সববাংলায়

দেব আনন্দ

ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের এক কিংবদন্তী অভিনেতা দেব আনন্দ (Dev Anand)। একাধারে কাহিনীকার, চলচ্চিত্র পরিচালক এবং প্রযোজক দেব আনন্দ দীর্ঘ ছয় দশক ধরে ভারতের চলচ্চিত্র শিল্পের অন্যতম সফল অভিনেতার মর্যাদায় ভূষিত হয়েছেন। ১৯৪৯ সালের প্রভাত ফিল্ম স্টুডিওর প্রযোজনায় ‘হাম এক হ্যায়’ ছবিতে প্রথম অভিনয় করেন দেব আনন্দ, তারপর একের পর এক ছবিতে অভিনয় করে জনপ্রিয়তার শীর্ষে ওঠেন তিনি। শুধুই অভিনয় নয়, তার পাশাপাশি পরিচালনা এবং ছবি প্রযোজনাও করেছেন তিনি। ‘গাইড’, ‘হাম দোনো’, ‘বানারসি বাবু’ ইত্যাদি ছবিতে তাঁর অভিনয় আপামর ভারতবাসীর মনে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।

১৯২৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ শাসিত ভারতে পাঞ্জাবের গুরদাসপুর জেলার শাকারগড় তহশিলে দেব আনন্দের জন্ম হয়। তাঁর পুরো নাম ধরম দেব আনন্দ। তাঁর বাবা পিশোরী লালা আনন্দ গুরদাসপুর জেলা আদালতের একজন খ্যাতনামা যশস্বী উকিল ছিলেন। তাঁর চার সন্তানের মধ্যে তৃতীয় সন্তান ছিলেন দেব আনন্দ। তাঁর এক বোন শীলকান্ত কাপুরের পুত্র শেখর কাপুর ভারতীয় চলচ্চিত্রের এক অন্যতম প্রধান প্রযোজক ছিলেন। তাঁর দাদা ছিলেন মনমোহন আনন্দ, চেতন আনন্দ এবং তাঁর ভাইয়ের নাম ছিল বিজয় আনন্দ।

পাঞ্জাবের ডালহৌসিতে সেক্রেড হার্ট স্কুলে প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করেন দেব আনন্দ। এই স্কুল থেকেই ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ধরমশালার গভর্নমেন্ট কলেজে ভর্তি হন। পরে তিনি লাহোরে চলে যান উচ্চতর পড়াশোনার জন্য। লাহোরের গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে দেব আনন্দ ইংরেজি সাহিত্যে বি.এ ডিগ্রি অর্জন করেন।

ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক উত্তীর্ণ হওয়ার পরে ১৯৪০-এর দশকের শুরুর দিকে তিনি বম্বে চলে যান। মাসিক ৬৫ টাকা বেতনে চার্চগেটে মিলিটারি সেন্সরস অফিসে কাজে যোগ দেন তিনি। পরে মাসিক ৮৫ টাকা বেতনে দেব আনন্দ একটি অ্যাকাউন্টিং ফার্মে কাজ করতে শুরু করেন। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর দাদা চেতনের সঙ্গে তিনি যোগ দেন ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ তথা আইপিটিএ-তে (IPTA)। ‘অছ্যুৎ কন্যা’ এবং ‘কিসমত’ ছবিতে অশোক কুমারের অভিনয় দেখে নিজে একজন অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকেন দেব আনন্দ। ১৯৪৯ সালে প্রভাত ফিল্ম স্টুডিওর প্রযোজনায় ‘হাম এক হ্যায়’ ছবিতে প্রথম অভিনয়ের সুযোগ পান দেব। পরে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন যে প্রভাত ফিল্মসের প্রযোজক বাবু রাও পাই তাঁর সুন্দর মুখশ্রী, মিষ্টি হাসি আর আত্মবিশ্বাসী ব্যক্তিত্ব দেখেই ছবিতে কাজ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। পুনেতে এই ছবির শ্যুটিং-এর সময়ে আরেক প্রখ্যাত অভিনেতা গুরু দত্তের সঙ্গে তাঁর সখ্যতা গড়ে ওঠে। এমনকি তাঁদের মধ্যে এমনও কথা হয় যে দুজনের মধ্যে যে আগে প্রতিষ্ঠিত হবে, সে অন্যকেও প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করবে। তাছাড়া দেব আনন্দ কোনো ছবি প্রযোজনা করলে, গুরু দত্ত সেটিতে নির্দেশনা দেবেন, কিংবা গুরু দত্ত কোনো ছবি পরিচালনা করলে তাতে অবশ্যই দেব আনন্দ অভিনয় করবেন এমনভাবেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিলেন তাঁরা। ১৯৪০-এর দশকের শেষ দিকে বিখ্যাত অভিনেত্রী সুরাইয়ার সঙ্গে এক জুটিতে বহু ছবিতে অভিনয় করেন তিনি যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘বিদ্যা’ (১৯৪৮), ‘জিৎ’ (১৯৪৯), ‘শায়ের’ (১৯৪৯), ‘আফসার’ (১৯৫০), ‘দো সিতারে’ (১৯৫১) এবং ‘সনম’ (১৯৫১)। ‘বিদ্যা’ ছবির একটি গানের দৃশ্যে শ্যুটিং করার সময়েই নৌকা উল্টিয়ে সুরাইয়া জলে পড়ে গেলে তাঁকে বাঁচান দেব এবং সেই সময় থেকেই উভয়ের মধ্যে প্রেম-পরিণয় ঘটে। কিন্তু তাঁরা দুজনে বিবাহ করার সিদ্ধান্ত নিলে সুরাইয়ার ঠাকুমা বাধা দেন। হিন্দু এবং মুসলমানের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক তিনি মানতে পারেননি। ফলে অচিরেই দেব এবং সুরাইয়ার সম্পর্কে ছেদ পড়ে। ‘দো সিতারে’ ছবির পরে আর দুজনে একত্রে অভিনয় করেননি। স্টুডিওতে দেব আনন্দকে দেখে অশোক কুমার তাঁর ‘বম্বে টকিজ প্রোডাকশন’-এর ‘জিদ্দি’ ছবিতে নায়কের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য নির্বাচন করেন। অভিনেত্রী কামিনী কৌশলের সঙ্গে আনন্দের অভিনীত এই ছবিটি বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এরপর থেকেই নিজে ছবি প্রযোজনা করার কথা ভাবেন আনন্দ। এই ‘জিদ্দি’ ছবিতেই কিশোর কুমার প্রথম প্লে-ব্যাক গায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন এবং এই সময় থেকেই দেব আনন্দের সঙ্গে তাঁর সখ্যতা তৈরি হয়। ১৯৪৯ সালে তাঁর দাদা চেতন আনন্দের সঙ্গে দেব আনন্দ গড়ে তোলেন ‘নভকেতন ফিল্মস’। এই সংস্থা থেকে মোট ৩৫টি ছবি তৈরি হয়। ১৯৫০ সালে প্রথম মধুবালার সঙ্গে একত্রে অভিনয় করেন আনন্দ ‘নিরালা’ ছবিতে যা বাণিজ্যিকভাবে খুবই সাফল্য পায়। পরবর্তীকালে দেব আনন্দ এবং মধুবালার জুটি হিন্দি চলচ্চিত্রে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৫১ সালে নভকেতন ফিল্মসের প্রযোজনায় ‘বাজি’ নামের একটি ক্রাইম থ্রিলার ছবিতে গুরু দত্তকে পরিচালনার ভার দেন দেব আনন্দ। এই ছবিতেই গুরু দত্ত প্রথম পরিচালক হিসেবে এবং কল্পনা কার্তিক প্রথম মহিলা অভিনেত্রী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এরপরে কল্পনা কার্তিক এবং দেব আনন্দ একত্রে বহু ছবিতে অভিনয় করেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘আন্ধিয়ান’ (১৯৫২), ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’ (১৯৫৪), ‘হাউজ নং ৪৪’ (১৯৫৫) এবং ‘ন দো গ্যয়ারা’ (১৯৫৭)। ১৯৫৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’ ছবিটি প্রভূত বাণিজ্যিক সাফল্য লাভ করলে কল্পনা কার্তিক এবং দেব আনন্দ নিরালায় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৫৬ সালে তাঁদের এক পুত্র সন্তান জন্মায় সুনীল আনন্দ নামে এবং পরে তাঁদের একটি কন্যাও জন্ম নেয় দেভিনা নামে। দ্রুত সংলাপ বলা আর তার সঙ্গে সঙ্গে অতুলনীয় এক শরীরী দোলন দেব আনন্দের অভিনয়ের এক আবশ্যিক বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। ‘বাজি’ ছবির পরে ‘জল’ (১৯৫২), ‘মুনিমজি’ (১৯৫৫), ‘পকেটমার’ (১৯৫৬), ‘ফান্টুশ’ (১৯৫৬), ‘সিআইডি’ (১৯৫৬) এবং ‘পেয়িং গেস্ট’ (১৯৫৭) ইত্যাদি ছবিতে তাঁর অভাবনীয় অভিনয় আজও ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে স্মরণীয় হয়ে আছে। ১৯৫০-এর দশকে তাঁর অভিনীত বেশিরভাগ ছবিই রহস্য-রোমাঞ্চ, প্রেমমূলক কিংবা লঘুচপল হাস্যরসাত্মক ধারার মধ্যে পড়ে। তাঁর এই বিশেষ অভিনয় শৈলী দর্শকদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ‘সিআইডি’ ছবির পর থেকে ওয়াহিদা রহমানের সঙ্গে জুটি বেঁধে আনন্দ একের পর এক ছবিতে অভিনয় করেন যা প্রভূত বাণিজ্যসাফল্য এনে দেয়। এই ছবিগুলির মধ্যে রয়েছে ‘সোলভা সাল’, ‘কালাবাজার’, ‘বাত এক রাত কি’, ‘রূপ কি রানি চোরোঁ কা রাজা’, ‘প্রেম পূজারি’ ইত্যাদি। ‘ইনসানিয়ত’ ছবিতে দিলীপ কুমারের সঙ্গেও অভিনয় করেন তিনি। ষাটের দশকে এসে ‘বোম্বাই কা বাবু’ (১৯৬০), ‘শরাবি’ (১৯৬৪) ইত্যাদি বিয়োগান্তক ধারার ছবিতে অভিনয় করেও প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করেন তিনি। পঞ্চাশের দশকের শেষ থেকে ষাটের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত দিলীপ কুমার, রাজ কাপুর এবং দেব আনন্দের জুটি হিন্দি চলচ্চিত্রের জগতে রাজত্ব করছিল বলা যায়। ‘মঞ্জিল’ এবং ‘তেরে ঘর কে সামনে’ ছবির মধ্যে দিয়ে দেব আনন্দের অভিনয় জীবনে এক নতুন রোমান্টিক ঘরানার সূত্রপাত হয়। ষাটের দশকে তাঁর অভিনীত একটি অসাধারণ ছবি ছিল ‘হাম দোনো’ (১৯৬০) যেখানে একইসঙ্গে আনন্দ ছিলেন প্রযোজক এবং অভিনেতা। এরপরে আর কে নারায়ণের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘গাইড’ ছবিতে ওয়াহিদা রহমানের সঙ্গে অভিনয় করেন তিনি। তাঁর ভাই বিজয় আনন্দ এই ছবিতে পরিচালনা করেছেন এবং ১৯৬৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবিটি পরে হলিউডেও মুক্তি পায়। বিজয় আনন্দের পরিচালনায় ‘জুয়েল থিফ’ ছবিটিতেও অভিনয় করেছেন দেব আনন্দ। এরপর তাঁর অভিনয় জীবনের সবথেকে বাণিজ্যসফল এবং জনপ্রিয় চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় ১৯৭০ সালে – ‘জনি মেরা নাম’। ১৯৬৯ সালে ষষ্ঠ মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অন্যতম বিচারক হিসেবে নির্বাচিত হন দেব আনন্দ।

আরও পড়ুন:  সোফিয়া লোরেন

দেব আনন্দের পরিচালনায় মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘প্রেম পূজারি’, ‘তেরে মেরে সপ্‌নে’, ‘গ্যাম্বলার’, ‘ধরম করম’, ‘দাস্তান’, ‘বৈরাগ’, ‘ছুপা রুস্তম’, ‘বেনারসি বাবু’ ইত্যাদি। পরভিন বাবি, রাখি, জিনাত আমন, তিনা মুনিম ইত্যাদি ডাকসাইটে অভিনেত্রীদের সঙ্গে এই সব ছবিতে তাঁর অভিনয় দর্শক আনুকূল্য পেয়েছিল। বরাবরই ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের চিরন্তন উজ্জ্বল এক অভিনেতা হিসেবে দেব আনন্দ স্মরণীয় হয়ে আছেন। বিশ্বখ্যাত অভিনেতা গ্রেগরি পেকের সঙ্গে তাঁর অভিনয়ের তুলনা করা হয় বেশিরভাগ সময়। সমগ্র জীবনে ১৯টি ছবিতে পরিচালনা করেন তিনি এবং ৩৫টি ছবি প্রযোজনা করেন। তাঁর প্রযোজিত ছবিগুলির মধ্যে ১৮টি ছবি প্রভূত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল এবং তাঁর পরিচালিত ছবিগুলির মধ্যে ১০টি ছবি জনপ্রিয় হয়। ২০০৭ সালে ‘রোমান্সিং উইথ লাইফ’ নামে দেব আনন্দের আত্মজীবনী প্রকাশিত হয়।

অভিনয়, পরিচালনা এবং প্রযোজনা ছাড়াও ইন্দিরা গান্ধীর আমলে জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে জনসভায় বক্তব্য রাখেন দেব আনন্দ। ইন্দিরা গান্ধীর বিরোধিতা করে ১৯৭৭ সালে ‘ন্যাশনাল পার্টি অফ ইণ্ডিয়া’ নামে একটি রাজনৈতিক দলও তৈরি করেছিলেন, যদিও সেই দল পরে ভেঙে যায়।

২০০১ সালে ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মভূষণ’ উপাধিতে ভূষিত করে এবং ২০০২ সালে তিনি ‘দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার’ অর্জন করেন। ‘কালাপানি’ এবং ‘গাইড’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পেয়েছিলেন দেব আনন্দ। ২০০০ সালের জুলাই মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিলারি ক্লিনটন ভারতীয় চলচ্চিত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য পুরস্কৃত করেন দেব আনন্দকে। এছাড়াও আজীবন বহু পুরস্কারে এবং উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন।

২০১১ সালের ৩ ডিসেম্বর ৮৮ বছর বয়সে লণ্ডনের ওয়াশিংটন মেফেয়ার হোটেলে নিজের ঘরে হৃদ্‌যন্ত্র বিকল হয়ে দেব আনন্দের মৃত্যু হয়।                    

error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন।

Discover more from সববাংলায়

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

চৈতন্যদেবের অসামান্য জীবনী দেখুন

চৈতন্য জীবনী

ভিডিওটি দেখতে ছবিতে ক্লিক করুন