গ্যারি লিনেকার

গ্যারি লিনেকার

ইংল্যান্ডের ফুটবল ইতিহাস যেসব কিংবদন্তি ফুটবলারদের অবদানে সমৃদ্ধ তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন গ্যারি লিনেকার (Gary Lineker)। লেইসেস্টার সিটি ফুটবল ক্লাব থেকে কেরিয়ার শুরু করবার পর তিনি এভারটন, বার্সেলোনা, টটেনহ্যাম হটস্পারের মতো জনপ্রিয় দলগুলিতে নিজের দক্ষতা প্রদর্শন করেছিলেন দীর্ঘদিন। আন্তর্জাতিক কেরিয়ারে প্রায় ৮০টি ক্যাপ অর্জন করেছেন এবং সেই সাথে গোল করেছেন ৪৮টি। ইংল্যান্ডের জাতীয় দলের চর্তুথ সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে গ্যারি লিনেকারের নাম। ১৯৮৬ ফিফা বিশ্বকাপে মারাদোনার আর্জেন্টিনা কাপ জিতলেও সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবে লিনেকার পেয়েছিলেন গোল্ডেন বুট। বর্তমানে তিনি একজন প্রসিদ্ধ ফুটবল বিশেষজ্ঞ এবং ক্রীড়া সম্প্রচারকারী। এছাড়াও নানারকম টেলিভিশন শো-তেও বিভিন্ন ভূমিকায় তাঁকে দেখা গেছে বহুবার। 

১৯৬০ সালের ৩০ নভেম্বর ইংল্যান্ডের লেইসেস্টারে গ্যারি উইনস্টন লিনেকারের জন্ম হয়। তাঁর বাবা ব্যারি লিনেকার ছিলেন মূলত একজন সবজি বিক্রেতা। লিনেকারের মায়ের নাম মার্গারেট। উইনস্টন চার্চিলের থেকেই লিনেকারের মধ্য নামটি উইনস্টন দেওয়া হয়েছিল কারণ চার্চিল এবং গ্যারির জন্মদিন একই তারিখে।

ছোটবেলায় ভাই ওয়েনের সঙ্গে ফুটবল খেলে লেইসেস্টার শহরেই বেড়ে উঠেছেন লিনেকার। এর পাশাপাশি লেইসেস্টার বাজারে বাবার সবজির দোকানেও সাহায্য করতেন তিনি।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

গ্যারি লিনেকারের শিক্ষাজীবন লেইসেস্টারে অবস্থিত ব্রাউনস্টোনের ক্যালডেকোট রোড স্কুলে শুরু হয়। স্কুল শিক্ষা শেষ করে তিনি এভিংটনের ডাউনিং ড্রাইভের সিটি অব লেইসেস্টার বয়েজ গ্রামার স্কুলে (বর্তমানে লেইসেস্টার কলেজ) ভর্তি হন। প্রচলিত রাগবি খেলার পরিবর্তে ফুটবল খেলাকেই লিনেকারের পছন্দ হওয়ার একটি প্রধান কারণ হল, তাঁর বাড়ির কাছাকাছি সমস্ত স্কুলেরই প্রায় প্রধান খেলাই ছিল ফুটবল। কিন্তু কেবল ফুটবল নয়, ক্রিকেট খেলাতেও সমান দক্ষ ছিলেন তিনি৷ এগারো থেকে ষোলো বছর বয়স পর্যন্ত লেইসেস্টারশায়রের স্কুল ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ছিলেন তিনি। ব্রিটিশ কমেডি শো ‘দে থিঙ্ক ইটস অল ওভার’ -এ এসে লিনেকার বলেছিলেন যে কিশোর বয়সে তিনি ইংল্যান্ডের প্রাক্তন অধিনায়ক ডেভিড গাওয়ারকে তাঁর জীবনের আদর্শ বলে মনে করতেন। ১৯৭৬ সালে লিনেকার লেইসেস্টার সিটির যুব একাডেমিতে যোগ দেন।

১৯৭৭ সালে স্কুল ছাড়ার পর নিজের শহরের ক্লাব লেইসেস্টার সিটি থেকেই নিজের ফুটবল কেরিয়ার শুরু করেন তিনি। ১৯৭৯ সালের ইংরেজি নববর্ষের দিনে ফিলবার্ট স্ট্রিটে দ্বিতীয় বিভাগে ওল্ডহ্যাম অ্যাথলেটিকের বিরুদ্ধে সিনিয়র খেলোয়াড় হিসেবে তাঁর অভিষেক ঘটে। সেই ম্যাচ ২-০ গোলে জেতেন লিনেকাররা। প্রায় ১৯টি ম্যাচ খেলে একবছর পর তিনি দ্বিতীয় বিভাগের টাইটেল মেডেল পান। ১৯৮১-৮২ সাল থেকে লিনেকার একজন নিয়মিত খেলোয়াড়ে পরিণত হন। সেই মরশুমে উনিশটি গোল করেছিলেন তিনি। সেবার এফএ কাপের সেমিফাইনালে পৌঁছেছিলেন তাঁরা। ১৯৮৩-৮৪ সালে তিনি বাইশটি গোলসহ ডিভিশনের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্কোরার ছিলেন। আবার ১৯৮৪-৮৫ সালে চব্বিশটি গোল করে অ্যালান স্মিথের সঙ্গে যৌথভাবে প্রথম বিভাগের সর্বোচ্চ স্কোরার হন তিনি। নিয়মিত এইধরনের উচ্চমানের পারফরম্যান্স দিয়ে লিনেকার বড় দলের মনোযোগ আকর্ষণ করতে থাকেন।

১৯৮৫ সালে এভারটন ক্লাব গ্যারি লিনেকারকে আট লক্ষ পাউন্ডের বিনিময়ে ক্লাবের সাথে চুক্তিবদ্ধ করায়। ১৯৮৫-৮৬ সালের মরশুমে এভারটনের হয়ে তিনি সাতান্নটি ম্যাচে চল্লিশটি গোল করেছিলেন। সেই মরশুমে আবারও ত্রিশটি গোলসহ প্রথম বিভাগের প্রধান গোলদাতা হন লিনেকার। উল্লেখ্য এই ত্রিশটি গোলের মধ্যে হ্যাটট্রিক ছিল তিনটে। এভারটনকে লীগে দ্বিতীয় স্থান দিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন তিনি। এভারটনে থাকাকালীন গ্যারি লিনেকার টানা তিন বছর ক্লাবকে এফএ কাপের ফাইনালে পৌঁছে দিয়েছিলেন যদিও লিভারপুলের কাছে শেষবার ফাইনালে হেরে যান তাঁরা। যদিও কোনোবারেই কোন শিরোপা তিনি ক্লাবকে এনে দিতে পারেননি, কিন্তু ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার পরেও তিনি বলেছেন এভারটন হল তাঁর খেলা সেরা ক্লাব।

১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে মারাদোনার আর্জেন্টিনা কাপ জয় করলেও সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবে গোল্ডেন বুট অর্জন করেন লিনেকার। সেই বছরেই বার্সেলোনা ফুটবল ক্লাবে ২.৮ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে যোগদান করেন লিনেকার। সেসময় বার্সেলোনা পরিচালনা করছিলেন কুইন্স পার্ক রেঞ্জার্সের প্রাক্তন ম্যানেজার টেরি ভেনেবলস। বার্সেলোনা লিনেকারকে ইউরোপীয় ফুটবলে খেলার প্রথম সুযোগ দেয়। রেসিং স্যান্টান্ডার নামক একটি অনামী ক্লাবের বিপক্ষে বার্সেলোনায় অভিষেক হয় গ্যারি লিনেকারের। সেই ম্যাচে দুটি গোল করেন তিনি। বার্সেলোনায় যোগ দেওয়ার পর প্রথম মরশুমে একচল্লিশটি ম্যাচে একুশটি গোল করেছিলেন তিনি যার মধ্যে একটি ছিল হ্যাটট্রিক। বার্সেলোনা ১৯৮৮ সালে কোপা দেল রে এবং ১৯৮৯ সালে ইউরোপীয়ান উইনার্স কাপ জিতেছিল। বার্সেলোনার ম্যানেজার ইয়োহান ক্রুয়েফ মিডফিল্ডের ডানদিকে লিনেকারকে খেলানোর সিদ্ধান্ত নেন। এরপর একশো তিনটি লা লীগা ম্যাচে বিয়াল্লিশটি গোল করে তিনি লীগের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ব্রিটিশ গোলদাতা হয়ে ওঠেন।

১৯৮৯ সালে লিনেকার ইংলিশ ক্লাব টটেনহ্যাম হটস্পারে চলে যান ১.১ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে। সেই ক্লাবের প্রথম মরশুমেই চব্বিশটি গোল করে আবার গোলদাতার তালিকার শীর্ষে চলে যান তিনি। ১৯৯১ সালে টটেনহ্যামকে এফএ কাপ জিততে সাহায্য করেছিলেন তিনি। এই ক্লাবের হয়ে তিন মরশুমে মোট ১০৫টি ম্যাচে ৬৭টি গোল করেন লিনেকার। ১৯৮৯-৯০ মরশুমে প্রথম বিভাগের সর্বোচ্চ স্কোরার ছিলেন তিনি। টটেনহ্যাম হটস্পারের এফএ কাপের ফাইনালে যাওয়ার নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল লিনেকারের। সেমিফাইনালে প্রতিদ্বন্দ্বী আর্সেনালের বিপক্ষে দুটি গোল করেন তিনি। ১৯৯১-৯২ সালে ৩৫টি খেলায় ২৮টি গোল করে তিনি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা হন৷ প্রি-প্রিমিয়ার লীগে লিনেকার ভালো খেললেও দল ভালো অবস্থান টিকিয়ে রাখতে পারেনি। ইংলিশ ফুটবলে তাঁর শেষ গোলটি আসে মরশুমের শেষ দিনে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে, যদিও হেরে যান তাঁরা।

১৯৯১ সালের নভেম্বরে, লিনেকার জাপানি ফুটবল ক্লাব নাগোয়া গ্রামপাস এইটের থেকে দুই বছরের চুক্তির প্রস্তাব গ্রহণ করেন। এই ক্লাবে যোগদানের আগে লিনেকারের কাছে প্রস্তাব এসেছিল ব্ল্যাকবার্ন রোভার্সের তরফ থেকে, যদিও তা প্রত্যাখান করে টটেনহ্যাম। এই গ্রামপাস এইট ক্লাবে খেলার সময় চোটের কারণে তেইশটি ম্যাচে মাত্র নয়টি গোল করেন তিনি। অবশেষে ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বরে ফুটবল থেকে অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন গ্যারি লিনেকার ।

আন্তর্জাতিক ফুটবলে দেশের জার্সিতেও লিনেকার ছিলেন অনবদ্য। ১৯৮৪ সালে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ইংল্যান্ডের জাতীয় দলের হয়ে প্রথমবার খেলেছিলেন তিনি। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ছয় গোল করে প্রথম ইংরেজ খেলোয়াড় হিসেবে গোল্ডেন বুটের শিরোপা পান তিনি। পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে এই বিশ্বকাপ টুর্নামেন্টে দ্বিতীয় ইংরেজ ফুটবলার হিসেবে দ্বিতীয় দ্রুততম হ্যাটট্রিক করেন তিনি। বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের হয়ে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে একমাত্র গোলটি করেন তিনি। আবার ১৯৮৮ সালের ইউরোতে ইংল্যান্ড পরপর তিনটি ম্যাচে হেরে যায় এবং গোটা টুর্নামেন্টেই একটিও গোল করতে পারেননি লিনেকার। পরে জানা যায় লিনেকার সেই সময় হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠার আগেই ১৯৯০ বিশ্বকাপ শুরু হয়ে যায়। অসুস্থতা সত্ত্বেও তিনি চারটি গোল করে ইংল্যান্ডকে একক কৃতিত্বে সেমিফাইনালে পৌঁছে দেন। সেমিফাইনালে পশ্চিম জার্মানি পেনাল্টি শুট আউটে জিতে যায়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য ইংল্যান্ড ফুটবল দলের জাতীয় সঙ্গীতেও লিনেকারের গোল করার প্রসঙ্গটির উল্লেখ রয়েছে।

আন্তর্জাতিক ফুটবলে আশিটি ক্যাপ এবং আটচল্লিশটি গোল রয়েছে লিনেকারের।  ইউরো ৯২-এ সুইডেনের বিপক্ষে ইংল্যান্ডের হয়ে ফুটবল কেরিয়ারের শেষ ম্যাচটি খেলেন তিনি। তাঁর সমগ্র ফুটবল  কেরিয়ারে কখনও লাল বা হলুদ কোন কার্ড দেখতে হয়নি তাঁকে।

পেশাদার ফুটবল থেকে অবসর গ্রহণের পর লিনেকার ফুটবল বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিবিসি চ্যানেলেযোগ দেন। ১৯৯৫ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে  প্রথমে বিবিসি রেডিও ফাইভ লাইভ শো-তে ফুটবল বিশেষজ্ঞ, পরে বিবিসির ফুটবল সংক্রান্ত অনুষ্ঠান ম্যাচ অব দ্য ডে-তে সঞ্চালক, স্পোর্টস গেম শো ‘দে থিঙ্ক ইটস অল ওভার’ অনুষ্ঠানের অধিনায়ক ইত্যাদি নানা ভূমিকায় দেখা গেছে তাঁকে। কেবল ফুটবল নয়, বিবিসিতে সম্প্রচারিত গল্ফ খেলার কভারেজের দায়িত্বও সামলেছেন লিনেকার। ১৯৮৭ সালে প্রিন্স এডওয়ার্ডের বিশেষ টেলিভিশন শো ‘দ্য গ্র্যান্ড নকআউট’ টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করেছিলেন লিনেকার। ১৯৯১ সালে ‘অ্যান ইভিনিং উইথ গ্যারি লিনেকার’ নাটকে অভিনয়ও করেন তিনি। বিবিসিতে ছ’টি অংশে বিভক্ত একটি টিভি সিরিজ ‘গোল্ডেন বুটজ’-এর উপস্থাপনের কাজও করেন গ্যারি। ১৯৯৭ সালে রেসকোর্সে বোমা বিস্ফোরণের কারণে গ্র্যান্ড ন্যাশনাল নামক ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতাটি পরিত্যক্ত হওয়ার সময় লন্ডন স্টুডিওতে গ্র্যান্ডস্ট্যান্ড নামক একটি অনুষ্ঠান উপস্থাপন করেন তিনি। ২০০৬ সালে বিবিসির শিশুদের জন্য চ্যানেল সিবিবিসিতে আন্ডারগ্রাউন্ড আর্নির কন্ঠস্বর দিয়েছিলেন লিনেকার। ২০০৮ সালে হু ওয়ান্টস টু বি এ মিলিয়নেয়ারে উপস্থিত হন তিনি। আল জাজিরা স্পোর্টসের জন্য ইংরেজি ভাষার ধারাভাষ্যকার হিসেবেও কাজ করেন তিনি।  বিবিসির মতে লিনেকার ছিলেন বিবিসির সর্বোচ্চ বেতনভোগী কর্মচারী।

এছাড়াও ওয়াকারস কোম্পানির স্ন্যাক্সের বিজ্ঞাপনেও লিনেকার উপস্থিত ছিলেন। ২০১৪ সালে টনি পাস্তরের সঙ্গে নিজের প্রযোজনা সংস্থা গোলহ্যাঙ্গার ফিল্মস লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন তিনি । কোভিডের সময় ভাইরাস নিয়ে গবেষণার জন্য ব্রিটিশ রেড ক্রসকে প্রভূত অর্থ দান করেন তিনি।

বর্তমানে লিনেকার সিএলএসআই সার্জেন্ট নামক শিশুদের ক্যান্সার দাতব্য সংস্থার পাশে রয়েছেন৷ এছাড়াও আরও অনেকগুলি দাতব্য সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতা করছেন লিনেকার।

আপনার মতামত জানান