান ছন্দা। তারপর থেকে আর কোনো হদিশ পাওয়া যায়নি তাঁর। আপাতত তাঁকে মৃত বলেই মনে করা হয়।

১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত হাওড়া জেলার কোনা বাগপাড়ায় এক কায়স্থ পরিবারে পর্বতারোহী ছন্দা গায়েনের জন্ম হয়। তাঁর বাবা পশুপতি গায়েনের উৎসাহতেই এনসিসিতে (NCC) যোগ দিয়েছিলেন তিনি। মা জয়া গায়েন নিজে শখে ট্রেকিং করতেন। মায়ের থেকেও কিছুটা অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত ডানপিটে গোছের মেয়ে ছিলেন ছন্দা। এনসিসি ছাড়াও কোরিয়ান মার্শাল আর্টের একটি ধরন তাইকোন্ডোর প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন এবং তাতে জেলা চ্যাম্পিয়নও হয়েছিলেন। এছাড়াও আরও নানাদিকে পারদর্শী ছিলেন ছন্দা গায়েন ৷ নাচ, গান, সাঁতার এমনকি রান্নাবান্নাতেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। এমনকি পর্বতারোহণ শুরু করার পরেও পারিবারিক ব্যবসার কাজও তিনি সামলাতেন। দুগ্ধজাত পণ্য বিক্রয়ের ব্যবসা করতেন তাঁরা। অবসরে আবার ছুটে যেতেন পাহাড়ের টানে। এনসিসিতে যোগ দেওয়ার পর থেকেই পাহাড়ে চড়ার প্রতি তাঁর একটি আকর্ষণ জন্মাতে শুরু করে। আজন্ম সেই দুর্মর ইচ্ছেকে লালন করে গেছেন তিনি সযত্নে। বাইরে থেকে তাঁর স্বাস্থ্যের গড়ন দেখলে হয়ত তাঁর পর্বতারোহণের শারীরিক সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন জাগতে পারত। কিন্তু নিয়মিত সাঁতার, তাইকোন্ডো অভ্যেস করা, এনসিসির সদস্য একজন মানুষ যে আসলে ভিতর থেকে কতখানি শক্তপোক্ত তার উৎকৃষ্ট একটি উদাহরণ অবশ্যই ছন্দা গায়েন নিজে। কেবল পর্বতারোহণ নয়, অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে অভিযান শেষ করার কৃতিত্ব অর্জন করে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন শারীরিক বলের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক দৃঢ়তা এবং অদম্য জেদ ও একাগ্রতা কতখানি প্রয়োজন সাফল্যের জন্য।

ছন্দা গায়েন বাণিজ্য বিভাগে পড়াশুনা স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। ১৯৯৮ সালে ইনস্টিটিউট অব এক্সপ্লোরেশনে ভর্তি হন তিনি এবং সেখান থেকে প্রাথমিক স্তরের রক ক্লাইম্বিং-এর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন। উৎসাহ এবং স্বপ্ন দুইই বাড়তে থাকে তাঁর। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি একেবারে হাতেকলমে বিভিন্ন ছোট ছোট ট্রেকিং এবং আরোহণ অভিযানে সামিল হচ্ছিলেন তিনি। এছাড়াও পর্বতারোহণের ওপর অনুষ্ঠিত অনেক প্রাসঙ্গিক প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামেও অংশ নিচ্ছিলেন ছন্দা। ২০০৬ সালে দার্জিলিং-এ অবস্থিত হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট থেকে উন্নতমানের প্রশিক্ষণ লাভের সুযোগ পান তিনি। এটা ছিল তাঁর কেরিয়ারের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। নানারকম অভিযানে অংশগ্রহণের সুযোগ এলে পূর্ণমাত্রায় তার সদ্ব্যবহার করছিলেন তিনি৷ ২০০৭ সালে নেহেরু ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিং দ্বারা আয়োজিত আলপাইন ক্লাইম্বিং ক্যাম্পে যোগ দিয়েছিলেন ছন্দা। এরপর মেথড অব ইনস্ট্রাকটারের শিক্ষাগ্রহণে মনোযোগ দেন এবং নিজেকে একজন পর্বতারোহণের প্রশিক্ষক হিসেবে গড়ে তোলার প্রস্তুতি নেন। ২০১২ সালে হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফউন্ডেশন দ্বারা আয়োজিত একটি অ্যাডভেঞ্চার ট্রেকিং ক্যাম্পে যোগ দিয়েছিলেন ছন্দা। একজন ভারতীয় ক্যাডেট হিসেবে এনসিসি দ্বারা আয়োজিত অল ইন্ডিয়া তিনি। এরপর সিকিম ট্রেকে অংশ নেন তিনি। ২০০৭ সালে মাউন্ট ফ্লুটেডের চূড়ায় উঠেছিলেন । পরের বছর একজন ভারতীয় মহিলা হিসেবে মাউন্ট যোগিন ১ এবং মাউন্ট যোগিন ৩-এর শীর্ষে উঠে রেকর্ড করেছিলেন ছন্দা। এরপর ২০০৯ সালে গঙ্গোত্রী অভিযানেও সফলতা অর্জন করেন। ২০১১ সালে ১৭টি আইএমএস ইস্ট জোন স্পোর্টস ক্লাইম্বিং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলেন ছন্দা। সেবছরেই মানিরাং পর্বতের শীর্ষ ছুঁয়েছিলেন তিনি।

এইসমস্ত অভিযানে সফলতা পেলেও তৃষ্ণা এত অল্পতে মেটেনি ছন্দার। ২০১০ সালের এভারেস্ট এবং কাঞ্চনজঙ্ঘা জয়ী বাঙালি বসন্ত সিংহরায়ের দ্বারা প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত ছন্দা বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জয়ের স্বপ্ন দেখছিলেন। কিন্তু এভারেস্ট অভিযানে সামিল হতে বিপুল পরিমাণ প্রায় ২২ লক্ষ টাকার প্রয়োজন। আর্থিক অনটনের মধ্যে দিনযাপন করা ছন্দার পরিবারের পক্ষে অত টাকার যোগান দেওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু এই বিরাট স্বপ্নটাকে এই সাংসারিক প্রতিকুলতার কাছে হেরে যেতে দিতে চাননি তিনি। বিয়ের জন্য সঞ্চিত গয়না বেচে দিতে এতটুকু দ্বিধা হয়নি ছন্দার, এভারেস্টের তুলনায় সেসব নিতান্তই তুচ্ছ তখন তাঁর কাছে। এছাড়াও ধার করে, বিমা ভেঙে অতিকষ্টে অর্থ জোগাড়ের পর ২০১৩ সালের ২৭শে মার্চ বাড়ি থেকে কাঠমান্ডুর উদ্দেশ্যে রওনা হন তিনি৷ সেবার সঙ্গে ছিলেন আরও দুই বাঙালি মহিলা দমদম পার্কের টুসি দাস ও বেলডাঙার মণিদীপা দত্ত। দুর্গম কুম্ভু আইসফল অতিক্রম করে সাউথ কল পেরিয়ে বিশ্বের শীর্ষদেশে পৌঁছনোর লড়াইতে ছন্দা সফল হয়েছিলেন ২০১৩ সালের ১৮ই মে শনিবার ভোর ছটায়। অসামরিক ক্ষেত্রে প্রথম বাঙালি মহিলা ছিলেন তিনি,  যিনি এভারেস্ট জয় করেছেন। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর হল, সেই অভিযানেই এভারেস্ট জয়ের পর মাত্র ২২ ঘন্টার মধ্যে আরও একটি আট-হাজারী শৃঙ্গ মাউন্ট লোটসের শীর্ষদেশ ছুঁয়েছিলেন ছন্দা। তিনি প্রথম ভারতীয় মহিলা যিনি একটিমাত্র অভিযানেই এত দ্রুত দুটি আট হাজার মিটার উচ্চতার পর্বতশৃঙ্গ জয় করেন। 

এভারেস্ট জয়ের কৃতিত্বের জন্য এবিপি আনন্দের তরফ থেকে ‘সেরা আবিষ্কার’ বিভাগে ‘সেরা বাঙালি’ পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়েছিল ছন্দা গায়েনকে।

এভারেস্ট জয়ের পরও থেমে থাকেননি ছন্দা। অভিযানের দিক দিয়ে সবচেয়ে দুর্গম এবং কঠিনতম চ্যালেঞ্জ হল কাঞ্চনজঙ্ঘা জয় করা। নির্দ্বিধায়, নিঃসঙ্কোচে তিনি এগিয়ে গেছেন শৃঙ্গ জয়ের নেশায়। এই অভিযানেও সঙ্গী ছিলেন টুসি দাস। বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হলেও কাঞ্চনজঙ্ঘার পথ এভারেস্টের থেকেও ভয়ংকর। এভারেস্টে যেসমস্ত সুবিধা সহজেই পাওয়া যায় কাঞ্চনজঙ্ঘায় তা যায় না। সেখানে পোর্টার বা মালবাহক পাওয়া মুশকিল। হিমবাহের ওপর দিয়ে দড়ির সাহায্যে দীর্ঘপথ এগোতে হয়। শৃঙ্গ ছোঁয়ার জন্য টানা ১৫/১৬ ঘন্টা চড়তে হয় বিপদসঙ্কুল পথেও। কাঞ্চনজঙ্ঘা পাড়ি দেওয়ার খরচও ছিল প্রায় ৩৫ লক্ষ টাকা। তবুও দমে যাননি ছন্দা। প্রায় ১৮ লক্ষ টাকা ধার করে অভিযানে গিয়েছিলেন তিনি। তাঁদের কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন রিমা শেরপা। ২০১৪ সালের ১৮ই মে আরও তিনজন সঙ্গীর সঙ্গে কাঞ্চনজঙ্ঘার শীর্ষদেশ ছু্ঁয়ে ফেলেন ছন্দা। কিন্তু সেটুকুইতেই আশ মেটেনি তাঁর। কাঞ্চনজঙ্ঘার শৃঙ্গে পৌঁছনোর সবচেয়ে কঠিনতম রাস্তা পশ্চিমদিকের ইয়ালুং কাং-এর পথ ধরে গিয়ে একবার শীর্ষ ছোঁওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাঁকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল সেদিকে। তাঁর আগে প্রায় বারোবছর এই পথ ধরে শৃঙ্গ জয়ের সাহস দেখাননি কেউ৷ সেই অভিযানে ছন্দার সঙ্গী ছিলেন তিনজন শেরপা পেমবা, দাওয়া ও তাশি। সেই পথ অতি সংকীর্ণ, দুদিকে গভীর খাদ। সেই পথ ধরে আরোহণ করে ২০মে শৃঙ্গ স্পর্শ করবার কিছু আগেই প্রকৃতি হঠাৎ বিরূপ হতে শুরু করে। এক ভয়ঙ্কর তুষারধ্বস নেমে আসে তাঁদের ওপর৷ তাশি শেরপা কোনরকমে নিজের প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরে আসতে পারলেও পেমবা ও দাওয়া শেরপা-সহ ভারতের গর্ব ছন্দা গায়েন সেই তুষার-রাক্ষসের কবলে পড়ে নিঁখোজ হয়ে যান। সমতলে সেই খবর এসে পৌঁছনোর পরেই মিংমা শেরপা ছন্দার খোঁজ করবার জন্য হেলিকপ্টার পাঠিয়ে দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ছন্দার কোনো হদিশ মেলে না। দীর্ঘদিন কেটে যাওয়ার পরেও তাঁর কোনোরকম সন্ধান না পাওয়া গেলে ছন্দাকে মৃত বলে ঘোষণা করে নেপাল সরকার।

2 comments

আপনার মতামত জানান