বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে যেসব খেলোয়াড় কিংবদন্তী হয়ে উঠেছেন তাঁদের মধ্যে নিঃসন্দেহে অন্যতম একজন হলেন আর্জেন্টিনীয় ফুটবলার লিওনেল মেসি (Lionel Messi)। তাঁকে অনেকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার বলে মনে করে থাকেন। সাতটি ব্যলন ডি’অর সহ কোপা আমেরিকা, বিশ্বকাপ এবং ফুটবলের সবচেয়ে সম্মানজনক খেতাবগুলি রয়েছে মেসির ঝুলিতে। লা লিগায় সর্বাধিক গোল এবং হ্যাট্রিকের রেকর্ড রয়েছে তাঁর। বার্সেলোনা ক্লাবের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবে রয়েছে তাঁর নাম। উল্লেখ্য যে তিনি দেশের জাতীয় দলেরও সর্বোচ্চ গোলদাতা। বার্সেলোনার অধিনায়কত্ব যেমন করেছেন তেমনি দেশের অধিনায়ক হিসেবেও তাঁর সাফল্য আকাশছোঁয়া। অলিম্পিক স্বর্ণপদকও পেয়েছেন নিজের কেরিয়ারে। দু’বার গোল্ডেন বলের বিজেতা তিনি। আর্জেন্টাইন তারকা দিয়েগো মারাদোনার যথার্থ উত্তরসূরীর স্থান মেসিকেই দিয়ে থাকেন তাঁর ভক্তরা।
১৯৮৭ সালের ২৪ জুন মধ্য আর্জেন্টিনার সান্তা ফে প্রদেশের রোজারিওতে এক মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারে লিওনেল আন্দ্রেস মেসির (Lionel Andrés Messi) জন্ম হয়। তাঁর বাবা হোর্হে হোরাসিও মেসি পেশায় ইস্পাত কারখানার ম্যানেজার এবং মেসির মা সেলিয়া মারিয়া কুকিত্তিনি একটি চুম্বক উৎপাদন কর্মশালায় কাজ করতেন। মোট চার সন্তানের মধ্যে লিওনেল মেসি ছিলেন তৃতীয়। বাবার দিক থেকে ধরলে তিনি মূলত একজন ইতালীয় ও স্প্যানিশ বংশোদ্ভূত এবং মায়ের দিক থেকে মেসি হলেন ইতালীয়। তাঁর পরিবারের মধ্যেই ফুটবলের প্রতি একটা আগ্রহ ছিল। অতএব ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হওয়াটা মেসির ক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিক ঘটনাই ছিল। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি প্রচন্ড আগ্রহ ছিল তাঁর এবং বড়দাদা রদ্রিগো ও মাতিয়াসের সঙ্গে ফুটবল খেলতেন তিনি।
মাত্র চার বছর বয়সে লিওনেল মেসি স্থানীয় ক্লাব গ্র্যান্ডোলিতে যোগদান করেন যেখানে নিজের বাবার কাছেই প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন তিনি। তবে ফুটবলের দিকে আরও বেশি ঝোঁক তৈরি করে দেওয়া সহ আরও বেশি উৎসাহদানের কাজ করেছিলেন মেসির দিদিমা সেলিয়া। তিনি প্রশিক্ষণ ম্যাচে সবসময় মেসিকে সঙ্গ দিতেন, তাঁকে মনের জোর জোগাতেন। মেসির এগারোতম জন্মদিনের কিছুদিন আগে তাঁর দিদিমার মৃত্যু হয় এবং সেই মৃত্যু তাঁকে আমূল নাড়া দিয়েছিল। পরবর্তীতে আকাশের দিকে দু’হাত তুলে দিদিমাকে স্মরণ করে প্রার্থনার ভঙ্গীতে মেসিকে গোল উদযাপন করতে দেখা গেছে বহুবার।
ছয় বছর বয়সে লিওনেল মেসি রোজারিওর একটি ক্লাব নেওয়েলস ওল্ড বয়েজের যুবদলে যোগ দেন৷ এই ক্লাবের হয়ে প্রায় ৫০০টি গোল করেন তিনি। এই ক্লাবের হয়ে খেলাকালীন অধিকাংশ সময় সুকৌশলে বলের দখল নিজের কাছে রেখে নিজের জাত চিনিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু একজন পেশাদার ফুটবলার হওয়ার পথে হঠাৎ এক অপ্রত্যাশিত বাধা এসে হাজির হয় মেসির যখন দশ বছর বয়স। সেই সময় গ্রোথ হরমোনের ঘাটতি ধরা পড়ার ফলে তাঁর স্বাভাবিক বৃদ্ধি থমকে যায়। মেসির বাবার করা স্বাস্থ্য বীমায় দুবছর অবধি গ্রোথ হরমোনের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসার খরচ চালানো যেত। এই গ্রোথ হরমোন ট্রিটমেন্টের খরচই ছিল সেই সময় প্রতি মাসে ১০০০ ডলার। যদিও মেসির ক্লাব নেওয়েলস মেসির চিকিৎসার ব্যয়ভার বহনে প্রাথমিকভাবে রাজি হয় কিন্তু পরবর্তীতে তারা তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে।
আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেসের রিভার প্লেট ফুটবল ক্লাব মেসিকে তাদের দলে খেলাতে চাইলেও তাঁর চিকিৎসার জন্য অর্থব্যয় করতে অস্বীকার করে তারা। এরপর কিছু আত্মীয়ের মাধ্যমে মেসির পরিবার স্পেনের কাতালোনিয়ায় ২০০০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বার্সেলোনা ক্লাবের কাছে মেসির খেলার ব্যাপারে আবেদন জানায়। মেসির অনবদ্য খেলায় মুগ্ধ হয়ে বার্সেলোনার প্রথম টিম ডিরেক্টর চার্লি রেক্সাচ অবিলম্বে তাঁকে চুক্তিবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন কিন্তু বার্সেলোনা দলের পরিচালনা পর্ষদ কিঞ্চিৎ ইতস্তত করেছিল সেই সময় মেসির মত এত অল্প বয়সী বিদেশী খেলোয়াড়কে চুক্তিবদ্ধ করার ব্যাপারে। ১৪ ডিসেম্বর বার্সেলোনাকে যখন তাঁদের প্রতিশ্রুতি রক্ষার শেষ সুযোগ দেওয়া হয় তখন তড়িঘড়ি হাতের কাছে কোনো কাগজ না পেয়ে একটি কাগজের ন্যাপকিনের ওপর চুক্তিপত্র লিখে মেসিকে প্রস্তাব দেন রেক্সাচ। ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মেসি সপরিবারে বার্সেলোনায় স্থানান্তরিত হন যেখানে তাঁরা ক্লাবের স্টেডিয়াম ক্যাম্প ন্যু’র কাছে একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেন। দলের সঙ্গে মানিয়ে নিতে প্রথমে মেসির সমস্যা হয়েছিল। আসলে স্বভাবগতভাবে ছোট থেকেই ভীষণ শান্ত প্রকৃতির ছিলেন তিনি।
বার্সেলোনার যুব একাডেমি লা মাসিয়াতে এক বছর থাকার পর, মেসি অবশেষে ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রয়্যাল স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশনে (RFEF) নথিভুক্ত হন। সমস্ত প্রতিযোগিতায় খেলতে খেলতে জেরর্ড পিকে, ফেবরিগাসদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হতে থাকে তাঁর। চোদ্দ বছর বয়সে তাঁর গ্রোথ হরমোন ট্রিটমেন্ট শেষ করার পর মেসি বার্সেলোনার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ যুব দল “বেবি ড্রিম টিম” এর অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠেন। ক্যাডেটস- এ দলের হয়ে ৩০টি ম্যাচে ৩৬টি গোল করেন তিনি এবং তাঁর দল স্প্যানিশ এবং কাতালান উভয় কাপই জেতেন। মরশুমের শেষদিকে তিনি আর্সেনাল ক্লাবে খেলার প্রস্তাব পেয়েছিলেন কিন্তু যাননি।
২০০৩-০৪ মরশুমে জুভেনাইলস বি -এর সাথে চারটি আন্তর্জাতিক প্রাক-মরশুম প্রতিযোগিতায় টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন তিনি। ২০০৩ সালের পর থেকে বার্সেলোনা ক্লাবের রিজার্ভ সাইড বার্সেলোনা বি-এর সঙ্গে নিয়মিত এবং বার্সেলোনা – এ দলের সঙ্গে সাপ্তাহিক প্রশিক্ষণ শুরু করেন মেসি। সিনিয়র স্কোয়াডের সঙ্গে প্রথম প্রশিক্ষণের পর ব্রাজিলের সতীর্থ খেলোয়াড় রোনাল্ডিনহো ভীষণই প্রশংসা করেন মেসির। আরও ম্যাচের অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য মেসি জুভেনাইলস ছাড়াও বার্সেলোনা সি- তে যোগ দেন এবং ২৯ নভেম্বর সেই তৃতীয় দলের হয়ে প্রথম খেলা খেলেন। দশটি ম্যাচে পাঁচটি গোল করে তিনি টেরসেরা ডিভিশনের খেলায় পিছনের সারিতে চলে যাওয়ার হাত থেকে তাঁর দলকে বাঁচতে সাহায্য করেছিলেন । তাঁর এই অনন্য কৃতিত্বের ফলস্বরূপ ২০০৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি প্রথম পেশাদার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তাঁর সঙ্গে এবং দলে মেসির মেয়াদ ২০১২ পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
এর একমাস পরে ৬ মার্চ সেগুনডা ডিভিশন বি-তে বার্সেলোনা বি-এর হয়ে অভিষেক করেন মেসি। সেই মরশুমে বি দলের সঙ্গে পাঁচটি ম্যাচ খেলেও কোনো গোল পাননি তিনি। মরশুমের শেষদিকে জুভেনাইল বি লিগ জিততে সাহায্য করেন তিনি। এই লিগে মোট ৩৬টি গোল করেন তিনি।
২০০৪-০৫ মরশুমে বি দলের হয়ে সতেরোটি ম্যাচ খেলেন মেসি যার মধ্যে ছয়টি ম্যাচে তিনি গোল করেন৷ ২০০৪ সালের অক্টোবরে সিনিয়র খেলোয়াড়রা কোচের কাছে মেসির পদোন্নতির আবেদন জানান৷ সতেরো বছর বয়সী মেসি সেসময় বার্সেলোনা দলের সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় ছিলেন। সেই মরশুমে একজন বদলি খেলোয়াড় হিসেবে এ দলের হয়ে ২৪৪ মিনিট খেলেন মেসি। সেই বছরেই শাখতার দোনেস্কের বিপক্ষে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে অভিষেকও হয় তাঁর। সিনিয়র খেলোয়াড় হিসেবে রোনাল্ডিনহোর সহায়তায় ২০০৫ সালের ১ মে তিনি প্রথম গোল করেন আলবাসেতের বিপক্ষে ৷
২৪ জুন আঠেরোতম জন্মদিনে মেসি সিনিয়র দলের একজন খেলোয়াড় হিসেবে প্রথম চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তি অনুযায়ী ২০১০ সাল পর্যন্ত তিনি বার্সেলোনার সিনিয়র দলের খেলোয়াড় হিসেবে স্থায়ী হন।
সেসময় জুভেন্টাস ক্লাব থেকে মেসিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়, এমনকি ইন্টার মিলান মেসিকে তিনগুন বেতনেরও প্রস্তাব দেয়। কিন্তু মেসি বার্সেলোনাতেই থাকার সিদ্ধান্ত নেন। তিন মাসের মধ্যে তাঁর চুক্তি দ্বিতীয়বার আপডেট করা হয় এবং মেসির মেয়াদ ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
রয়্যাল স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশনে তাঁর অবস্থান সম্পর্কিত আইনি সমস্যার কারণে মেসি লা লিগায় খেলতে পারেননি। অবশেষে ২৬ সেপ্টেম্বর তিনি স্পেনের নাগরিকত্ব অর্জন করেন এবং খেলার যোগ্য হন। ১৯ নভেম্বর প্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদের বিরুদ্ধে প্রথম ক্লাসিকো খেলেন মেসি। ২০০৬-০৭-এর মরশুমে মেসি উনিশ বছর বয়সে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়দের তালিকায় স্থান করে নেন। ২০০৭ সালের ১০ মার্চ ক্লাসিকোতে প্রথম হ্যাটট্রিক করেন তিনি। ১৮ এপ্রিল কোপা দেল রে-এর সেমিফাইনালে গেটাফের বিরুদ্ধে করা তাঁর অসামান্য গোলটি ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’ নামে খ্যাত ।
২০০৭ সালে ব্যলন ডি’অরের দৌড়ে তৃতীয় হন মেসি। ২০০৭-০৮ মরশুমে ১৬টি গোল করেন তিনি। রোনাল্ডিনহো বার্সেলোনা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর সম্মানীয় ১০ নম্বর জার্সিটি মেসির জন্য বরাদ্দ হয়। মেসি হয়ে ওঠেন ক্লাবের সর্বোচ্চ বেতনভোগী খেলোয়াড়। ২০০৮-০৯ মরশুমে ৫১টি ম্যাচে ৩৮টি গোল করেন তিনি। সেই মরশুমে পেপ গুয়ার্দিওলা নতুন কোচ হন এবং কোপা দেল রে ও লা লিগা চ্যাম্পিয়ন হয় বার্সেলোনা। সবচেয়ে কম বয়সী খেলোয়াড় হিসেবে নয়টি গোল করে চ্যাম্পিয়নস লিগের সর্বোচ্চ স্কোরার হন তিনি। সেবার এই লিগের চ্যাম্পিয়ন হয় বার্সেলোনা।
২০০৯ সালের আগস্টে সুপারকোপা দে এস্পানা এবং উয়েফা সুপার কাপে জয়লাভ করেন বার্সেলোনা। সেবছরই বাইশ বছরের মেসি প্রথম ব্যলন ডি’অর পান। এরপর আরও ছয়বার, যথাক্রমে, ২০১১, ২০১২, ২০১৩, ২০১৬, ২০১৯ এবং ২০২১-এ তিনি ব্যলন ডি’অর পেয়েছিলেন। ২০১০ সালের ৬ এপ্রিল চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে আর্সেনালের বিপক্ষে ৪টি গোল করে বার্সেলোনার সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন মেসি। সেবছর প্রথম ইউরোপীয় গোল্ডেন শু পান তিনি৷ মোট ছ’টি গোল্ডেন শু আছে তাঁর। ২০১১-১২ মরশুমে সমস্ত ক্লাব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে প্রায় দশ বা তার বেশি হ্যাট্রিক করেন মেসি। সেবছর ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ জেতে বার্সেলোনা। এই বছরেই মেসি উয়েফা সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জেতেন৷ ২০১২ সালে একটি ক্যালেন্ডার বছরে সর্বাধিক গোলের জন্য গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করেন তিনি।
টানা দুবছর লা লিগায় শীর্ষ গোলদাতা ছিলেন মেসি। ক্লাসিকোরও সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন তিনি। ২০১৫-১৬ মরশুমে চ্যাম্পিয়নস লিগে সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে ১০০ ম্যাচ খেলেন তিনি। ২০১৬ সালে ৫১টি গোল করে ইউরোপের সর্বোচ্চ স্কোরার হন তিনি৷ সেবছর সেরা ফিফা পুরুষ খেলোয়াড়ের খেতাবও অর্জন করেন তিনি। ২০১৮ সালে প্রথমবার বার্সেলোনা ফুটবল দলের অধিনায়ক হন তিনি। অধিনায়ক হিসেবে ১২ আগস্ট সুপারকোপা দে এস্পানা জেতেন। ২০১৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি মেসি কেরিয়ারের পঞ্চাশতম হ্যাটট্রিক করেন। ২০২১ সালের ১ জুলাই বার্সেলোনায় চুক্তির মেয়াদ শেষ হয় মেসির। ৫ আগস্ট ঘোষণা করা হয় মেসি আর ক্লাবে থাকবেন না। বার্সেলোনার হয়ে ৭৭৮টি ম্যাচে মোট ৬৭২টি গোল করেন মেসি।
২০২১ সালের ১০ আগস্ট মেসি প্যারিস সেন্ট জার্মেই ক্লাবে যোগ দেন। ২০২৩ পর্যন্ত দুই বছরের চুক্তি স্বাক্ষর করেন তিনি। প্রথমে ফর্ম খারাপ গেলেও পরে তা ফিরে পান তিনি।
ক্লাবের পাশাপাশি আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের হয়েও অনন্য কিছু অবদান রেখেছেন মেসি। তাঁর সতেরোতম জন্মদিনের পাঁচদিন পর প্যারাগুয়ের বিপক্ষে দেশের হয়ে প্রথম অভিষেক করেন তিনি। আঠেরো বছর বয়সে ফেরেঙ্ক পুস্কাস স্টেডিয়ামে দেশের হয়ে অভিষেক হয় তাঁর। ২০০৬ ফিফা বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার অংশগ্রহণের আগে দলের হয়ে নিয়মিত খেলেন তিনি এবং ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে ১ মার্চ ২০০৬ -এ একটি প্রীতি ম্যাচে দলের হয়ে তাঁর প্রথম গোল করেন। ২০১০ বিশ্বকাপে মারাদোনার কোচিং-এ দলকে নেতৃত্ব দিয়েও সাফল্য আনতে পারেননি মেসি। ২০১৪ সালের বিশ্বকাপে ফাইনালে হারেন জার্মানির কাছে যদিও সর্বোচ্চ গোল স্কোরার হিসেবে মেসি গোল্ডেন বল জেতেন। ২০১৫ কোপা আমেরিকায় দেশের হয়ে ১০০তম ক্যাপ অর্জন করেন তিনি। ২০১৬ সালের কোপা আমেরিকায় টানা তিনটি ম্যাচ হারার পর মেসি অবসর ঘোষণা করেন। এই সিদ্ধান্তে আর্জেন্টিনায় তাঁর ভক্তরা রাস্তায় নেমে অবসর আটকানোর জন্য প্রচার চালাতে থাকেন, দেশের প্রেসিডেন্টও মেসিকে পদত্যাগ না করার আহ্বান জানান। ২০১৮ সালের ১২ আগস্ট মেসি সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেন। ২০১৮ সালের বিশ্বকাপেও অধরা থেকে যায় মেসির স্বপ্ন। অবশেষে ২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপে ফাইনালে ফ্রান্সকে হারিয়ে বহু কাঙ্খিত বিশ্বকাপ হাতে তুলে নেন মেসি। অন্যদিকে ২০২১ সালে ব্রাজিলকে হারিয়ে যেতেন কোপা আমেরিকা কাপ।
তিনবার ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ, তিনবার উয়েফা সুপার কাপ, চারবার উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ কাপ, আটবার সুপারকোপা ডি এস্পানা কাপ, সাতবার কোপা দেল রে এবং নয়বার লা লিগা কাপ জেতেন মেসি। লা লিগার সেরা খেলোয়াড় পুরস্কার-সহ আরও বিভিন্ন খেতাবে ভূষিত হয়েছেন তিনি।
মেসি তাঁর বাল্যসঙ্গী আন্তোনেলা রোকুজ্জোকে ২০১৭ সালের ৩০ জুন বিবাহ করেন। বিবাহ পূর্ববর্তী তাঁদের দুই সন্তানের নাম থিয়াগো মেসি এবং মাতো মেসি রোকুজ্জো। বিয়ের পরে একটি মেয়ে হয় তাঁদের যার নাম সিরো মেসি রোকুজ্জো।
২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ছয় বছরের মধ্যে পাঁচ বছর বিশ্বের সর্বোচ্চ বেতনভোগী ফুটবলার ছিলেন লিওনেল মেসি ।
একজন সাংসারিক মানুষ হওয়ার পাশাপাশি লিওনেল মেসি অত্যন্ত মানবদরদী একজন মানুষও বটে। ২০০৪ সাল থেকে জাতিসংঘ শিশু তহবিলে অর্থ প্রদান করে আসছেন তিনি। আর্জেন্টিনায় যুব ফুটবলেও বিনিয়োগ করেছেন। করোনা ভাইরাসের মোকাবিলার জন্য ১.১ মিলিয়ন ডলার দান করেছিলেন তিনি। এছাড়াও আরও নানা সমাজসেবামূলক কাজে এগিয়ে গিয়েছেন তিনি বিভিন্ন সময়ে।
২০১৩ সালে কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ তোলা হয় মেসির বিরুদ্ধে। ২০১৬ সালের ৬ জুলাই কর জালিয়াতির জন্য দোষী সাব্যস্ত হন তিনি। শেষ পর্যন্ত তাঁর কারাদণ্ড স্থগিত করে জরিমানার আদেশ করা হয়।
ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর সঙ্গে মেসির প্রতিদ্বন্দ্বিতা ফুটবলের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
One comment