গরম ভাতে এক চামচ ঘি ফেলে খেতে কার না ভালো লাগে। সেই ঘি-এরও আবার কত ব্র্যাণ্ড। স্বাদ, গন্ধ সব পরীক্ষা করে আমাদের দেখে নেওয়া চাই। ঘিয়ের কৌটো খোলা হবে আর গন্ধে ঘর ভরে উঠবে না তা কি হয়! আলুসেদ্ধ ভাতই হোক বা পোলাও-বিরিয়ানি ঘিয়ের মাহাত্ম্য রান্নাকে এক অন্য এক মাত্রা এনে দেয়, এ কথা অনস্বীকার্য। বহু বহু কাল থেকে মানুষ কিন্তু বাড়িতেই ঘি বানিয়ে আসছে, এখন আবার কারখানায় আলাদা পদ্ধতিতেও ঘি তৈরি হয়। তাই চলুন আজ জেনে নেওয়া যাক ঘি তৈরি হয় কীভাবে ।
ঘি তৈরী হয় কীভাবে জানতে গেলে প্রথমেই বুঝতে হবে ঘি তৈরি একটি সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। বাড়িতে খুব সহজেই দুধ থেকে ঘি তৈরি করা সম্ভব। ভালো ঘিয়ের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন ভালোমানের দুধ। পরিমাণের হিসেবে কতটা দুধ থেকে কতটা ঘি হতে পারে সেটা স্পষ্ট করে বলা যায় না। কারণ, এই বিষয়টা দুধে ফ্যাটের পরিমাণের উপর নির্ভর করে। ফ্যাট বেশি থাকলে কম পরিমাণ দুধেই অনেকটা ঘি পাওয়া যেতে পারে। এখন ভালোমানের দুধ সংগ্রহ করার পরে তাকে ভালোমতো ফোটাতে হবে। দুধ ফুটতে ফুটতে যখন উপরে সর পড়ে যাবে ঠিক সেই সময় দুধ ফোটানো বন্ধ করে দিতে হবে। জ্বাল দেওয়ার পরে দুধ ক্রমে ঘন হয়ে আসবে। তারপর এই ফোটানো দুধকে ঘরের তাপমাত্রায় ঠাণ্ডা করে তার মধ্যে মেশাতে হবে টক দইয়ের বিছান বা ছাঁচা। সেটা দুধের সঙ্গে ভালোমতো মিশিয়ে ঢাকা দিয়ে এক বেলা রেখে দিতে হবে ঘরের অন্ধকার স্থানে। তারপর সেখান থেকে ননী বা মাখন আলাদা করার জন্য একটি কাঠের ঘুটনি ব্যবহার করে একবার ঘড়ির কাঁটার দিকে ও অন্যবারে আবার ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে সেই ঘুটনিটি ঘুরিয়ে ঐ গাঁজানো দুধ থেকে ঘোল ও মাখন আলাদা করতে হবে। মাখন আলাদা করার আগে সামান্য ঠাণ্ডা জল মিশিয়ে দিতে হবে ঐ মিশ্রণে। এতে মাখন কিছুটা শক্ত হয়ে যাবে এবং ঘুটনির গায়ে ভালো করে লেগে যাবে। এভাবে আস্তে আস্তে মাখন আলাদা করে তুলে নিয়ে এবারে সেই মাখনকেই একটি পাত্রে জ্বাল দিলে তৈরি হয়ে যাবে ঘি। তবে মাখন ছাড়া যেহেতু ঘি হয় না, তাই ঘি বেশি তৈরি করতে হলে মাখনও বেশি পরিমাণে দরকার। প্রয়োজনে বারবার মাখন তৈরি করে একটা পাত্রে জমাতে হবে এবং পরে একত্রে সেই মাখন জ্বাল দেওয়া যেতে পারে। মাখন জ্বাল দেওয়ার সময় অল্প আঁচে পাত্রটি বসাতে হবে। প্রথম পর্যায়ে ফুট-ফাট করে শব্দ হবে এবং ধীরে ধীরে তরল উজ্জ্বল সোনালি বর্ণের ঘি তৈরি হয়ে আসবে। ঘি তৈরি হয়েছে কিনা বোঝার সবথেকে ভালো উপায় হল পাত্রের নীচে বাদামি বর্ণের দানার অধঃক্ষেপ পড়বে। আর সেই সময়েই ঘিয়ের সুন্দর গন্ধ পাওয়া যাবে। এরপরে আগুন থেকে পাত্রটি নামিয়ে ছাঁকনি দিয়ে ভালো করে ছেঁকে ঘি বের করে নিতে হবে। যে পাত্রে ঘি রাখা হবে তা যেন শুকনো থাকে সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে এবং ঘিয়ের পাত্র সূর্যের আলো থেকে দূরে রাখাই উচিত। এছাড়া বাজার থেকে ক্রিম কিনে এনেও একইভাবে জ্বাল দিয়ে ঘি তৈরি করা যায় তবে তার গুণাগুণ একই রকম হবে না। অনেকে আবার বাজারের প্যাকেটজাত মাখন থেকেও ঘি তৈরি করে থাকেন। তবে গরুর দুধ থেকে উপরিউক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করে খাঁটি ঘি তৈরি করা সম্ভব।
উপরে আলোচিত পদ্ধতিতে প্রথাগতভাবে বহুকাল থেকেই বাড়িতে ঘি বানানো হয়ে থাকে। কিন্তু বাড়িতে আজকাল প্রচুর পরিমাণে ঘি তৈরি করা সম্ভব হয় না চাহিদার অনুপাতে। ফলে পুরো বিষয়টাই কারখানায় ব্যবসায়িক প্রয়োজনে তৈরি করা হয় উন্নত যন্ত্রের মাধ্যমে। কাঠের ঘুটুনির বদলে সেখানে যন্ত্রের সাহায্যে দুধকে ফাটিয়ে মাখন তোলা হয়। বাড়িতে দুধের প্রোটিনকে অক্ষত রেখেই ঘি তৈরি হয় ফলে তার মধ্যে প্রচুর মাত্রায় কনজুগেটেড লিনোলেয়িক অ্যাসিড (Conjugated Linoleic Acid) থাকে যা একইসঙ্গে অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট (Anti- Oxidant) এবং অ্যান্টি কার্সিনজেনিক (Anti- Carcinogenic) উপাদান। এই উপাদানটির কারণে বাড়িতে তৈরি ঘি বহুদিন অবিকৃত অবস্থায় থাকে। কিন্তু কারখানায় ব্যবসায়িক প্রয়োজনে ঘি তৈরির ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত কিছু পার্থক্য থাকে। ডেয়ারি সংস্থাগুলি দুধ থেকে মাখন তৈরি না করে দুধ থেকে আগে প্রযুক্তির সাহায্যে ক্রিম আলাদা করে নেয় এবং সেই দুধের ক্রিম থেকেই পরে ভালোমানের ঘি তৈরি হয়। মূলত চারটি উন্নত পদ্ধতিতে ঘি তৈরি হয় –
১) ডিরেক্ট ক্রিম মেথড (Direct Cream method)
২) ক্রিমারি-বাটার মেথড (Creamery-Butter Method)
৩) প্রি-স্ট্র্যাটিফিকেশন মেথড (Pre-Stratification Method)
৪) কন্টিনিউয়াস মেথড (Continious Method)
প্রথমত ডিরেক্ট ক্রিম পদ্ধতিতে একটি কেটলিতে দুধের ক্রিমটাকে ফোটানো হয় এবং এই ইস্পাতের কেটলির সঙ্গে জোড়া থাকে বাষ্প-তাপীয় জ্যাকেট, একটি এজিটেটর, একটি বাষ্প-নিয়ন্ত্রক ভালভ, চাপ ও তাপ নির্ণায়ক যন্ত্র ইত্যাদি। ক্রিম ফোটানোর পরে বাদামী বর্ণের ফেনা উঠলে ফোটানো বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর ফলে নীচে ঘিয়ের অবশিষ্টাংশ জমে যায় বাদামি রঙের আর তা থেকেই ঘি তৈরি হয়। তবে এই পদ্ধতিতে একবারে অনেক ঘি উৎপাদিত হলে পরেই খরচ সাধ্যের মধ্যে থাকে। তাছাড়া এই পদ্ধতিরও কিছু গুণগত ত্রুটি থেকে যায়। দ্বিতীয়ত ক্রিমারি বাটার পদ্ধতিতে দুধের সাদা ক্রিম ব্যবহৃত হয় মূল উপাদান হিসেবে যা ৬০০ থেকে ৮০০ সেলসিয়াস তাপে গলানো হয় বিশেষ যন্ত্রে। গলানো মাখন এরপর একটি বিশেষ প্রকোষ্ঠে পাঠানো হয় যেখানে বাষ্পের মধ্যে ঐ উপাদানটিকে ফোটানো হয়। এরপর বাষ্পের চাপ বাড়িয়ে তাপমাত্র ক্রমান্বয়ে বাড়ানো হয় এবং ধীরে ধীরে ঘিয়ের আসল সুগন্ধ বেরিয়ে আসে। মোটামুটি ভাবে ১১৪০ তাপমাত্রায় এই পদ্ধতিটি থামানো হয়। সবশেষে একটি তৈল নিষ্কাশকের মধ্য দিয়ে ঘিয়ের প্রবাহ পাঠিয়ে তেল নিষ্কাশন করে নেওয়া হয় যার ফলে এতে কোনো কোলেস্টেরল থাকে না। তৃতীয় পদ্ধতিটি একটু জটিল। এক্ষেত্রে ৩৮ থেকে ৪০ শতাংশ ফ্যাটযুক্ত সম্পৃক্ত ক্রিম থেকে মাখন প্রস্তুত করা হয় এবং গলিত মাখনকে ৮০০ তাপমাত্রায় ফোটানো হয়। পরে ঘিয়ের কেটলিতে এটি রেখে সেখানে আধ ঘন্টা ধরে ঐ একই তাপমাত্রায় ফোটানোর ফলে তিনটি স্তরে তা জমে যায় যার একেবারে মাঝের স্তরে থাকে ফ্যাট। শেষের আর উপরের স্তর খুব নিপুণভাবে সরিয়ে ঐ ফ্যাটের স্তরকে ফুটিয়ে ঘি পাওয়া যায়। আর সবশেষে কন্টিনিওয়াস পদ্ধতিতে সবথেকে বেশি ভালোমানের ঘি উৎপাদন করা হয়ে থাকে। এই পদ্ধতিতে ঘি থেকে বাষ্প আলাদা করে সরিয়ে নেওয়া হয় এবং পরিশোধিত ঘিয়ের যে অবশিষ্টাংশ থাকে তাও সরিয়ে নেওয়া হয়।
তবে অত্যধিক চাহিদার কারণে অনেকসময় প্রথাগত পদ্ধতিতে তৈরি ঘিতেও ভেজাল মেশানো হয়। পাম তেল, ক্রিম, রাসায়নিক স্বাদবর্ধক এবং কৃত্রিম গন্ধ সহযোগে ঘি বাজারজাত করা হয়। অনেক সময় দেখা যায়, শীতকালেও ঘি জমে না। এ থেকেই খাঁটি ঘি চেনা সম্ভব। খাঁটি ঘি মাত্রই অল্প শীত পড়লেই জমে যাবে। কিংবা সেই ঘিয়ের কৌটো যদি ঘরের শীতল স্থানে রাখা হয় তবে তা জমাটবাঁধা অবস্থাতেই থাকবে। তবে বর্তমানে ডেয়ারি শিল্পের উন্নতির কারণে নানারকম উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে ঘি তৈরি হয় কীভাবে এবং চাহিদা পূরণ সম্ভব হয় তা নিয়ে গবেষণা চলছে নিরন্তর।