কবাডি

কবাডি

ভারতীয় উপমহাদেশ সহ এশিয়ার অন্যত্র খুবই জনপ্রিয় একটি দলগত খেলা হল কবাডি (Kabaddi)। এটি সর্বাংশে একটি আউটডোর গেমস। বাংলাদেশের জাতীয় খেলা কবাডি। ভারতের তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, বিহার, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, তেলেঙ্গানা, উত্তরপ্রদেশ ইত্যাদি রাজ্যগুলিতে এই খেলাটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। অন্ধ্রপ্রদেশ এবং তেলেঙ্গানায় চেডুগুডু, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে মূলত হা-ডু-ডু, পাঞ্জাবে কাউড্ডি, মালদ্বীপে ভবতিক, তামিলনাড়ুতে সাডুগুডু এবং পশ্চিম ভারতে হা-টু-টু ইত্যাদি বিভিন্ন নামে পরিচিত কবাডি খেলাটি।

অনেকেই মনে করেন প্রাচীন ভারতের বৈদিক যুগেই এই খেলার উদ্ভব হয়েছিল। যাদব সম্প্রদায়ের মধ্যে এই খেলাটি নাকি খুবই জনপ্রিয় ছিল। তুকারামের এক অভঙ্গে পাওয়া যায় শ্রীকৃষ্ণ তাঁর যৌবনকালে সখাদের সঙ্গে এই খেলাটি খেলতে পছন্দ করতেন। অন্যদিকে মহাভারতেও এই খেলার উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে এই তথ্যের কোনো পাথুরে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। মনে করা হয় ১৯২১ সাল নাগাদ ভারতের মহারাষ্ট্রে প্রথম একটি প্রতিযোগিতার প্রস্তুতির জন্য কবাডির রূপরেখা নির্মিত হয়। তারপর ১৯৩০ সাল থেকে ক্রমে সমগ্র ভারত থেকে শুরু করে দক্ষিণ এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। তবে তার আগে ১৯২৩ সালে অল ইন্ডিয়া কবাডি টুর্নামেন্ট আয়োজিত হয়েছিল ভারতে যেখানে কবাডির একটি সাংবিধানিক কাঠামো অনুসরণ করা হয়েছিল। ১৯৫০ সালে এই খেলার প্রচারের জন্য ভারতে গড়ে ওঠে অল ইন্ডিয়া কবাডি ফেডারেশন। ১৯৫২ সাল থেকে ভারতে শুরু হয় সিনিয়র কবাডি ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ। ভারত সহ এশিয়ার অন্যান্য দেশে এই খেলাকে জনপ্রিয় করে তুলতে ভারতীয় অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের তত্ত্বাবধানে ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় অ্যামেচার কবাডি ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া। এরপর থেকে পুরুষ ও মহিলাদের জন্য পৃথকভাবে জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতা আয়োজিত হতে শুরু করে ভারতে। ১৯৮০ সালে ভারতে প্রথম এশিয়ান কবাডি চ্যাম্পিয়নশিপ অনুষ্ঠিত হয় এবং ১৯৮২ সালে দিল্লিতে আয়োজিত নবম এশিয়ান গেমসে ভারতের পক্ষ থেকে কবাডি প্রদর্শনও করা হয়। ১৯৮৪ সাল থেকে বাংলাদেশের ঢাকায় আয়োজিত দক্ষিণ এশীয় ফেডারেশন গেমসেও কবাডিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৯০ সালে বেজিং-এর একাদশতম এশিয়ান গেমসে কবাডিতে প্রথম স্বর্ণপদক জয় করে ভারত। এরপর একে একে হিরোশিমা (১৯৯৪), ব্যাঙ্কক (১৯৯৮), বুসান (২০০২) প্রভৃতি শহরে আয়োজিত এশিয়ান গেমসগুলিতে ভারত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান অর্জন করে এবং পরপর পাঁচটি স্বর্ণপদক জিতে নজিরবিহীন ইতিহাস গড়ে তোলে। ২০০৪ সালে মুম্বাইতে প্রথম কবাডি বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় যেখানে ফাইনাল ম্যাচে ইরানকে হারিয়ে ভারত বিশ্বকাপ জেতে। তারপরে ২০০৭ সালে ভারতের পানভেলে আয়োজিত দ্বিতীয় কবাডি বিশ্বকাপে ভারত পুনরায় চ্যাম্পিয়ন হয়। অন্যদিকে ২০০৫ সালে হায়দ্রাবাদে প্রথম এশিয়ান মহিলা কবাডি চ্যাম্পিয়নশিপ অনুষ্ঠিত হয় আর আশ্চর্যজনকভাবে এই প্রতিযোগিতাতেও ভারত স্বর্ণপদক জিতে নেয়। ২০০৬ সালে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত সাউথ এশিয়ান গেমসে প্রথমবারের মত কবাডি প্রতিযোগিতাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০০৬ সালে কাতারের দোহায় আয়োজিত পঞ্চদশ এশিয়ান গেমসে কবাডি প্রতিযোগিতার জন্য আলাদা একটি ইনডোর স্টেডিয়াম গড়ে তোলা হয়েছিল। বিশালাকায় পাবলিক স্ক্রিন, বিশাল প্লাজমা স্কোরবোর্ড এবং আরো অনেক অত্যাধুনিক যন্ত্র ও সরঞ্জামের সমাহারে কবাডি খেলা এক অত্যাধুনিক রূপ পায়।

সাধারণত দুটি রীতিতে কবাডি খেলা হয়ে থাকে। একটি হল প্রামাণ্য রীতি (Standard Style) এবং অন্যটি বৃত্তাকার রীতি (Circle Style)। এক এক করে আলোচনা করা যাক। প্রামাণ্য রীতিতে খেলার সময় পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রতি কোর্টের মাপ হয় ১০  ১৩ মিটার এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে এর মাপ হয় ৮  ১২ মিটার। এক্ষেত্রে সাত জন খেলোয়াড়ের দুটি দল খেলতে নামে এবং প্রত্যেক দলেরই অতিরিক্ত পাঁচ জন করে খেলোয়াড় থাকে। ২০ মিনিটের প্রতি অর্ধে ভাগ করে এই খেলা হয়ে থাকে যেখানে মাঝে মাত্র ৫ মিনিটের একটি বিরতি থাকে। এই সময় প্রত্যেক দল তাদের দিক বদল করে। এই প্রতি অর্ধের খেলাকে ‘আক্রমণ’ (Raid) বলা হয় আর প্রতিবারই এক দলের খেলোয়াড় আক্রমণকারী (Raider) হিসেবে প্রতিপক্ষের কোর্টের দিকে ছুটে যায়। আক্রমণকারী যদি প্রতিপক্ষের সাত জন খেলোয়াড়ের মধ্যে সবথেকে বেশি সংখ্যক খেলোয়াড়কে স্পর্শ করে বাল্ক লাইন (Baulk Line) পেরিয়ে নিজের কোর্টে ফিরে আসতে পারে, তবে সে বেশি পয়েন্ট পাবে। এই আক্রমণের সময় এক নিঃশ্বাসে ‘কবাডি কবাডি’ বলে যেতে হবে আক্রমণকারীকে এবং একেকটি আক্রমণের সময়সীমা ধরা হয় ৩০ সেকেন্ড। যে কয়জন প্রতিপক্ষকে স্পর্শ করতে পারবে আক্রমণকারী তত পয়েন্ট স্কোর করবে সে। আবার যদি আক্রমণকারী প্রতিপক্ষের কোর্টের বোনাস লাইনের (Bonus Line) পেরিয়ে চলে যায় এবং অক্ষত থাকে তাহলে আক্রমণকারীর দল একটি বোনাস পয়েন্ট পায়। যে যে খেলোয়াড়কে আক্রমণকারী স্পর্শ করেছে তারা আউট ঘোষিত হয়ে মাঠের বাইরে সিটিং ব্লকে বসে পড়ে। এখন আক্রমণকারীকে যদি প্রতিপক্ষ দল আটকে দেয়, তাহলে প্রতিপক্ষ দল পয়েন্ট পাবে। এই সময় প্রতিপক্ষ দল আক্রমণকারীকে আউট করার চেষ্টা করে যাকে ‘স্ট্রাগল’ (Struggle) বলা হয়। এই স্ট্রাগলের সময় যদি প্রতিপক্ষের কোনো খেলোয়াড় মাঠের বাইরে ভূমি স্পর্শ করেন কিংবা যদি আক্রমণকারী মাঠের বাইরে ভূমি স্পর্শ করেন, তাহলে তিনি আউট হবেন। আক্রমণকারীকে কোনো প্রতিপক্ষ ধরে যদি তার শরীরের কিছু অংশ মাঠের বাইরে চলে যায়, তাহলে আক্রমণকারীর বদলে প্রতিপক্ষের ঐ খেলোয়াড় আউট হবেন। প্রতিপক্ষের খেলয়াড়কে স্পর্শ করাকে কবাডির ভাষায় বলা হয় ‘ট্যাগ’ (Tag)। ট্যাগ করা প্রতিপক্ষের যে খেলোয়াড়েরা মাঠের বাইরে চলে গিয়েছিল, প্রতিপক্ষ দল নির্দিষ্ট পয়েন্টের বিনিময়ে তাদের আবার ফিরিয়ে আনতে পারে। আক্রমণের সময় যদি কোনো পয়েন্ট স্কোর না করেন আক্রমণকারী তাহলে তাকে ‘শূন্য আক্রমণ’ (Empty Raid) বলা হয় আর যদি আক্রমণকারী তিন বা তার বেশি পয়েন্ট স্কোর করেন, তখন তাকে ‘শ্রেষ্ঠ আক্রমণ’ (Super Raid) বলা হয়। যদি কোনও দল প্রতিপক্ষের সাতজন খেলোয়াড়কেই একবারে আউট করে, তাহলে ঐ দল অতিরিক্ত দুই পয়েন্ট পায় আর প্রতিপক্ষের সব খেলোয়াড়কেই আবার মাঠে ফিরিয়ে আনা হয়। এক্ষেত্রে কয়েকটি আনুষঙ্গিক নিয়ম মাথায় রাখতে হবে। মাঠে সীমানা চিহ্নিত দুটি কোর্টকে একত্রে লবি (Lobby) বলা হয়। স্ট্রাগল চলাকালীন আক্রমণকারী আর প্রতিপক্ষের মধ্যে সমগ্র লবিটাকেই সীমানা ধরা হয়, অন্য সময় নয়। দ্বিতীয়ত আক্রমণকারীকে প্রতিপক্ষের কোর্টে গিয়ে সফল রেইড করে নিজের কোর্টে ফিরে আসা পর্যন্ত বারবার ‘কবাডি কবাডি’ বলে যেতে হবে। যদি প্রতিপক্ষের কোর্টে গিয়ে মুহূর্তের জন্যেও তিনি কবাডি বলা বন্ধ করেন, তবে সেই আক্রমণকারী আউট হবেন এবং তার বিনিময়ে প্রতিপক্ষ দল এক পয়েন্ট পাবে। এটাই পেশাদারি কবাডি খেলার নিয়ম। তাছাড়া অপেশাদারি স্তরে কবাডি খেলার রীতিকে বৃত্তাকার রীতি বলা হয়। এই রীতি আবার চার প্রকার – সঞ্জীবনী, গামিনী, অমরশৈলী এবং পাঞ্জাবি কবাডি। সঞ্জীবনী কবাডিতে একজন খেলোয়াড়কে মাঠে ফেরানো হয় প্রতিপক্ষের একজন আউট হওয়া খেলোয়াড়ের বিনিময়ে। তাছাড়া ৫ মিনিটের বিরতি সহ এই খেলাটির সময়সীমা হয় ৪০ মিনিটেরও বেশি। গামিনী রীতিতে প্রত্যেক দলের লক্ষ্যমাত্রা থাকে পাঁচ বা সাত পয়েন্ট, যতক্ষণ না কোনও দল এই পয়েন্ট স্কোর করতে পারছে, ততক্ষণ খেলা চলতে থাকে। অন্যদিকে পাঞ্জাবি কবাডি একেবারেই আলাদা যেখানে ২২ মিটার ব্যাসের একটি বৃত্তাকার পিচের মধ্যে এই কবাডি খেলা হয়ে থাকে।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

ভারতে এই খেলার উৎপত্তি হলেও বর্তমানে আন্তর্জাতিক স্তরে কবাডি খেলার নানা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। কবাডি বিশ্বকাপ, এশিয়ান গেমস, প্রো কবাডি লিগ, সুপার কবাডি লিগ, এশিয়ান কবাডি চ্যাম্পিয়নশিপ ইত্যাদি। এমনকি ইউরোপের মাটিতেও কবাডি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে যে কারণে ইউরোপিয়ান কবাডি চ্যাম্পিয়নশিপ প্রতিযোগিতাও আয়োজিত হয়ে থাকে। ইন্টারন্যাশনাল কবাডি ফেডারেশনের উদ্যোগে আয়োজিত কবাডি বিশ্বকাপে যথাক্রমে ২০০৪, ২০০৭, ২০১৬ ও ২০১৯ সালের প্রতিযোগিতায় ভারতীয় কবাডি দল প্রতিটিতেই জয়লাভ করেছে। পুরুষ ও মহিলা দুটি পৃথক ইভেন্টে ভাগ করে এই কবাডি বিশ্বকাপ আয়োজিত হয়। ১৯৯০ সাল থেকে শুরু করে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এশিয়ান গেমসের প্রতিটি প্রতিযোগিতায় ভারতীয় কবাডি দল স্বর্ণপদক অর্জন করে দেশের গৌরব বৃদ্ধি করেছে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের মত ২০১৪ সাল থেকে শুরু হয় প্রো কবাডি লিগ।

শুধু ভারত নয়, বাংলাদেশেও এই কবাডি অত্যন্ত জনপ্রিয়। কবাডিকে বাংলাদেশে হা-ডু-ডু বলা হয় যা বাংলাদেশের জাতীয় খেলার স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৯৭২ সালে কবাডিকে বাংলাদেশে সরকারি মর্যাদা দেওয়া হয় এবং ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে একটি অপেশাদার কবাডি ফেডারেশন গড়ে ওঠে। ভারতীয় উপমহাদেশের কবাডি চর্চার ক্ষেত্রে ভারতীয় কবাডি দলই অনেকাংশে এগিয়ে।       

আপনার মতামত জানান