২৪ জানুয়ারি ।। আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস

প্রতি বছর প্রতি মাসের নির্দিষ্ট কিছু দিনে বিভিন্ন দেশেই কিছু দিবস পালিত হয়। ঐ নির্দিষ্ট দিনে অতীতের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে স্মরণ করা বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতেই এই সমস্ত দিবস পালিত হয়। আন্তর্জাতিক স্তরে পালনীয় সেই দিবসগুলির মধ্যে একটি হল আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস (International Day of Education)।

প্রতি বছর ২৪ জানুয়ারি সমগ্র বিশ্ব জুড়ে পালিত হয় আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস । বর্তমানে সমগ্র বিশ্ব জুড়েই শিক্ষাকে সার্বজনীন স্তরে উপলব্ধ করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। শিক্ষা সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার। শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে এবং শিক্ষাকে বিশ্ব-শান্তি রক্ষা আর দীর্ঘমেয়াদী স্থায়ী উন্নয়নের জন্য ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে এই বিশেষ দিনটি পালিত হয়। তবে রাষ্ট্রসংঘের তরফে এই বিশেষ দিন উদ্‌যাপনের কিছু নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য স্থির করা হয়েছে। যেমন –

  • শিক্ষাকে সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে, সকল স্তরের মানুষকে শিক্ষাব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করতে এবং ড্রপ-আউট ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা কমাতে বিশেষ দৃষ্টি দিতে এবং মানুষকে সচেতন করতে পালন করা হয় আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস।
  • শিক্ষকমণ্ডলী, সরকার এবং বিভিন্ন সংস্থার তরফে শিক্ষাবিস্তারে একেবারে প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্বজুড়ে যে সকল কর্মসূচি গ্রহণ করেছে তা সবিস্তারে জানানোও এই দিনের অন্যতম উদ্দেশ্য। প্রাসঙ্গিকতা আর সমতার ভিত্তিতে শিক্ষাকে ছড়িয়ে দেবার মানসিকতাতেই রাষ্ট্রসংঘ এই দিনটি পালন করে থাকে।
  • রাষ্ট্রসংঘের ‘গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্ট’-এ উল্লিখিত ‘পিইইআর’ (PEER) ব্যবস্থাকে প্রায়োগিক স্তরে কাজে লাগানোর ব্যাপারে শিক্ষকমণ্ডলী ও শিক্ষাকর্মী সহ বিভিন্ন সংস্থাকে জানানোর জন্য এই দিন পালিত হয়।
  • করোনা মহামারীর প্রকোপে যে প্রজন্মের শিক্ষা বিপর্যস্ত হল, তাদের আশা, তাদের ভবিষ্যৎকে নিশ্চয়তা দিতে, স্বপ্নপূরণে সাহায্য করতে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আর্থিক মন্দাকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং জলবায়ুর এই বিরাট পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতনতা বিস্তারের লক্ষ্যে বর্তমানে আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস পালন করা হচ্ছে। প্রতিকূলতার মধ্যে বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষায় যাতে কোনো বিপর্যয় না ঘটে সে ব্যাপারে সকল প্রকার পদক্ষপে নেওয়ার জন্য রাষ্ট্রসংঘ উৎসাহিত করে।
  • অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থার (Inclusive Education) উপর জোর দেওয়া, ডিজিটাল পড়াশোনা এবং পরিবেশবান্ধব পড়াশোনার মাধ্যমের ব্যাপারে জনসচেতনতা বিস্তারের লক্ষ্যে এই দিনটি সমস্ত বিশ্বে পালনীয়।
  • লিঙ্গ বৈষম্যের উর্ধ্বে উঠে ব্যক্তিগত দক্ষতা আর প্রতিভাকে জোর দেওয়া, রাজনৈতিক শক্তি বা প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে সমস্ত রকমের বৈষম্য দূর করার চেষ্টা করতে প্রাণিত করে রাষ্ট্রসংঘ।
  • সবথেকে বড়ো ব্যাপার শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের উপযোগী কী ধরনের পরিবর্তন বা উন্নয়ন হলে শিক্ষার্থীরা লাভবান হবে সে ব্যাপারে তাঁদের থেকেই মত নেওয়া এবং তাঁদেরকে সরব করে তোলার জন্য এই দিন পালন করা অবশ্য কর্তব্য বলে মনে করে রাষ্ট্রসংঘ।
  • সভ্যতা এবং প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষকদেরকেও প্রযুক্তিকে আত্মস্থ করে নেওয়ার এবং তাকে শিক্ষাক্ষেত্রে অভিনব পদ্ধতিতে কাজে লাগাবার বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস পালন করা হয়।

২০১৯ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রথম রাষ্ট্রসংঘের উদ্যোগে প্রথম আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস পালিত হয়। ২০১৮ সালের ৩ ডিসেম্বর রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদে ২৪ জানুয়ারি দিনটিকে আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। নাইজেরিয়া সহ আরো ৫৮টি সদস্য রাষ্ট্রে সেই থেকেই এই দিনটি পালন করা হয়ে আসছে। রাষ্ট্রসংঘের প্রতিষ্ঠার প্রথম দিন থেকেই সবথেকে বড়ো প্রতিবন্ধকতা ছিল দারিদ্র্য দূরীকরণ। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে বেশিরভাগ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে দারিদ্র্যের হার আর নিরক্ষরতার হার প্রায় সমান। তাই প্রথম থেকেই রাষ্ট্রসংঘ নানা উদ্যোগের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণের পাশাপাশি শিক্ষাবিস্তারের চেষ্টা করে এসেছে। ২০১৯ সালে প্রথম এই দিবস উদ্‌যাপনে রাষ্ট্রসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল বলেছিলেন যে শিক্ষাই কেবলমাত্র ব্যক্তির জীবন বদলে দিতে পারে। রাষ্ট্রসংঘের শান্তিদূত মালালা ইউসুফজাইয়ের মতে একটি শিশু, একটি বই, একজন শিক্ষক এবং একটি পেন পুরো বিশ্বকে বদলে ফেলতে পারে। নেলসন ম্যাণ্ডেলাও মনে করতেন পৃথিবী বদলানোর সবথেকে শক্তিশালী অস্ত্র হল শিক্ষা। বর্তমান সমাজে শিক্ষা বিশ্বের দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম, এর মাধ্যমেই বৈষম্য দূর করা যায়, উন্নত করে তোলা যায় জনস্বাস্থ্য। লিঙ্গ বৈষম্য দূর করে বাল্যবিবাহের মতো কুপ্রথা রদ করতে শিক্ষাই একমাত্র উপায়। এমনকি এই পৃথিবীর বিপুল সম্পদকে রক্ষা করার জন্যেও শিক্ষা প্রয়োজন। ঘৃণা, অসহিষ্ণুতা, উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরোধিতা করার জন্য শিক্ষার বিস্তারে জোর দিয়েছে রাষ্ট্রসংঘ। এখনও বিশ্বে প্রায় ২৬ কোটি শিশু, কিশোর এবং যুবক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ড্রপ-আউট হয়ে গেছে এবং তাদের মধ্যে বেশিরভাগই মেয়ে। আবার যারা স্কুলে যাচ্ছে তাদেরও প্রাথমিক শিক্ষা অসম্পূর্ণ। বিংশ শতাব্দীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য প্রত্যেক শিশু-কিশোর-যুবাকে যথেষ্ট দক্ষ করে তোলা শিক্ষাব্যবস্থার একমাত্র উদ্দেশ্য আর সেটা না হলে তা মানবাধিকার লঙ্ঘনের আওতায় পড়ে। কারণ শিক্ষা প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। ‘ইউনিভার্সাল ডিক্ল্যারেশন অফ হিউম্যান রাইটস’-এর ২৬ নং ধারায় স্পষ্টই বলা আছে প্রাথমিক শিক্ষাকে অবশ্যই অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক করে তুলতে হবে। পরিসংখ্যায় দেখা গেছে যদি পৃথিবীর সকল ছেলে-মেয়ে অন্তত মাধ্যমিক স্তরের পড়াশোনাও শেষ করতে পারে তাহলে ৪ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ দারিদ্র্যমুক্ত হতে পারেন। ২০২০ সালে বিশ্বের করোনা মহামারীর পরিস্থিতিতে শিক্ষাঙ্গনগুলি সবথেকে বেশি বিপর্যস্ত হয়েছে। সমাবেশ বন্ধ রাখার জন্য শিক্ষাঙ্গনের প্রত্যক্ষ শিক্ষাদান ও পঠন-পাঠন পদ্ধতি বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীরা যাতে শিক্ষালাভ থেকে বঞ্চিত না হয় সেজন্য অনলাইন শিক্ষাপদ্ধতি চালু হয়ে যায় যেখানে বাড়ি বসেই শিক্ষার্থীরা তাঁদের প্রয়োজনীয় পাঠ গ্রহণ করতে পারে। এক্ষেত্রেও সমস্যার উদ্রেক হয়। চলে আসে বৈষম্যের প্রশ্ন, অনলাইন শিক্ষাপদ্ধতির জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী মোবাইল, ল্যাপটপ ইত্যাদি কেনার মতো সামর্থ্যও অধিকাংশ শিক্ষার্থীর নেই। তাই সর্বাগ্রে সেই দারিদ্র্য দূর করে সমাজের আর্থিক ভিত্তি আরো মজবুত করে তোলার দিকে রাষ্ট্রসংঘ মনোনিবেশ করেছে। কিন্তু শিক্ষার আলো নিভিয়ে দেওয়া যাবে না। আর এই নানাবিধ সচেতনতা ছড়িয়ে দিতেই সমগ্র বিশ্বে আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস পালন আশু প্রয়োজন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

শিক্ষার অধিকারের ব্যাপারে সকলকে সচেতন করতে বিভিন্ন জনসভা, সেমিনার আয়োজন করে থাকে রাষ্ট্রসংঘ। রাষ্ট্রসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলিও নানাভাবে শিক্ষাব্যবস্থার বিন্যাস এবং শিক্ষার্থীদের উৎসাহী করে তোলার প্রয়াস করে। তবে শিক্ষাঙ্গন বন্ধ রেখে এই দিন উদ্‌যাপন অর্থহীন বলে মনে করে রাষ্ট্রসংঘ। বিশ্বের প্রতিটি শিশু, যুবক এবং কিশোরকে শিক্ষার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে তোলার চেষ্টা করা হয়, প্রতি বছর নিজস্ব পরিসরে লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে এই কাজে প্রণোদিত করে রাষ্ট্রসংঘ।

২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবসের প্রথম উদ্‌যাপনের প্রতিপাদ্য (Theme) ছিল ‘শিক্ষা : অন্তর্ভুক্তি এবং ক্ষমতায়নের একমাত্র চাবিকাঠি’ (Education: A Key Driver for Inclusion and Empowerment)। ২০২০ সালে এই বিশেষ দিনের প্রতিপাদ্য ছিল ‘মানুষ, পৃথিবী, সমৃদ্ধি এবং শান্তির জন্য শিক্ষা’ (Learning for people, planet, prosperity and peace)। ২০২১ সালের প্রতিপাদ্যটি ছিল ‘কোভিড-প্রজন্মের জন্য শিক্ষার পুনরুদ্ধার এবং পুনর্জাগরণ’ (Recover and Revitalize Education for the COVID-19 Generation)। সবশেষে ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবসের প্রতিপাদ্য স্থির করা হয়েছে ‘পাঠক্রমের পরিবর্তন, শিক্ষার রূপান্তর’ (Changing Course, Transforming Education)।         

আপনার মতামত জানান