পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত পূর্ব মেদিনীপুর জেলার একটি অন্যতম প্রসিদ্ধ ইতিহাস বিজড়িত জনপদ হল এগরা (Egra)। পূর্ব মেদিনীপুরের এগরা একটি মিউনিসিপ্যালিটি এবং এগরা সাবডিভিশনের সদর দপ্তরও বটে।
ভৌগোলিক অবস্থানের বিচারে ২১.৯০ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৭.৫৩০ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত পূর্ব মেদিনীপুরের একটি অন্যতম জনপদ এগরা। সমুদ্রতল থেকে এই জনপদ ৩৬ ফুট উপরে অবস্থিত। এগরার উত্তরদিকে রয়েছে প্রতাপদিঘী, দক্ষিণে রয়েছে মাধবপুর, পাঁচরোল এবং পশ্চিমে রয়েছে গঙ্গাধরবার।

‘এগরা’ নামের উৎপত্তি ঘটেছে ‘অগরাপত্তনম’ থেকে। অগরাপত্তনম কথার অর্থ হল বাজার। বহু বহু কাল আগে মেদিনীপুর জেলার অন্যতম বাজার ছিল এই জনপদটিতে এবং এখানে বহু মানুষের সমাগম হত। বিভিন্ন শস্য, নুন এবং মাছের ব্যবসা চলত এই অঞ্চল জুড়ে। সামনেই ছিল সমুদ্রের উপকূল। কিন্তু ঐতিহাসিকদের মতে বালিতে ঢেকে যায় বলে সমুদ্র সরে যায় একেবারে পিছনে। বর্তমানে এগরার আশেপাশে আর কোন জলাভূমি বা সমুদ্র নেই। আবার অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, ‘এগরা’ নামটি এসেছে অগ্রহার থেকে। অগ্রহার থেকে প্রথমে অগ্রঘর, তারপরে আগঘর এবং সেখান থেকেই এগরা কথাটি এসেছে বলে অনুমান করা হয়। ‘অগ্রহার’ কথার অর্থ হল – জমিদারদের অধিকরণ। যারা জমিদারদের কাছ থেকে জমি ভোগ করতেন তারা জমির সঙ্গে সঙ্গে অন্য কিছু কিছু অধিকারও পেতেন, তাকেই বলা হতো অগ্রহার।
ঐতিহাসিকদের মতে, আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগে এই এগরার কাছেই ছিল সমুদ্র। সমুদ্রের জলের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ত এগরার বালিতে। জেলে ও মাছ ব্যবসায়ীদের ভিড়ে মুখরিত ছিল এই জনপদ এবং সমুদ্রের ধারে ধারে থাকা উঁচু উঁচু বাতিস্তম্ভগুলি রাত্রে পথ দেখাত বাণিজ্যতরীকে। আজও কোন কোন অংশে সেই ভগ্নপ্রায় বাতিস্তম্ভ দেখা যায়। তাছাড়া ইতিহাসবিদরা মনে করেন যে এগরা প্রাচীনকালে ওড়িশার অন্তর্গত ছিল। ওড়িশার গঙ্গোবংশের রাজা মুকুন্দদেবের শাসনকালে অর্থাৎ আনুমানিক ১৫৬০ থেকে ১৫৬৪ সালের মধ্যে এগরার সামন্ত রাজা দিব্যসুন্দর করমহাপাত্রের সৌজন্যে এখানকার সমুদ্র উপকূলে প্রতিষ্ঠিত হয় হট্টনাগরের শিবমন্দির। এই মন্দির পুরোপুরি পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দিরকে অনুকরণ করে নির্মিত হয়েছিল। কাঁথি মহকুমার অন্তর্গত এগরা থানার সবথেকে প্রাচীন পুরাকীর্তি ছিল এই মন্দিরটি। মুকুন্দদেব সেকালে ছিলেন সমগ্র উৎকলের অধিপতি। এই মন্দিরের প্রধান মুখ রয়েছে পশ্চিমদিকে এবং এই মন্দিরের গর্ভগৃহে যে শিবলিঙ্গ রয়েছে তা মাটি থেকে প্রায় ১৭ ফুট নীচে। এগরার প্রাচীন রাজবংশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল আলংগিরি রাজবংশ। এই রাজবংশের রাজা ছিলেন দিব্যসুন্দর করমহাপাত্র। সম্প্রতি এগরা থেকে পাওয়া একটি তাম্রপত্র থেকে এই অঞ্চলে রাজা শশাঙ্কের শাসনের কথাও জানা যায়। এগরার ইতিহাসে জড়িয়ে আছে এখানকার প্রসিদ্ধ সুপ্রাচীন বাসন্তীতলা কালী মন্দির। এগরার হট্টনাগরের মন্দিরটি কিংবা সেখানকার শিবের পূজাই বা কীভাবে প্রচার পেল তা নিয়ে একটি আশ্চর্য জনশ্রুতি আছে। সেই জনশ্রুতি অনুযায়ী এক রাখাল রোজই তার গরুর পাল নিয়ে মাঠে চরাতে যায় এবং সেই পালের মধ্যে থেকে রোজই একটি করে দুগ্ধবতী গাভী কোথায় যেন হারিয়ে যায়। রাখাল বেশ কিছুদিন ধরে এই ঘটনা পর্যবেক্ষণের পরে বুঝতে পারেন, সেই দুগ্ধবতী গাভীটি চলে যাওয়ার কিছুদিন পরে আবার ফিরে আসে। ফিরে আসার সময় তাদের বাঁটে আর এক ফোঁটাও দুধ থাকে না। একদিন এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে সেই রাখাল গরুর পিছন পিছন যেতে যেতে এক ঘন নিবিড় অরণ্যের মধ্যে এসে পড়েন এবং সেই অরণ্যের মধ্যে এক জায়গায় দাঁড়ানো মাত্র গরুর বাঁট থেকে অনবরত দুগ্ধ নিঃসরণ হতে থাকে এবং দুগ্ধ নিঃশেষ হলে সেই গরু আবার ফিরে যায়। এই ঘটনা দেখা মাত্র সেই রাখাল গ্রামে গ্রামে এই খবর ছড়িয়ে দেন। ক্রমে সেখানকার রাজার কানে এই কথা গেলে অরণ্যের মধ্যে রাজার সেপাইরা খোঁড়াখুঁড়ি করে সেখান থেকে আবিষ্কার করেন এই শিবলিঙ্গ। এই মন্দিরের পিছনে ‘কুণ্ড’ নামে একটি পুকুর আছে। এখানকার পুরাকীর্তির সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক প্রাচীন ইতিহাস। শশাঙ্কের যে তাম্রপত্র এখান থেকে পাওয়া গেছে তাতে এগরার কয়েকটি গ্রামের মধ্যে চারটি অগ্রহার গ্রামের নাম পাওয়া যায়। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের ভিত্তিতে পুরীর জগন্নাথ মন্দির থেকে পাওয়া মাদলাপঞ্জী থেকে জানা যায় যে, উড়িষ্যার ৩১টি দণ্ডপাটের মধ্যে মোট ৬টি দণ্ডপাটের নইগাঁতেই আসলে এগরার প্রাচীন অবস্থান ছিল। এই নইগাঁ দণ্ডপাটের প্রধান কার্যালয় ছিল এগরার নিকটবর্তী নেগুঁয়াতে।
এগরার অদূরেই পটাশপুর থানার অন্তর্গত কৃষ্ণসাগর নামে একটি পটাশপুর ধুসুরদাগড়ের চৌধুরী কৃষ্ণচন্দ্র মিত্র এই পুকুর খনন করেছিলেন বলে জানা যায়। তাছাড়া আরও জানা যায় যে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম ১৯০২ সালে এই জলাশয়েই স্নান করে এর তীরে বসে স্বদেশি আন্দোলনের বৈঠক সেরেছিলেন। এগরার পার্শ্ববর্তী নেগুঁয়া মহকুমার ম্যাজিস্ট্রেট পদে কর্মরত ছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এখানকার মানুষের মতে, পটাশপুর থানাতেই দুই-তিনশো বছর আগে থেকে সিদ্ধপুরুষ পীর মকদুম সাহেবের থান রয়েছে।
এগরার নেগুঁয়াতে বঙ্কিমচন্দ্রের আগমন ও কাছারিবাড়িতে কাজ করার কথা জানা যায়। ঐতিহাসিক এবং বঙ্কিমচন্দ্রের আত্মীয়দের মুখ থেকে জানা যায় যে, তাঁর লেখা ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসের পটভূমি তৈরি হয়েছিল এই নেগুঁয়াতেই। বঙ্কিমচন্দ্রের ভাই পূর্ণচন্দ্র, তাঁর বড়ো দাদা শ্যামাচরণের পুত্র শচীশচন্দ্র সকলেই এই কাছারিবাড়িতে কাজের সময় বঙ্কিমের সঙ্গে এক দীর্ঘকায় কাপালিক সন্ন্যাসীর সাক্ষাতের কথা জানিয়েছেন। সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক সুশীলচন্দ্র মাইতির লেখা থেকে জানা যায় যে, একদিন রাত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের এগরার বাড়িতে এসে উপস্থিত হয় এক শুভ্রবসনা নারী। সেই নারী কয়েক মুহূর্ত থেকে তারপর বাগানের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যান এবং বঙ্কিম তাঁর পিছন পিছন গিয়ে লক্ষ্য করেন যে অন্ধকারে মিলিয়ে গিয়েছেন তিনি। মনে করা হয় এইসব ঘটনাই ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসের ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিল। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে তিনি যখন এগরার নিকটবর্তী নেগুঁয়ায় আসেন, অবসর সময়ে পার্শ্ববর্তী চাঁদপুরে এসে তিনি সমুদ্রের পাড়ে বসে থাকতেন।
১৯৬৮ সালে প্রথম এখানে স্থাপিত হয় এগরা সারদা শশিভূষণ কলেজ। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্থাপিত এই কলেজ মূলত কলাবিদ্যা ও মানবীবিদ্যা, বিজ্ঞান ও বাণিজ্য পড়ানো হয়। এটিই এই জনপদের সবথেকে প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৯২৬ সালে এখানে স্থাপিত হয় এগরা ঝটুলাল হাই স্কুল। তাছাড়া ১৯৪০ সালে এখানে স্থাপিত হয় এগরা স্বর্ণময়ী গার্লস হাই স্কুল। স্কুল শিক্ষার পাশাপাশি সাহিত্যচর্চার একটি প্রাণকেন্দ্র হিসেবে ১৯৫৮ সালে এই জনপদে স্থাপিত হয় এগরা সাধারণ পাঠাগার।
বহু প্রাচীনকালে জানা যায়, শিবরাত্রি উপলক্ষে এখানকার হট্টনাগর শিব মন্দিরের প্রাঙ্গণে বিশাল মেলা বসত। তারপর ১৯৮৭ সালে শুরু হয় এগরা মেলা। কিন্তু তাতেও হট্টনাগরের মেলার ঐতিহ্য ক্ষুণ্ণ হয়নি। ঐতিহাসিক এল. এস. এস ও মোলি সাহেবের বইতেও এই মেলার উল্লেখ পাওয়া যায়। আজও এগরার শিবরাত্রির মাহাত্ম্য কোথাও ম্লান হয়নি।
এগরার দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রয়েছে অনেকগুলি প্রাচীন মন্দির স্থাপত্য। তার মধ্যে প্রধান হল হট্টনাগরের শিবমন্দির। এই মন্দিরের চতুষ্কোণ থামের উপরে উঁচু খিলানযুক্ত ভারী পাল্লার দুটি দরজার সাহায্যে তোরণ নির্মিত হয়েছে। মন্দিরের সামনেই রয়েছে বারোটি স্তম্ভবিশিষ্ট এক বিশাল নাটমঞ্চ। এছাড়া ১৮৮০ সালে নির্মিত চিরুলিয়া গ্রামের রামচন্দ্র মন্দিরটি উল্লেখযোগ্য দ্রষ্টব্য। এই মন্দিরে দেখা যায় বড় চালার পাশে রথের আকৃতি। টেরাকোটা এবং সুদৃশ্য নকশার কারণে এই মন্দিরের মাহাত্ম্য বেড়েছে অনেক। এগুলি ছাড়াও আশেপাশে রয়েছে পাঁচরোলের ষড়ভুজ গৌরাঙ্গ মন্দির, ভৈরবনাথ শিবের শিখর দেউল, রাধাগোকুলানন্দ জিউর একরত্ন মন্দির, আদলাবাদের রাধামোহন জীউর মন্দির ইত্যাদি বিখ্যাত। পাঁচরোলের মন্দিরটি উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে নির্মিত হয়েছে মূলত পূর্বমুখী দালান রীতি মেনে। এই মন্দিরের কাঠের টুকরোর বিগ্রহ, টেরাকোটার কাজ ও মিথুনমূর্তি বিশেষ দর্শনীয়। ভৈরবনাথ শিবের শিখর দেউলের প্রাঙ্গনের মধ্যেই একটি ভাঙা বিষ্ণুমূর্তি দেখা যায়। আবার রাধাগোকুলানন্দ জীউর মন্দিরে আটচালা রীতির অপূর্ব নিদর্শনের পাশাপাশি রয়েছে নাটমঞ্চ, রাসমঞ্চ। এই রাসমঞ্চের চূড়ার আকৃতি রসুনের মতো বলে একে অনেকে ‘রসুনচূড়া’ বলে থাকেন।
পূর্ব মেদিনীপুরের মধ্যে জনপদ হিসেবে খুব বেশি জনপ্রিয়তা বা মাহাত্ম্য না থাকলেও এগরার ইতিহাসে জড়িয়ে রয়েছে বাংলার প্রাচীন রাজবংশের স্মৃতি, রয়েছে সমুদ্র-বাণিজ্যের লুপ্ত ইতিহাসের কথাও। আর সেই স্মৃতি বুকে নিয়েই আহ প্রগতির পথে এগিয়ে চলেছে এগরা।
তথ্যসূত্র
- অরিন্দম ভৌমিক, 'মেদিনীকথা - পূর্ব মেদিনীপুর পর্যটন ও পুরাকীর্তি', সন ১৪২৩, কলকাতা
- https://en.wikipedia.org/
- https://www.anandabazar.com/
- https://www.khaboronline.com/
- http://oaji.net/
- https://archive.org/details/