গায়ত্রী দেবী

গায়ত্রী দেবী

জয়পুরের প্রাক্তন রাজমাতা ছিলেন গায়ত্রী দেবী (Gayatri Devi)। তাঁর অসম্ভব সৌন্দর্য, ব্যক্তিত্ব এবং অতি-আধুনিক মননশীলতার জন্যেই তিনি আজও বিখ্যাত। ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিরোধিতা করে স্বতন্ত্র পার্টির সদস্য হয়ে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেছেন গায়ত্রী দেবী। জয়পুরের মহারাজা সওয়াই মান সিংহের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়েছিল। যদিও বংশগতভাবে কোচবিহারের মহারাজা জিতেন্দ্রনারায়ণের কন্যা ছিলেন তিনি। যৌবনের দিনগুলিতে সমগ্র ভারতে গায়ত্রী দেবী এক উজ্জ্বল ফ্যাশন তারকা হয়ে উঠেছিলেন। ভারতের স্বাধীনতার পর দেশীয় রাজ্যগুলির বিলুপ্তি ঘটতে থাকে এবং সেই সময় থেকেই স্বতন্ত্র পার্টির সদস্য হিসেবে সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যোগ দেন তিনি। ১৯৬২ সালে কংগ্রেসের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ২ লক্ষ ৫০ হাজার ৭২ টি আসনের মধ্যে ১ লক্ষ ৯২ হাজার ৯০৯টি ভোট পেয়ে কংগ্রেস প্রার্থী শারদী দেবীকে পরাজিত করেন এবং এত বিপুল ব্যবধানে বিজয়ের কারণে মহিলা প্রার্থী হিসেবে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে তাঁর নাম লিপিবদ্ধ হয়ে যায়।

১৯১৯ সালের ২৩ মে লন্ডনে গায়ত্রী দেবীর জন্ম হয়। আদপে তিনি কোচ রাজবংশী হিন্দু পরিবারের কন্যা ছিলেন। তাঁর বাবা ছিলেন সেকালের কোচবিহারের রাজা জিতেন্দ্রনারায়ণ। তাঁর মা ইন্দিরা রাজে ছিলেন মারাঠী রাজা তৃতীয় সওয়াজি রাও গায়কোয়াড়ের একমাত্র কন্যা এবং বরোদার রাজরানি। একাধারে রূপ-সৌন্দর্য এবং কিংবদন্তী সমাজতন্ত্রী হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি ছিল ভারতে। গায়ত্রী দেবীর ঠাকুরদাদা ছিলেন নৃপেন্দ্রনারায়ণ ভূপ এবং ঠাকুরমা সুনীতি দেবী ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য কেশবচন্দ্র সেনের কন্যা। গায়ত্রীর বাল্যকালে তাঁর জ্যাঠামশাইয়ের মৃত্যুর ফলে তাঁর বাবা জিতেন্দ্রনারায়ণকেই সিংহাসনে বসতে হয়। মাত্র ১২ বছর বয়সেই তৃতীয় সওয়াই মানসিংহের সঙ্গে আলাপ হয় গায়ত্রীর। সওয়াই প্রায়ই কলকাতায় আসতেন পোলো খেলতে আর তখন তাঁর পরিবারের সঙ্গেও সময় কাটাতেন তিনি। পরে ১৯৪০ সালের ৯ মে সওয়াই মানসিংহের সঙ্গে গায়ত্রী দেবীর বিবাহ হয়।

লন্ডনের গ্লেন্ডোয়ার প্রিপারেটরি স্কুলে প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করেন গায়ত্রী দেবী। তারপর দেশে ফিরে শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত পাঠভবন স্কুলে উচ্চতর পড়াশোনা সম্পন্ন হয় তাঁর। পরে সুইজারল্যান্ডের লুসেনে চলে যান গায়ত্রী দেবী আরও পড়াশোনা করার জন্য। সেখানে তাঁর মা ও ভাই-বোনেদের সঙ্গেই ছিলেন তিনি। পরে লন্ডন স্কুল অফ সেক্রেটারিজ থেকে সেক্রেটারিয়াল দক্ষতা বিষয়ে জ্ঞানার্জন করেন গায়ত্রী এবং লন্ডনের ব্লিল্যান্টমন্ট এবং মাঙ্কি ক্লাবেও কিছুদিন পড়াশোনা করেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই অশ্বারোহণের প্রতি অত্যন্ত উৎসাহী ছিলেন গায়ত্রী দেবী। তিনি নিজেও একজন দক্ষ পোলো খেলোয়াড় ছিলেন। নতুন নতুন বিদেশি গাড়ি কেনার শখ ছিল তাঁর। সেই সময় ভারতে তিনিই প্রথম মার্সিডিজ বেঞ্জ ডব্লিউ ১২৬ মডেলের গাড়িটি আমদানি করেন এবং তা পরে মালয়েশিয়ায় পাঠানো হয়। এছাড়াও বেশ অনেকগুলি রোলস রয়েস এবং নিজস্ব একটি বিমানও ছিল গায়ত্রীর। ১৯৪৯ সালে গায়ত্রী দেবী এবং সওয়াই মানসিংহের একটি পুত্র সন্তান জন্ম নেয় যার নাম ছিল প্রিন্স জগৎ সিংহ। গায়ত্রীকে বিবাহ করার আগে সওয়াই মান সিংহ আরও দুজনকে বিবাহ করেছিলেন। তা সত্ত্বেও গায়ত্রী স্বেচ্ছায় সওয়াইকে বিবাহ করেছিলেন। একসময় ‘ভগ’ (Vogue) পত্রিকার সমীক্ষায় দশজন অপূর্ব সুন্দরী মহিলার তালিকায় তাঁর নাম ছিল সর্বার্গ্রে।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

জয়পুরে দুটি স্কুলও চালু করেছিলেন গায়ত্রী দেবী। ১৯৪৩ সালে জয়পুরে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘মহারানি গায়ত্রী দেবী গার্লস পাবলিক স্কুল’ এবং পরে তাঁর স্বামী সওয়াই মানসিংহের স্মৃতিতে গায়ত্রী দেবী গড়ে তোলেন ‘সওয়াই মানসিংহ বিদ্যালয়’।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজন এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৬২ সালে সংসদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন গায়ত্রী দেবী এবং সেবারই লোকসভা নির্বাচনীতে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করেন তিনি। ২ লক্ষ ৪৬ হাজার ৫১৬ ভোটের মধ্যে তিনি পেয়েছিলেন মোট ১ লক্ষ ৯২ হাজার ৯০৯টি ভোট। এভাবে এত বিপুল ব্যবধানে কংগ্রেস প্রার্থী শারদী দেবীকে পরাজিত করে মহিলা প্রার্থী হিসেবে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে তাঁর নাম লিপিবদ্ধ হয়ে যায়। ১৯৬৭ এবং ১৯৭১ সালে চক্রবর্তী রাজা গোপালাচারীর প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন পার্টির সদস্য হিসেবে সক্রিয় রাজনীতি শুরু করেছিলেন গায়ত্রী দেবী। সেই পার্টির প্রার্থী হিসেবে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বিরোধিতা করেছিলেন নির্বাচনে। ১৯৬৫ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় গায়ত্রীকে পুনরায় কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। গায়ত্রীর স্বামী সওয়াই মানসিংহকে স্পেনের রাষ্ট্রদূত পদে অধিষ্ঠিত করা সত্ত্বেও গায়ত্রী দেবী তাঁর নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। ১৯৬৭ সালে স্বতন্ত্র পার্টি জনসংঘের সঙ্গে একত্রিত হয়। ১৯৬৭ সালের নির্বাচনে এই দুই দলের জোট বিপুল ভোট লাভ করে। কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনে মালপুরা আসনে গায়ত্রী দেবী দামোদর লাল ব্যাসের কাছে পরাজিত হলেও লোকসভা নির্বাচনে পুনরায় বিজয়ী হন। ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিরোধিতা করে স্বতন্ত্র পার্টির সদস্য হয়ে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেছেন গায়ত্রী দেবী। ১৯৭১ সালে সমস্ত রাজকীয় সুযোগ-সুবিধা ও উপাধি বাতিল করে প্রিভি পার্স (Privy Purse) বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়। জরুরি অবস্থার সময়ে গায়ত্রীকে কর সংক্রান্ত আইন অমান্য করার মিথ্যে অজুহাতে গ্রেপ্তারও করা হয়। সেইজন্যে তিহার জেলে তিনি ৫ মাস বন্দি থাকেন।

পোলো খেলার দক্ষতার জন্যেও বিখ্যাত ছিলেন গায়ত্রী দেবী। বাল্যকাল থেকেই এই ক্রীড়াশৈলীর প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন তিনি। ১৯৩৩ সালে কলকাতায় প্রথম তিনি একটি পোলো ম্যাচে অংশ নেন। পরবর্তীকালে জয়পুর রাইডিং অ্যান্ড পোলো ক্লাবের মুখ্য উপদেষ্টা পদেও আসীন ছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর পরে ২০০৯ সালে গায়ত্রী দেবীর পোলো খেলার দক্ষতাকে সম্মান জানাতে রামবাগ প্যালেসের বদান্যতায় ‘রাজমাতা গায়ত্রী দেবী মেমোরিয়াল কাপ’ আয়োজিত হয় আর্জেন্টিনায়। এমনকি সেখানে ‘মহারানি পোলো ক্লাব’ বলে একটি দলও গঠিত হয়েছিল।  

ক্রমে তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নেন এবং ১৯৭৬ সালে সান্তা রামা রাও তাঁর একটি জীবনী লেখেন ‘এ প্রিন্সেস রিমেমবার্স’ নামে। পরে ফ্রান্সিস লেভি নামে এক চলচ্চিত্র পরিচালক ‘ফিল্ম মেমোয়ার্স অফ এ হিন্দু প্রিন্সেস’ নামে একটি ছবি পরিচালনা করেন। গুজব রটেছিল যে ১৯৯৯ সালের দিকে তিনি পুনরায় কোচবিহার তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। কিন্তু এই প্রস্তাবে গায়ত্রী দেবী রাজি হননি। ২০১৩ সালে স্টেফান বার্নের পরিচালনায় গায়ত্রী দেবীর জীবন অবলম্বনে একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হয় প্রথম ফরাসি টেলিভিশনে।

২০০৯ সালের ২৯ জুলাই ৯০ বছর বয়সে ফুসফুস বিকল হয়ে যাওয়ার কারণে গায়ত্রী দেবীর মৃত্যু হয়।  

One comment

আপনার মতামত জানান