ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাস লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বহু আইনজীবী পরবর্তীকালে কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছেন। জগদীপ ধনকর (Jagdeep Dhankhar) ভারতবর্ষের চতুর্দশতম উপরাষ্ট্রপতি সেই গোত্রেরই অন্তর্ভুক্ত। পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন রাজ্যপাল জগদীপ বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও আইন-কানুনের প্রতি তাঁর তীব্র আগ্রহের কারণেই আইন বিষয়ে পড়াশোনা করে তিনি সুপ্রিম কোর্টে আইনচর্চা করতেন। হাইকোর্টের বার অ্যসোসিয়েশনের সভাপতি এবং পরে লোকসভার সদস্য হওয়ার পাশাপাশি তিনি বিধানসভার নির্বাচিত সদস্যও ছিলেন। ভারতীয় জনতা পার্টির উল্লেখযোগ্য নেতা ছিলেন জগদীপ ধনকর। লেখালেখির চর্চাও করতেন তিনি অবসরে এবং খেলাধুলাতেও তাঁর আগ্রহ লক্ষ্য করবার মতো। রাজস্থানের অলিম্পিক এবং টেনিস অ্যাসোসিয়েশনে গুরুত্বপূর্ণ পদ তিনি অলঙ্কৃত করেছেন একসময়। এছাড়াও রাজস্থানের পিছিয়ে পড়া মানুষদের উন্নতির কাজেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন জগদীপ। রাজনীতির ক্ষেত্রে তাঁকে নিয়ে এবং তাঁর মন্তব্য নিয়ে বিগত কয়েক বছরে বহু বিতর্ক হয়েছে।
১৯৫১ সালের ১৮ মে রাজস্থানের ঝুনঝুনু জেলার অন্তর্গত কিথানা নামক একটি ছোট গ্রামে জগদীপ ধনকরের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম শ্রী গোকল চাঁদ এবং মায়ের নাম কেশরী দেবী । জগদীপরা মোট তিন ভাই এবং এক বোন। তিন ভাইয়ের মধ্যে জগদীপ হলেন মধ্যম। জগদীপের বড় ভাই শ্রী কুলদীপ ধনকর বিবাহ করেছিলেন জয়পুরের কন্যা সুচেতাকে। ছোট ভাই রণদীপ ধনকরও জয়পুরের মেয়ে সরোজকে বিবাহ করেছিলেন। তাঁদের বোন শ্রীমতী ইন্দ্র আলোয়ারের বিবাহ হয় আইনজীবী ধরম পাল দুদির সঙ্গে। জগদীপের নিজের স্ত্রী সুদেশ ধনকর ছিলেন হোশিয়ার সিং এবং ভগবতীর কন্যা। সুদেশ ধনকর অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন এবং সামাজিক কাজ, জৈব চাষবাস ও শিশুশিক্ষায় তাঁর আগ্রহ ছিল প্রবল। জগদীপ ধনকর এবং সুদেশ ধনকরের কন্যা কামনা আজমীর এবং জয়পুরে পড়াশোনার পর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বিভার কলেজ (বর্তমানে আর্কেডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। কামনা ইংরেজি, হিন্দি এবং ইতালীয় ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। কামনার বিবাহ হয়েছিল কার্তিকেয় বাজপেয়ীর সঙ্গে।
প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত জগদীপের প্রাথমিক শিক্ষা হয়েছিল কিথানা গ্রামের সরকারি বিদ্যালয়ে। তারপর ষষ্ঠ শ্রেণিতে তিনি ভর্তি হন ঘারধানায় সরকারি মিডল স্কুলে। রোজ প্রায় চার-পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে গ্রামের অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে সেই স্কুলে পড়তে যেতেন জগদীপ। ১৯৬২ সালে চিত্তোরগড়ের সৈনিক স্কুলে প্রবেশিকা পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হওয়ার পর সম্পূর্ণ মেধাবৃত্তিসহ সেই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন জগদীপ। তাঁর বড় ভাই কুলদীপ ধনকরও সুযোগ পেয়ে এই স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা আয়োজিত ভারতীয় স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা দেওয়ার পর তিনি সৈনিক স্কুল থেকে পাশ করেন। এরপর তিনি উচ্চশিক্ষার দিকে অগ্রসর হন এবং রাজস্থানের বিখ্যাত মহারাজা কলেজে পদার্থবিদ্যায় অনার্স সহ ভর্তি হন। তিন বছর পর সফলভাবে সেখান থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। কলেজ পেরোনোর পরে তিনি আর স্নাতকোত্তর পড়াশোনার দিকে যাননি, বরং আইন বিষয়ে তাঁর তীব্র অনুসন্ধিৎসু মন তাঁকে এলএলবি পড়ার দিকে ঠেলে দেয়। তিনি রাজস্থান বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলবি কোর্সে ভতি হন এবং ১৯৭৮-৭৯ সালে সম্মানের সঙ্গে পাশ করেন।
জগদীপ ধনকর একজন আইনজীবী হিসেবেই নিজের কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। ১৯৭৯ সালের ১০ নভেম্বর তিনি রাজস্থানের বার কাউন্সিলে আইনজীবী হিসেবে নিযুক্ত হন৷ ১৯৯০ সালের ২৭ মার্চ থেকে রাজস্থানের বিচার বিভাগ দ্বারা প্রবীণ আইনজীবী হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন জগদীপ এবং ২০১৯ সালে রাজ্যপাল হিসেবে শপথ নেওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি রাজ্যের সবচেয়ে প্রবীণ আইনজীবী ছিলেন। ১৯৯০ সাল থেকেই জগদীপ ভারতবর্ষের সর্বোচ্চ বিচারালয় সুপ্রিম কোর্টে আইন অনুশীলন শুরু করেন। সেখানে তাঁর চর্চার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল মূলত অন্যান্যদের মধ্যে ইস্পাত, কয়লাখনি এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক সালিশি স্থাপন। ভারতবর্ষের বিভিন্ন হাইকোর্টেও তিনি উপস্থিত থেকেছেন বিশেষ বিশেষ সময়ে। ১৯৮৭ সালে জয়পুরের রাজস্থান হাইকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সর্বকনিষ্ঠ সভাপতি নির্বাচিত হন জগদীপ ধনকর। ১৯৮৮ সালে রাজস্থান বার কাউন্সিলের নির্বাচিত সদস্যও ছিলেন তিনি। ১৯৮৯ সালেই রাজনীতির বৃহৎ ক্ষেত্রে জগদীপ ধনকর পদার্পণ করেন। সেবছর ঝুনঝুনু সংসদীয় নির্বাচনী এলাকা থেকে জনতা দলের প্রতিনিধিত্ব করে নবম লোকসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি এবং এই পদে ১৯৮৯-৯১ পর্যন্ত তাঁর স্থায়িত্বকাল ছিল। ১৯৯০ সালে তিনি একটি সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯০ সালেই ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর পদ অলঙ্কৃত করেন জগদীপ ধনকর। আজমীরের কিষাণগড় নির্বাচনী এলাকা থেকে দশম বিধানসভা নির্বাচনে তিনি রাজস্থান বিধানসভার সদস্য (MLA) নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত এই পদে বহাল ছিলেন। লোকসভা এবং রাজস্থান বিধানসভা দুই জায়গাতেই তিনি গুরুত্বপূর্ণ কিছু কমিটির সদস্য ছিলেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থাকাকালীন ইউরোপীয় পার্লামেন্টে একটি সংসদীয় প্রতিনিধি দলের ডেপুটি লিডার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি দক্ষতার সঙ্গে। ভারতের রাষ্ট্রপতি শ্রী রামনাথ কোবিন্দ ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫৫-এর অধীনে ২০১৯ সালের ২০ জুলাই জগদীপ ধনকরকে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হিসেবে নিযুক্ত করে ওয়ারেন্ট জারি করেন। তারপর ৩০ জুলাই কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি শ্রী থোট্টাথিল বি. নায়ার রাধাকৃষ্ণাণ কলকাতার রাজভবনে জগদীপ ধনকরকে রাজ্যপাল হিসেবে শপথ বাক্য পাঠ করান। পশ্চিমবঙ্গে ভোট পরবর্তী হিংসা নিয়ে যখন মন্তব্য করেন জগদীপ ধনকর, তখন রাজ্য সরকার অস্বস্তিতে পরে এবং জগদীপকে উদ্দেশ্য করে কটূ মন্তব্যও করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিনবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেছিলেন জগদীপ ধনকরকে রাজ্যপাল পদ থেকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হিসেবেই দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
এছাড়াও জগদীপ ধনকর বিভিন্ন সমিতি এবং কমিটির সঙ্গে আজীবন সদস্য হিসেবে জড়িয়ে আছেন ওতপ্রোতভাবে। নিউ দিল্লির ইন্ডিয়ান ল ইন্সটিটিউটের আজীবন সদস্য জগদীপ। এছাড়াও তিনি নিউ দিল্লির ইন্ডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার, ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ আর্বিট্রেশন, আইসিসি কমিশন অফ আর্বিট্রেশন, আইসিসি কোর্ট অফ আর্বিট্রেশনের সদস্য পদ অলঙ্কৃত করেছেন। কৃষি এবং চারুকলার সমবায় আন্দোলনে তাঁর অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও জনসেবামূলক কাজেও জগদীপ ধনকর অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। রাজস্থান রাজ্যের জাঠ সম্প্রদায়সহ অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণিকে ওবিসি তালিকাভুক্ত করবার কাজে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন তিনি। জগদীপ একইসঙ্গে ছিলেন একজন ক্রীড়া অনুরাগী। তিনি রাজস্থান অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন এবং রাজস্থান টেনিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এছাড়া লেখালেখির জগতেও জগদীপ ছিলেন সিদ্ধহস্ত। বিভিন্ন সময়ে নানা সাময়িকী এবং পত্র-পত্রিকার পাতায় তাঁর লেখা আইন বিষয়ক বহু প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। জগদীপ এবং তাঁর স্ত্রী সুদেশ দুজনেই ছিলেন ভ্রমণ পিপাসু মানুষ। তাঁরা দুজনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ইতালি, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, চিন, হংকং, সিঙ্গাপুর, মালদ্বীপ ইত্যাদি বিদেশের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেছেন।
সম্প্রতি ১৬ জুলাই ২০২২ সালে জগদীপ ধনকর জাতীয় গণতান্ত্রিক মোর্চার পক্ষে উপরাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে মনোনীত হন। এরপর ৬ আগস্ট ২০২২ সালে ১৯৯২ সালের পর সর্বাধিক ভোটে জয়ী হয়ে ভারতের চতুর্দশতম উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন তিনি।
One comment