পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত হাওড়া জেলার একটি অন্যতম প্রসিদ্ধ ইতিহাস বিজড়িত জনপদ হল বাগনান। উলুবেড়িয়া সাব ডিভিশনের অন্তর্গত বাগনান, বিধানসভা কেন্দ্র হিসেবে বাগনান-১ ও বাগনান-২ উন্নয়ন ব্লক এই দুটি ভাগে বিভক্ত। এই বাগনান-১ ব্লকের বাকসিহাট গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম দেউলগ্রাম (Deulgram)। হাওড়া জেলার আর পাঁচটা গ্রামের মত আপাত শান্ত একটি পল্লী দেউলগ্রাম কিন্তু এক অর্থে সারা বাংলায় একটি কারণে অনন্য। সমগ্র হাওড়ায় এখানেই একমাত্র মোষের শিংয়ের চিরুনি তৈরি হয়।
দেউলগ্রামের এই চিরুনি শিল্প প্রায় শতাব্দী প্রাচীন। স্বাধীনতার আগে থেকে কয়েক প্রজন্ম ধরে বেশ কিছু পরিবার এই স্বতন্ত্র কুটির শিল্পের সাথে যুক্ত। চিরুনি তৈরির জন্য মূলত মোষের শিংই বেশি পছন্দ এখানকার শিল্পীদের। তবে কেবল চিরুনিই নয়, পিঠ চুলকানোর হাত, লাঠি, মহিলাদের কানের দুল, নকল চিংড়িমাছ, হরিণ ইত্যাদি তৈরি করে থাকেন তাঁরা। কলকাতা থেকে কেজিদরে মোষের শিং আনার পর শিংগুলিকে যন্ত্রের নানান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাজারে বিক্রির উপযোগী করে তোলা হয়। তবে বর্তমানে মূল্যবৃদ্ধির কারণে কাঁচামালের জোগানে টান পড়ায় এই শিল্প একার্থে অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন হয়েছে।
এই বাগনান যে একসময় বাংলার বীর সন্তান ক্ষুদিরামকেও দেখেছে তা আজকের প্রজন্মের অনেকেই হয়ত জানে না। হাওড়ার বাগনানের দেউলগ্রামে ছিল ক্ষুদিরাম বসুর মামা বাড়ি। ক্ষুদিরামের বয়স যখন চার বছর তখন ক্ষুদিরামের মা লক্ষ্মীপ্রিয়াদেবী মারা যান। মায়ের মৃত্যুর পর ক্ষুদিরামের বাবা পঁচাত্তর বছর বয়সে দেউলগ্রামের মেয়ে সাত বছরের সুশীলা ভঞ্জকে বিয়ে করেন। কিন্তু বিয়ের সাতদিনের মধ্যেই ক্ষুদিরামের বাবা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলে সদ্য বিধবা সুশীলাদেবী দেউলগ্রামে বাপের বাড়ি চলে আসেন। বাকি জীবন বৈধব্যের বোঝা মাথায় নিয়ে ১৯৭১ সালে সুশীলাদেবীর মৃত্যু হয়। শোনা যায় একবার ক্ষুদিরাম আত্মগোপন করতে সৎমা সুশীলাদেবীর কাছে আশ্রয় নিতে এলে সুশীলাদেবী ক্ষুদিরামকে আশ্রয় দিতে নাকি রাজি হননি। শেষ পর্যন্ত ইংরেজ পুলিশ বাগনানে ক্ষুদিরামের উপস্থিতি সম্পর্কে খবর পেলে তাঁকে শেষ পর্যন্ত গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বাগনান থানায়। সেই থানাতেই রাত কেটেছিল তাঁর। পরে অবশ্য তাঁকে ছে়ড়ে দেয় পুলিশ। বর্তমানে সেই লকআপ বাগনান থানার পুরনো ভবনের মধ্যে অবস্থিত। জনশ্রুতি তিনি নাকি পার্শ্ববর্তী বাকসি গ্রামেও গিয়েছিলেন।
দেউলগ্রামের পরতে পরতে যেমন অনন্য কুটির শিল্পের ঐতিহ্য লুকিয়ে আছে তেমনি তাঁর সাথে একাত্ম হয়ে মিশে আছে অচেনা অজানা ইতিহাসের কত গল্প। সেরকমই এই গ্রামের শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক বাহক এই গ্রামে আয়োজিত রথযাত্রা। এই গ্রামের সম্পন্ন ব্যবসায়ী শ্যামাচরণ চন্দ্রের পরিবারের একসময় এই গ্রামে যথেষ্ট প্রতিপত্তি ছিল। কতটা প্রতিপত্তি ছিল তার আন্দাজ পাওয়া যায় এই গ্রামের নামে। আজকে যা দেউলগ্রাম নামে পরিচিত এক সময় তা পরিচিত ছিল ‘শ্যামবাজার’ নামে। শ্যামাচরণ চন্দ্রের নামানুসারেই গ্রামের নাম শ্যামবাজার ছিল। জনশ্রুতি অনুসারে এই চন্দ্র পরিবারের সদস্যরা বা গ্রামের মানুষ গ্রামে আয়োজিত রথের মেলা দেখতে গেলে তাঁদের নিচু জাত আখ্যা দিয়ে রথের মেলায় প্রবেশ করতে দেওয়া হত না। অপমানিত চন্দ্ররা এরপরই সিদ্ধান্ত নেন, তাঁদের বাড়ির সদস্যরা আর অন্য কোনও রথের মেলায় যাবেন না। গ্রামেই নতুন রথের মেলার আয়োজন করা হবে এবং সেই মেলাতেই তাঁদের পরিবারের সকলে অংশগ্রহণ করবে। দেউলগ্রাম বাজার যা কিনা চন্দ্র পরিবারের সম্পত্তি সেই বাজারের ব্যবসাদারদের দানের টাকাতেই রথের মেলার আয়োজন করা হয়। ১৫ ফুট উচ্চতার ৯ চূড়া বিশিষ্ট রথটি চন্দ্র পরিবারের টাকাতেই নির্মিত। রথযাত্রা ও উলটোরথের দিন এই বাজার সংলগ্ন এলাকায় বিরাট মেলা বসে।
আপনার মতামত জানান