ভারতবর্ষের রাজনীতির ইতিহাস যে সমস্ত মানবহিতৈষী ব্যক্তিত্বদের অবদানে সমৃদ্ধ হয়ে রয়েছে, তাঁদের মধ্যে নিঃসন্দেহে অন্যতম হলেন কে. ভি. রঘুনাথ রেড্ডি (K. V. Raghunatha Reddy)। মানুষের জন্য বিশেষত নিম্নবিত্ত, দরিদ্র মানুষের কল্যাণ সাধনের জন্য পেশায় একজন আইনজীবী হয়েও তিনি রাজনীতিকে ব্যবহার করেছিলেন পথ আরও সুগম করে তুলবার জন্য। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রশাসনিক স্তরের গুরুত্বপূর্ণ পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন তিনি। তিনবার রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন রঘুনাথ। শ্রমিক শ্রেণির প্রতি তাঁর ছিল উদার মনোভাব এবং তাঁদের দাবি-দাওয়াকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করে তিনি সমাধানের চেষ্টাও করতেন। কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রীর পদ তাঁকে সেই কাজে সাহায্য করেছিল। ভারতের শিল্প উন্নয়ন এবং কোম্পানি বিষয়ক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন কে. ভি. রঘুনাথ রেড্ডি। তিনটি রাজ্যের রাজ্যপাল হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। এছাড়াও লেখালেখিতেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন রঘুনাথ রেড্ডি। তাঁর বই ছাত্রপাঠ্য হিসেবেও অধ্যাপকদের স্বীকৃতি পেয়েছিল। আন্তর্জাতিক সম্মেলনে কে. ভি. রঘুনাথ রেড্ডি ভারতবর্ষের প্রতিনিধি হিসেবে হাজির হয়েছিলেন।
১৯২৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের নেল্লোর জেলার অন্তর্গত বীরপুরে কে. ভি. রঘুনাথ রেড্ডির জন্ম হয়। কে. ভি. রঘুনাথের কৃতি পুত্র কে. শ্রীনাথ রেড্ডি পেশায় ছিলেন বিখ্যাত একজন ডাক্তার। ‘পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন অফ ইন্ডিয়া’র প্রেসিডেন্ট ছিলেন শ্রীনাথ। তাছাড়া ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন বা ডব্লিউএইচও (WHO) সংস্থার বিশেষজ্ঞদের প্যানেলের একজন ছিলেন তিনি। ওয়ার্ল্ড হার্ট ফেডারেশনেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন শ্রীনাথ।
প্রাথমিক এবং উচ্চবিদ্যালয় স্তরের শিক্ষা সমাপ্ত করবার পর প্রথমে আন্নামালাই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন তিনি এবং পরবর্তীকালে লক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। প্রখর বুদ্ধি এবং আইনের প্রতি আগ্রহ এবং উৎসাহের কারণে আইনচর্চাকেই নিজের পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন কে. ভি. রঘুনাথ রেড্ডি। একজন দক্ষ আইনজীবী হওয়ার পাশাপাশি তিনি তিনি অ্যাফ্রো-এশিয়ান সোসাইটি এবং শান্তি সম্মেলন বা পীস্ কনফারেন্সের (Peace Conference) সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন।
পঞ্চম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ইন্দিরা গান্ধীর সরকার দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থানের সুযোগ প্রবর্তন এবং কৃষি উৎপাদনে উন্নতির উপর জোর দিয়েছিল। সেসময় ১৯৭১ সালের নির্বাচনী প্রচারে ইন্দিরা গান্ধীর জনপ্রিয় স্লোগান হয়ে উঠেছিল ‘গরীবি হটাও দেশ বাঁচাও’। কে. ভি. রঘুনাথের রচনা করা ২০-দফা কর্মসূচী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর এই ‘গরীবি হটাও দেশ বাঁচাও’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।
আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও পরবর্তীকালে জনসাধারণের জন্য কল্যাণমূলক কাজ করবার উদ্দেশ্যে সক্রিয় রাজনীতির জগতে অবতীর্ণ হন তিনি। ১৯৬২ সালে কে. ভি. রঘুনাথ রেড্ডি প্রথম স্বতন্ত্র একজন প্রার্থী হিসেবে রাজ্যসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর আরও দুবার অর্থাৎ মোট তিনবার রেড্ডি অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে রাজ্যসভার সদস্য পদ পেয়েছিলেন। প্রথম দফায় ১৯৬২ সালের এপ্রিল মাস থেকে ১৯৬৮ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত তিনি বহাল ছিলেন রাজ্যসভায়। দ্বিতীয় দফায় ১৯৬৮ সালের এপ্রিল থেকে ১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাস এবং তৃতীয় দফায় ১৯৭৪ সালের এপ্রিল থেকে ১৯৮০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তিনি রাজ্যসভার সদস্য পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন। এরপর কে. ভি. রঘুনাথ রেড্ডি ইন্দিরা সরকারের অধীনে ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তিন বছর তিনি রাজ্যের শিল্প-উন্নয়ন এবং কোম্পানি বিষয়ক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সালের জুন মাস থেকে ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রঘুনাথ রেড্ডি কোম্পানি অ্যাফেয়ার্স দপ্তরের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব সামলেছিলেন। তারপর ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই তিনি কেন্দ্রীয় শ্রম ও পুনর্বাসন মন্ত্রী রূপে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ঐ বছরই নভেম্বর মাস পর্যন্ত এই মন্ত্রীত্বের পদে বহাল ছিলেন রেড্ডি। ১৯৭৩ সালের নভেম্বর থেকেই তিনি শ্রমমন্ত্রীর দায়িত্ব পান এবং ১৯৭৭ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত এই পদ অলঙ্কৃত করেন তিনি।
ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ এবং ওড়িশা এই তিনটি রাজ্যের রাজ্যপাল হিসেবে দায়িত্ব সামলেছিলেন কে. ভি. রঘুনাথ রেড্ডি। ১৯৯০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ত্রিপুরার গভর্নর পদের দায়িত্ব পেয়েছিলেন রঘুনাথ। পরবর্তী তিন বছর অর্থাৎ ১৯৯৩ সালের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত এই পদে বহাল ছিলেন তিনি। এরপর পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যপালের শূন্যপদ পূরণ করতে তাঁকে রাজ্যপাল হিসেবে দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছিল ১৯৯৩ সালেরই ১৪ আগস্ট তারিখে। পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চদশ রাজ্যপাল হিসেবে তিনি ১৯৯৮ সালের ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত দক্ষ হাতে সামলেছিলেন তাঁর দায়িত্ব। এরপর ১৯৯৭-৯৮ সালের কিছু সময়ে দুবার রাজ্যপাল পদে বসেছেন কে. ভি. রঘুনাথ রেড্ডি। প্রথমবার ১৯৯৭ সালের ৩১ জানুয়ারি থেকে ১৯৯৭ সালেরই ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এবং পরবর্তীকালে সেবছরেই ১৩ ডিসেম্বর থেকে পুনরায় ওড়িশার রাজ্যপাল হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। ১৯৯৮ সালের ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত এই পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন রঘুনাথ রেড্ডি।
কেবলমাত্র দেশের মধ্যেই তাঁর চলাচল সীমাবদ্ধ ছিল না। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও কে. ভি. রঘুনাথ রেড্ডি নিজের দক্ষতা এবং যোগ্যতার প্রদর্শন করেছিলেন। আন্তর্জাতিক শ্রম সম্মেলনের আটান্ন, ঊনষাট এবং ষাটতম অধিবেশনে ভারতীয় প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রেড্ডি। ১৯৬৬ সালের জুন মাসে লন্ডনে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি কনফারেন্সে রাজ্যসভার প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন রঘুনাথ।
রাজনীতি এবং জনসেবামূলক কাজের ফাঁকে ফাঁকে লেখালেখিও চালাতেন কে. ভি রেড্ডি। তাঁর বই যে কতখানি জরুরি তা বোঝা যায় যখন তা ছাত্র-ছাত্রীদের পড়বার জন্য পরামর্শ দেন শিক্ষকেরা। তাঁর ফৌজদারি আইন বিষয়ে লেখা গ্রন্থ আইনের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে জনপ্রিয় সহায়ক বই হয়ে উঠেছে। কে. ভি. রঘুনাথ রেড্ডি আরেকটি যে বই রচনা করেছিলেন সেটিও তাঁর উচ্চমানের প্রগতিশীল চিন্তাভাবনায় সমৃদ্ধ এবং তাতে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির অনবদ্য পরিপাটি প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। তাঁর সেই গ্রন্থটির নাম হল ‘ডেমোক্রেটিক স্যোশালিজম’। রঘুনাথ নিজে খুবই সরল জীবনযাপন করতেন এবং গভীর বিশ্বাস রাখতেন সমাজতন্ত্রে। সমাজের দুর্বল শ্রেণির কল্যাণের জন্য গভীরভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং জনজীবনের মানোন্নয়নের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া এক মহৎ ব্যক্তি ছিলেন কে. ভি রঘুনাথ রেড্ডি।
২০০২ সালের ৪ মার্চ দিল্লিতে ৭৭ বছর বয়সে কে. ভি. রঘুনাথ রেড্ডির মৃত্যু হয়।