ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস

১ জুলাই ।। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস

প্রতি বছর প্রতি মাসের নির্দিষ্ট কিছু দিনে বিভিন্ন দেশেই কিছু দিবস পালিত হয়। ঐ নির্দিষ্ট দিনে অতীতের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে স্মরণ করা বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতেই এই সমস্ত দিবস পালিত হয়। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে পালনীয় সেই দিবসগুলির মধ্যে একটি হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস (Dhaka University Day)।

প্রতি বছর ১ জুলাই তারিখে বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দিনটিকে স্মরণে রেখেই এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস পালিত হয়। বাংলাদেশের সবথেকে প্রাচীন এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি আজও নিজ ঐতিহ্য অক্ষুণ্ন রেখে এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই এই বিশ্ববিদ্যালয় বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনে এবং উন্নত চিন্তা-চেতনা সম্পন্ন তরুণসমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এবং ভাষা আন্দোলনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। সেই অর্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবেই ১ জুলাই দিনটি উদ্‌যাপন করা হয়।  

১৯২১ সালের ১ জুলাই বাংলাদেশের ঢাকা জেলায় এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। তবে এই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আগে এই জমিতেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ঢাকা কলেজের পুরনো বাড়িটি ছিল। ১৮৭৩ সালে এই কলেজটি বাহাদুর শাহ পার্কে স্থানান্তরিত হলেও পরে এটি পুনরায় কার্জন হলে স্থানান্তরিত হয়। ১৯০৫ সালের বাংলা বিভাজনের একটি ক্ষতিপূরণ বাবদ ব্রিটিশ সরকার সম্ভবত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি নির্মাণ করেছিল। বিভাজনের ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান এবং আসাম পৃথকীকৃত হয়েছিল এবং ঢাকা ছিল তাদের রাজধানী। ঢাকায় তখন সদ্য সদ্য স্থাপিত হয়েছে মুসলিম লীগ। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং বাঙালি হিন্দুদের তীব্র বিরোধিতার ফলে ১৯১১ সালে বাংলা বিভাজন রদ করা হয়। বঙ্গভঙ্গ রদের সিদ্ধান্তে গভীরভাবে আহত হয়ে ঢাকার তৎকালীন নবাব খাজা সলিমুল্লাহ বাহাদুরের নেতৃত্বে একটি মুসলিম প্রতিনিধি দল ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবি জানায়। পূর্ববঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণকে সন্তুষ্ট করার জন্য এই প্রস্তাবে সম্মত হন লর্ড কার্জন। এই পরিসরে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে উৎসাহী স্যার সলিমুল্লাহ খান তাঁর নিজস্ব এস্টেট থেকে ৬০০ একর জমি দান করেছিলেন। ১৯১৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রকল্পটি চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার আগে জনমত আহ্বান করা হয়। ঐ বছরই ডিসেম্বর মাসে রাষ্ট্রসচিব তাঁর অনুমোদন দেন। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন বিদ্যায়তনিক নিবন্ধক ফিলিপ জোসেফ হার্টগকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে অভিষিক্ত করা হয়। পরবর্তী ১৭ বছর তিনি এই পদেই অধিষ্ঠিত ছিলেন। ভারতীয় সংসদে পাশ হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯২০ মোতাবেক ১৯২১ সালে তৈরি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে এটি তৈরি করা হয়েছিল। ১৯১৭ সাল থেকে ১৯২২ সালের মধ্যে বাংলার গভর্নর লর্ড রোনাল্ডশে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ছিলেন। তাঁর নির্দেশেই নবাব সৈয়দ শামসুল হুদা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আজীবন সদস্য নির্বাচিত হন। এরপরে হুদার পরামর্শেই লর্ড রোনাল্ডশে আহমদ ফজলুর রহমানকে ‘প্রোভোস্ট’ পদে নিযুক্ত করে। ১৯২১ সালের ১ জুলাই কলা বিভাগ, বিজ্ঞান বিভাগ এবং আইন বিভাগ এই তিনটি অনুষদের মোট ৮৪৭ জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যায়তনিক কার্যক্রম শুরু হয়। প্রাথমিকপর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ১২টি বিভাগ ছিল সংস্কৃত ও বাংলা, ইংরেজি, শিক্ষাবিজ্ঞান, ইতিহাস, আরবি ও ইসলামী বিদ্যা, পার্সি ও উর্দু দর্শন, অর্থনীতি এবং রাজনীতি, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, গণিত এবং আইন। ছাত্র-ছাত্রীদের থাকার জন্য তিনটি জায়গা ছিল – সলিমুল্লাহ হল, জগন্নাথ হল এবং ঢাকা হল। ১৯৩৬ সালে জগদীশচন্দ্র বসু, যদুনাথ সরকার, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের সম্মানীয় ডক্টরেট ডিগ্রিতে ভূষিত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পূর্ব পাকিস্তানের চাপিয়ে দেওয়া উর্দু ভাষার বিরুদ্ধে বাংলা ভাষার আন্দোলনে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রভূত ভূমিকা পালন করেছিল। পাকিস্তান সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে এই বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেই সকল বিদ্রোহী ছাত্র-ছাত্রীরা একজোট হয়েছিল। আজও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে একটি ভাষা শহীদ মিনার রয়েছে যা ভাষা-আন্দোলনে নিহত বাঙালি শহীদদের স্মৃতি জাগিয়ে তোলে। তবে ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলন ছাড়াও ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থান, এমনকি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনে এই ঢাকা বিশ্ববদ্যালয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ এই বিশ্ববিদ্যালয়েই স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০ বছর পূর্তি হয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎকর্ষের কারণে একে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বলা হয়। সম্প্রতি ২০২১ সালে দাঁড়িয়ে দেখা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে উঠেছে ১৩টি অনুষদের অধীনে ৮৪টি বিভাগ, ১২টি প্রতিষ্ঠান, ১৯টি আবাসিক হল ইত্যাদি এবং বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৩ হাজার ৩৮৫ জন এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ২০১০ জন শিক্ষক অধ্যাপনা করেন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

প্রতি বছর ১ জুলাই দিনটিতে বর্ণাঢ্য আয়োজনের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উদ্‌যাপন করা হয়। এই বিশেষ দিনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে তোলা হয়। বর্তমান ও প্রাক্তন সকল শিক্ষার্থীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। বিভিন্ন আলোচনা সভা আয়োজিত হয়, গাওয়া হয় উদ্বোধনী সঙ্গীত। তারপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে বিশাল বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বেরোয়। তাছাড়া দুর্লভ পাণ্ডুলিপি প্রদর্শন, শিক্ষার্থীদের জন্য সাঁতার প্রতিযোগিতা, সাইকেল মিছিল, প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচ ইত্যাদি আয়োজিত হয়। এই সব অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। এই শতবর্ষ উদ্‌যাপন উপলক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৬ দিন ব্যাপী একটি অনুষ্ঠানের ঘোষণা করেছিল যা ঐ বছর ১ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত আয়োজিত হয়েছিল। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য মহম্মদ আখতারুজ্জামান। তাছাড়া রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বঙ্গভবনে বসেই ভার্চুয়াল মাধ্যমে এই ১৬ দিন ব্যাপী অনুষ্ঠানের শুভ উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় সংসদের অধ্যক্ষ শিরিন শারমিন চৌধুরী।

২০২০ সালে এই বিশেষ দিন উপলক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের প্রতিপাদ্য স্থির করে ‘দীর্ঘস্থায়ী লক্ষ্য অর্জন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য উপযোগী হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়কে গড়ে তোলা এবং দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা’ (Achieving Sustainable Goals and Building a University Suitable for Fourth Industrial Revolution and Creating Skilled Human Resources)। ২০২১ সালে এই বিশেষ দিন উদ্‌যাপনের প্রতিপাদ্য ছিল – ‘গুণগত শিক্ষা, প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণ’ (Quality Education, Barriers and Transitions)। তাছাড়া ‘শত বছরের আলো’ (Hundred Years of Light) এই প্রতিপাদ্যটিকেও সামনে রেখে ২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০ বছর পূর্তি উৎসব পালিত হয়েছে।

আপনার মতামত জানান