ব্রিটিশ সরকারের থেকে ‘অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার’ সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন ভারতীয় রাজনীতিবিদ ধর্মবীর (Dharma Vira)। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সবথেকে সম্মানীয় পুরস্কার ছিল এটি। বহু রাজনীতিবিদ ভারতবর্ষের রাজনীতির ইতিহাস আলোকিত করে রয়েছেন যাঁরা সারাজীবন অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্ব সামলেছেন দক্ষ হাতে, ধর্মবীর তেমনই একজন রাজনীতিবিদ। ব্রিটিশ ভারতে তাঁর জীবনের অর্ধেক সময় তিনি অতিবাহিত করেছেন। ভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন ধর্মবীর। স্বাধীন ভারতবর্ষে জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে নিজের রাজনৈতিক জীবনকে এগিয়ে নিয়ে চলেন তিনি এবং ভারত সরকারের মন্ত্রী পরিষদের সচিবের দায়িত্বও পেয়েছিলেন তিনি। চারটি রাজ্যের রাজ্যপাল হিসেবে বহুদিন কাজ করেছেন তিনি। হরিয়ানার প্রথম রাজ্যপাল হিসেবে ধর্মবীর আজও স্মরণীয়। খেলাধুলা এবং পর্বতারোহনে তাঁর আগ্রহ ছিল প্রবল। এছাড়াও বহু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ তিনি রচনা করে গেছেন, তৎকালীন সময়ের প্রতিচ্ছবি হিসেবে যেগুলির মূল্য অপরিসীম। আজীবন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁর কৃতিত্বের জন্য ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মবিভূষণ’ সম্মানে ভূষিত করেছে।
১৯০৬ সালের ২০ জানুয়ারি উত্তরপ্রদেশের বিজনুর শহরে রাজনীতিবিদ ধর্মবীরের জন্ম হয়। তাঁর বাবা রাজা জ্বালাপ্রসাদ (Raja Jwala Prasad) ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে ‘রাজা’ উপাধি পেয়েছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ভাগ্যবতী দেবী। পরবর্তীকালে ধর্মবীরের বাবা জ্বালাপ্রসাদ বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের পরিকল্পনা এবং নির্মাণও জ্বালাপ্রসাদের তত্ত্বাবধানে হয়েছিল। মদনমোহন মালব্যকে এই বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের জন্য অর্থ সংগ্রহে প্রভূত সাহায্য করেছিলেন তিনি। ধর্মবীর ছাড়াও জ্বালাপ্রসাদ এবং ভাগ্যবতী দেবীর আরও দুই পুত্রের নাম সত্যবীর ও কান্তিবীর। এছাড়াও সুমিত্রা, যশোদা এবং সুশীলা নামে আরও তিন কন্যা ছিল তাঁদের। ধর্মবীরের বোন সুমিত্রা তাঁর চেয়ে আট বছরের ছোট ছিলেন। সুমিত্রা ভারতীয় শিল্পকলার একজন অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পরিচিত। ধর্মবীর বিদেশ থেকে ফিরে এসে ১৯৩২ সালে দয়াবতী গঙ্গা রাম নামের এক মহিলাকে বিবাহ করেন যিনি পরে ‘দয়াবতী বীর’ নামে পরিচিত হন। ধর্মবীর এবং তাঁর স্ত্রী শ্রীমতী দয়াবতী বীরের নামে ১৯৯১ সালে ‘দয়াবতী ধর্মবীর পাবলিক স্কুল’ নামে একটি খ্যাতনামা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল বিজনুরে। ‘বীর চ্যারিটেবেল সোসাইটি’র অধীনে বিদ্যালয়টি বর্তমানে অত্যন্ত খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। দয়াবতী এবং ধর্মবীরের পুত্র শ্রী ইন্দুবীর (Induvira) পরবর্তীকালে সেই বিদ্যালয়ের সভাপতি হয়েছিলেন এবং ২০০৩ সাল থেকে ইন্দু বীরের নেতৃত্বে এক গৌরবময় উচ্চতায় উন্নীত হয়েছে এই বিদ্যালয়টি।
এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত মুইর সেন্ট্রাল কলেজ এবং লক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে ধর্মবীর ১৯২৯ এবং ১৯৩০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে লণ্ডনে চলে যান ‘স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ’ (বর্তমানে স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যাণ্ড আফ্রিকান স্টাডিজ) থেকে ‘ইণ্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস’ পড়বার উদ্দেশ্য নিয়ে। ১৯৩০ সালের অক্টোবর মাসে তিনি আইসিএস পরীক্ষায় সম্মানের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। নভেম্বর মাসে ধর্মবীর দেশে ফিরে আসেন।
ধর্মবীর প্রথমে উত্তরপ্রদেশের রেসিডেন্ট ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন দীর্ঘদিন। পরে মূলত ১৯৪১ সাল থেকে তিনি ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় সরকারের নানা বিষয়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়তে থাকেন। ধর্মবীর নিজের জীবনকালেই ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুই মহাযুদ্ধকালীন সময়ের সাক্ষী থেকেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ‘ডেপুটি চিফ কন্ট্রোলার অফ ইমপোর্ট’ হিসেবে কাজ করেছিলেন। ১৯৪৫ সালে ধর্মবীর ভারতবর্ষের টেক্সটাইল কমিশনার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৪৬ নিউ ইয়ার অনার্সে তাঁকে ‘ওবিই’ (Order of the British Empire, OBE) হিসেবে নির্বাচিত করে সম্মান প্রদর্শন করেন ব্রিটিশ সরকার। সাধারণত যাঁরা কলা এবং বিজ্ঞান বিভাগে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন, দাতব্য এবং কল্যাণকর্মমূলক সংগঠনের হয়ে কাজ করেন এবং সিভিল সার্ভিস ছাড়াও বিভিন্ন জনসেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন তাঁদেরই ব্রিটিশ সরকারের তরফ থেকে এই সম্মান প্রদান করা হয়।
স্বাধীনতা লাভের পর ধর্মবীর জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে কাজ করতে থাকেন এবং ১৯৪৭ সালে ভারতীয় মন্ত্রীসভার যুগ্মসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তারপর ১৯৫০-৫১ সালে জওহরলাল নেহরুর প্রধান প্রাইভেট সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করেন ধর্মবীর। ১৯৫১ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তিনি লণ্ডনের ভারতীয় হাই কমিশনারের বাণিজ্যিক উপদেষ্টা পদে বহাল ছিলেন। ১৯৫৪ সালে ধর্মবীর চেকোশ্লোভাকিয়ায় রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত হন এবং ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত এই পদের দায়িত্ব সামলান। এরপর তিনি ফিরে আসেন ভারতবর্ষে এবং এখানে এসে ধর্মবীর পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান ও ১৯৬২ সাল পর্যন্ত সেই দপ্তরে কাজ করেন। ১৯৬২ সালেই ধর্মবীর পূর্ত, আবাসন এবং সরবরাহ মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন।
১৯৬৩ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত ধর্মবীর ছিলেন দিল্লির চিফ কমিশনার। তারপর ১৯৬৪ সালের ১৮ নভেম্বর থেকে ১৯৬৬ সালের ২৭ জুন পর্যন্ত তাঁকে মন্ত্রী পরিষদের সচিব এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পরিষদ বা ইউনিয়ন কাউন্সিল অফ মিনিস্টার্সের সচিব হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল। এছাড়াও ধর্মবীর এই সময়কালে অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের চেয়ারম্যানের পদও অলঙ্কৃত করেছিলেন।
১৯৬৬ সালের ২৭ জুন তিনি পাঞ্জাব রাজ্যের সপ্তম রাজ্যপাল হিসেবে নিযুক্ত হন এবং পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৯৬৭ সালের ১ জুন পর্যন্ত তিনি এই সাংবিধানিক পদের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৬ সালেই পুরোনো অখণ্ড পাঞ্জাবের বিভাজনের ফলে সেবছরই ১ নভেম্বর সাংবিধানিকভাবে হরিয়ানা রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয় এবং ১৯৬৬ সালের ১ নভেম্বর থেকেই ধর্মবীর হরিয়ানার রাজ্যপাল পদে নিযুক্ত হন। পাঞ্জাবের রাজ্যপাল হিসেবে কর্মরত অবস্থাতেই হরিয়ানার এই সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। ধর্মবীরই ছিলেন হরিয়ানার প্রথম রাজ্যপাল এবং ১৯৬৭ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি সেই পদে বহাল ছিলেন। ১৯৬৭ সালের ১ জুন থেকে ১৯৬৯ সালের ১ এপ্রিল পর্যন্ত নকশালপন্থী আন্দোলনের এক উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ধর্মবীর পশ্চিমবঙ্গের ষষ্ঠ রাজ্যপালের পদে আসীন ছিলেন। বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নানের স্মৃতিচারণা থেকে জানতে পারা যায় যে ১৯৬৭ সালে গঠিত প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দিয়েছিলেন ধর্মবীর, কিন্তু তাঁর জমানাতেই ১৯৬৯ সালে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়েছিল। ১৯৭০ সালের ২৩ অক্টোবর মহীশূরের বা বর্তমান কর্ণাটক রাজ্যের পঞ্চম রাজ্যপাল হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি। ১৯৭৩ সালের আগে কর্ণাটক ‘মহীশূর’ নামেই পরিচিত ছিল। পরবর্তী প্রায় দুই বছর অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কর্ণাটকের রাজ্যপালের পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন ধর্মবীর।
পরবর্তীকালে ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত তিনি ন্যাশনাল পুলিশ কমিশনের চেয়ারম্যান পদে বহাল ছিলেন। ১৯৭৩ সালের নভেম্বর মাস থেকে ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় তিন বছর ধর্মবীর ‘ভারত স্কাউটস অ্যাণ্ড গাইডস’ বা বিএসজি-র সভাপতির পদ সামলেছিলেন দক্ষতার সঙ্গে।
কেবলমাত্র একজন দক্ষ রাজনীতিবিদই নন, ধর্মবীর একজন সুলেখকও বটে। তাঁর লেখা একটি উল্লেখযোগ্য স্মৃতিচারণধর্মী বই ‘মোমোয়ার্স অফ আ সিভিল সার্ভেন্ট’ ১৯৭৫ সালে বিকাশ পাবলিশিং হাউজ থেকে প্রকাশিত হয়। ব্রিটিশ ভারতের সময় চিত্র এই বইটিতে জীবন্ত হয়ে উঠেছে তাঁর কলমে। তাছাড়া সিভিল সার্ভেন্টদের ক্রিয়াকলাপের অনুপুঙ্খ বিবরণে সমৃদ্ধ এই বইটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। ১৯৯০ সালে প্রকাশিত হয় ধর্মবীরের আরেকটি গ্রন্থ যার নাম ‘রেমিনিসেন্স’ অর্থাৎ স্মৃতিচারণ। ব্রিটিশ ভারত এবং স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতবর্ষের রাজনীতি এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সূত্রে রাজনীতির অন্দরমহলের নানা কথা উল্লিখিত এই দুটি বইতে ধরা আছে বিস্তারিতভাবে৷
তবে এসবের বাইরেও ধর্মবীরের অন্য আরেক পরিচয় রয়েছে যা নিয়ে সাধারণত খুব বেশি কথা হয় না। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ ক্রীড়াবিদ এবং একজন সুদক্ষ পর্বতারোহী। হিমালয়ের দুর্গম ট্রেইল পাস অতিক্রমকারী প্রথম ভারতীয় হিসেবে ধর্মবীরের নাম স্বর্ণাক্ষরে খোদিত থাকবে।
আজীবন রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ভারত সরকার ধর্মবীরকে সম্মান জানাতেও কার্পণ্য করেনি। ১৯৯৯ সালে ভারতবর্ষের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘পদ্মবিভূষণ’ সম্মানে ভূষিত করা হয় ধর্মবীরকে।
২০০০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ৯৪ বছর বয়সে নতুন দিল্লিতে ধর্মবীরের মৃত্যু হয়।