কৃশানু দে

কৃশানু দে

ভারতীয় ফুটবলের গৌরবময় ইতিহাস খুঁজে দেখলে এমন বেশ কিছু ফুটবলারের সন্ধান মিলবে যারা আন্তর্জাতিক স্তরেও নিজেদের দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। বাঙালি ফুটবলার কৃশানু দে (Krishanu Dey) তেমনই একজন খেলোয়াড়। তিনি ভারতবর্ষের অন্যতম দুই জনপ্রিয় এবং চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দল ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগান উভয়ের হয়েই খেলেছিলেন। মিডফিল্ডার হিসেবে তাঁর খেলার দক্ষতা এবং বাঁ পায়ের শৈলীর জন্য তিনি ‘ভারতীয় মারাদোনা’ নামে পরিচিত ছিলেন। কেবল স্থানীয় ও দেশীয় কাপই নয়, এশিয়ান কাপ, প্রাক-অলিম্পিক কাপ ইত্যাদি আন্তর্জাতিক স্তরেও ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন তিনি।

১৯৬২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ভারতবর্ষের কলকাতায় কৃশানু দে -র জন্ম হয়। দক্ষিণ কলকাতার নাকতলার বাসিন্দা ছিলেন কৃশানু। ছোটবেলায় ক্রিকেট খেলতেই বেশি পছন্দ করতেন কৃশানু। পাড়ার এক স্থানীয় ক্রিকেট ম্যাচে একবার উইকেট কিপারের অভাব দেখা দিলে সিনিয়র দাদাদের অনুরোধে কৃশানু সেই ম্যাচে উইকেট কিপার হিসেবে খেলেছিলেন। তারপর থেকে উইকেট কিপার হয়েই অনেকগুলি ম্যাচ খেলেন তিনি। তবে অচিরেই ফুটবলে তাঁর প্রতিভা প্রকাশ পেতে থাকে। প্রভাত সঙ্ঘ ক্লাবের স্কাউট সাধন ঘোষই প্রথম কৃশানুর মধ্যে ফুটবল প্রতিভা আবিষ্কার করেছিলেন বলা চলে। এই সাধন ঘোষই কৃশানুকে ক্রিকেট ছেড়ে দিয়ে ফুটবলে মনোনিবেশ করতে বলেছিলেন। দশ বছর বয়স থেকেই কৃশানু ফুটবল খেলতে শুরু করেন। তাঁর বাবা তাঁকে একটি ফুটবল ক্লাবে ভর্তি করিয়ে দেন। কিছু বছর পর আইএফএ হরলিক্স ফুটবল ক্যাম্পের খেলায় অসামান্য দক্ষতা প্রদর্শন করে কৃশানু ফুটবল জগতের কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

১৯৭৯ সালে কোচ অচ্যুত ব্যানার্জীর অধীনে পুলিশ এসি ক্লাবের হয়ে কলকাতা ফুটবল লীগ থেকে কৃশানুর পেশাদার ফুটবল কেরিয়ারের সূচনা হয়েছিল। এই ক্লাবে বেশ কিছুদিন খেলার পর কৃশানু দে চলে যান ক্যালকাটা পোর্ট ট্রাস্টে। কৃশানু আশির দশকের গোড়ার দিকে ১৯৮১ সালে রেলওয়ে দলের একজন অংশ হিসেবে দুই বার সন্তোষ ট্রফির ফাইনালে পৌঁছেছিলেন কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত একবারও তাঁরা সফল হতে পারেননি। কেবল কৃশানু নন, রেলের হয়ে তাঁর সঙ্গে সেসময় খেলেছিলেন বিকাশ পাঞ্জি, কৃষ্ণেন্দু রায়ের মতো খেলোয়াড়রাও। রেলের হয়ে এই সন্তোষ ট্রফিতে কৃশানুর অনবদ্য খেলা দেখে মোহনবাগান ক্লাব ১৯৮২ সালে তাঁকে সই করায়। কৃশানু ফিটনেসের দিক থেকে শুরুতে একটু দুর্বল ছিলেন বলে কর্মকতারা তাঁর খেলা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন৷ শেষ পর্যন্ত অবশ্য অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়ে নিজের প্রতিভার জোরেই সকলকে ভুল প্রমাণ করেন কৃশানু। তাঁর অসাধারণ ড্রিবলিং-এর ক্ষমতা, সঠিক জায়গায় দারুণ সম্ভাবনাময় পাস দেওয়ার সামর্থ্য কৃশানুকে আলাদা এক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল। ক্লাবে প্রথমদিকে মূলত একজন স্ট্রাইকার হিসেবেই খেলতেন কৃশানু যদিও ডিপ মিডফিল্ডার এবং স্ট্রাইকারের মধ্যে লিঙ্কম্যান হিসেবেও খেলেছেন মাঝেমধ্যে। ১৯৮২ সালে স্ট্রাফোর্ড কাপে ডেম্পো স্পোর্টস ক্লাবের বিরূদ্ধে তাঁর পেশাদার ফুটবলার জীবনের প্রথম গোল করেন কৃশানু।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

মোহনবাগানে কৃশানু উইঙ্গার মানস ভট্টাচার্য এবং বাবু মণির সঙ্গে জোট বেঁধে দারুণ আক্রমণাত্মক খেলা খেলতেন। কৃশানু থাকাকালীনই মোহনবাগান ১৯৮২ সালে রোভার্স কাপ, ফেডারেশন কাপ এবং আইএফএ শিল্ড জিতেছিল। পরের মরসুমেও কৃশানুর ফর্ম ছিল অব্যাহত এবং মোহনবাগান প্রথমবার কলকাতা লীগের শিরোপা জিতেছিল৷ মোহনবাগানে থাকাকালীনই কৃশানু ভারতীয় ফুটবল জগতের একজন তারকা হয়ে উঠেছিলেন। মোহনবাগানের সময় থেকেই কৃশানু-বিকাশের জুটি জনপ্রিয় হতে শুরু করে। যে বছর কৃশানু যোগ দেন মোহনবাগানে, সেবছরই সালকিয়া ফ্রেন্ডস থেকে আসেন বিকাশ পাঞ্জি। মাঠের বাইরেও তাঁরা অসাধারণ ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন একে অপরের।

এই জুটির খেলায় মুগ্ধ হয়ে ১৯৮৫ সালে ইস্টবেঙ্গলের বিখ্যাত নিয়োগকর্তা দীপক ওরফে পল্টু দাস ধারাবাহিক প্রচেষ্টার পর কৃশানু-বিকাশ জুটিকে স্বাক্ষর করান। ইস্টবেঙ্গলে থাকাকালীনই ‘ভারতীয় মারাদোনা’ আখ্যা পেয়েছিলেন কৃশানু। খেলার মাঠে কৃশানু-বিকাশের অসাধারণ যুগলবন্দীর কারণে ১৯৮৫ সালে ইস্টবেঙ্গল প্রথমবার ফেডারেশন কাপ জেতে। ১৯৮৬ সালে ইস্টবেঙ্গল ডুরান্ড কাপ ফাইনালে হেরে গেলেও আইএফএ শিল্ড জেতে। সৌদি আরবে ১৯৮৫-৮৬ এশিয়ান ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপের কোয়ালিফায়ারে উপস্থিত ছিলেন কৃশানু। ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ইস্টবেঙ্গলের দায়িত্ব নেন কিংবদন্তি ফুটবলার এবং অলিম্পিয়ান পিকে ব্যানার্জি। মধ্য এশিয়া থেকে আসা ক্লাব নেপালের নিউ রোড টিম, বাংলাদেশের আবাহনী ক্রীড়া চক্র, মালদ্বীপের ক্লাব ভ্যালেন্সিয়ার মতো একাধিক বিদেশী দলকে হারিয়ে কোকা কোলা ট্রফি জিতে নেয় ইস্ট বেঙ্গল। এরপর ১৯৮৭ সালে চিমা ওকোরির ইস্টবেঙ্গল দলে যোগ দেওয়ার সাথে সাথে শুরু হয় ক্লাবের স্বর্ণযুগ। কৃশানু, বিকাশ ও চিমার জুটি বিপক্ষদলের রক্ষণভাগকে তছনছ করে দিতে থাকে ম্যাচের পর ম্যাচে। লীগে ২৬টি গোল করা চিমা বেশিরভাগ গোলই করেছিলেন কৃশানুর অনবদ্য সব পাস থেকে। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে এই ত্রয়ীর অনবদ্য পারফরম্যান্সে ইস্টবেঙ্গল ডুরান্ড কাপ জেতায় হ্যাটট্রিক করেছিল। ১৯৯০ সালে কৃশানুদের খেলার জাদুতে ইস্টবেঙ্গল ট্রেবল অর্থাৎ ডুরান্ড কাপ, রোভারস কাপ এবং আইএফএ শিল্ড জিতেছিল। ১৯৮৭ সালে হাড়ে গুরুতর একটি চোট পাওয়ার ফলে কৃশানুকে ১৯৮৮-এর মরশুমের বেশিরভাগ সময় মাঠের বাইরেই কাটাতে হয়েছিল। ১৯৮৯ সালে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের অধিনায়কত্বের ভার নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু অধিনায়ক হিসেবে ভীষণ সফল তাঁকে বলা চলে না।

এরপর ইস্টবেঙ্গলের কোচ হয়ে আসেন সঈদ নঈমুদ্দিন। কৃশানুর প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিয়েছিলেন কোচ নঈমুদ্দিন। তিনি কৃশানুর ওজনের প্রশিক্ষণ এবং সাঁতারের দিকে বিশেষভাবে জোর দিলেন। ফলত কৃশানুর ফিটনেসের দারুণ উন্নতি হয়েছিল সেইসময়। সেইযুগের সবচেয়ে নামকরা ডিফেন্ডার সুব্রত ভট্টাচার্যও কৃশানুকে সবচেয়ে কঠিন প্রতিপক্ষ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। সুব্রত ভট্টাচার্য ১৯৮৭ সালের এয়ারলাইনস কাপের ফাইনালে কৃশানুকে বিশেষভাবে মার্ক করে খেলার কথা বলেন যদিও কৃশানুকে শেষপর্যন্ত আটকানো যায়নি, সেকথাও বলেন অকপটে। সাতবছর ধরে ইস্টবেঙ্গলে খেলেছিলেন কৃশানু।

১৯৯২ সালে পুনরায় মোহনবাগান ক্লাবে ফিরে যান কৃশানু। চিমা ওকোরিও সেসময় মোহনবাগানে খেলছেন। চিমার সঙ্গে জুটি বেঁধে আবার আগুন ঝরানো খেলা শুরু করেন মোহনবাগানে। মোহনবাগান প্রথম মরসুমে ফেডারেশন কাপ শিরোপা জেতে। ১৯৯৪ সালে পুনরায় ইস্টবেঙ্গলে ফিরে আসেন কৃশানু। ১৯৯৫ সালে কৃশানু-বিকাশ জুটি তাদের নিয়োগকর্তা ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া (এফসিআই) এর ফুটবল দলের হয়ে খেলতে বাধ্য হয়েছিলেন। ১৯৯৭ সালে অবসর গ্রহণ করা পর্যন্ত সেই দলের হয়েই খেলেছিলেন কৃশানু। সামগ্রিকভাবে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে ৪১টি এবং মোহনবাগানের হয়ে ৩৩টি গোল করেছিলেন কৃশানু। এছাড়াও অসংখ্য পাস বাড়িয়েছেন যা,দলকে গোল এনে দিয়েছিল।

কৃশানুকে নিজেদের ক্লাবে স্বাক্ষর করানোর জন্য ইস্টবেঙ্গল এবং মোহনবাগান ক্লাবের কর্মকর্তারা একেবারে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। তাঁকে দলে সই করানোর জন্য ইস্টবেঙ্গলের কর্মকর্তা জীবন চক্রবর্তী কৃশানুর বাড়িতে গিয়ে বারান্দা পর্যন্ত ঝাঁট দিতে শুরু করেছিলেন। উল্লেখ্য যে, কৃশানুর মা সাধারণত ছেলের ট্রান্সফার বিষয়ক সিদ্ধান্ত নিতেন, কথাবার্তা বলতেন। জীবন চক্রবর্তীর এহেন আচরণ দেখে কৃশানুর মা অত্যন্ত বিব্রত বোধ করে ছেলেকে ডাকেন। সেই সময় ট্রান্সফারের অর্থের পাশাপাশি তাঁদের এক আত্মীয়কে চাকরি দেওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন জীবন চক্রবর্তী৷

কৃশানু-বিকাশ-চিমা নব্বই-এর দশকের গোড়ার দিকে মোহনবাগানের জন্য আতঙ্কের বিষয় হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৯০ সালে মোহনবাগানের পক্ষ থেকে  টুটু বসু, অঞ্জন মিত্র এবং বলরাম ঘোষ কৃশানু-বিকাশ-চিমা তিনজনকেই মোহনবাগানে সই করানোর সিদ্ধান্ত নেন। বলরাম কৃশানুর সাথে গোপনে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য প্রথমে মানস চক্রবর্তীর সাথে যোগাযোগ করেন। মানস চক্রবর্তীকে তখন কলকাতার হাঙ্গার ফোর্ড স্ট্রিটে টুটু বসুর বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে টুটু বসু প্রাথমিক কথাবার্তা বলেন। ইস্টবেঙ্গল যখন বাগানের পরিকল্পনা সম্পর্কে অবগত হয়, তখন কৃশানুকে গোপনে চেন্নাইতে পাঠিয়ে দেয় তারা এই ট্রান্সফার আটকানোর জন্য। অঞ্জন মিত্রও চলে যান চেন্নাই কিন্তু পিছনে যান ইস্টবেঙ্গলের এক কর্মকর্তা সুপ্রকাশ গড়গড়ি। গভীর রাতে কৃশানুকে অঞ্জন মিত্রের হোটেলে নিয়ে আসা হয়।  কৃশানুকে সই করানোর আগেই গড়গড়ি ঘরে ঢুকে পড়েন। তিনি অঞ্জন মিত্রের কাছ থেকে কয়েক মিনিট চেয়ে নেন কৃশানুর সাথে কথা বলার জন্য। অঞ্জন মিত্র অনুমতিও দেন। গড়গড়ি কৃশানুকে বোঝান মোহনবাগানে যোগ দিলে তাঁর খ্যাতি প্রতিপত্তি সবই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কোমলহৃদয় কৃশানু গড়গড়ির কত্থা শুনে সেবার ইস্টবেঙ্গলেই সই করেন।

আন্তর্জাতিক ফুটবলেও কৃশানুর অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৮৪ সালের ২২ জুন গ্রেট ওয়াল কাপে চীনের বিরুদ্ধে ভারতের হয়ে কৃশানুর আন্তর্জাতিক অভিষেক অসাধারণ ছিল। কৃশানু দে দশটি লিস্ট ‘এ’ ম্যাচে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন এবং ১৯৮৬ সালে মালয়েশিয়ায় থাইল্যান্ডের বিরুদ্ধে মারডেকা টুর্নামেন্টে হ্যাটট্রিক সহ ৭টি গোল করেছিলেন। তিনি ভারতীয় দলের সদস্য হিসাবে এশিয়ান গেমস (১৯৮৬), মারডেকা কাপ, প্রাক-অলিম্পিক, সাফ গেমস এবং এশিয়ান কাপে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৯২ সালে এশিয়ান কাপ কোয়ালিফায়ারে ভারতীয় দলের অধিনায়কও ছিলেন তিনি।

১৯৯৭ সালে অবসর নেওয়ার পর কৃশানু কোচ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া এফসি-তে কোচিং করান তিনি। পরে তিনি ২০০০ সাল নাগাদ কালীঘাট ক্লাবের পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

একটি অপেশাদার ম্যাচ চলাকালীন তিনি গুরুতর আহত হন। তাঁর শরীরে সংক্রমণ শুরু হলে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়। অস্ত্রোপচারের সময় তিনি পালমোনারি এমবোলিজমের শিকার হন যার ফলে তাঁর শরীরের নিম্নার্ধে রক্ত জমাট বাঁধে এবং তা তাঁর ফুসফুসকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে দেয়। ধীরে ধীরে অনেকগুলি অঙ্গ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে এবং ২৪ ঘন্টা প্রাণপণ লড়াইয়ের পর ২০০৩ সালের ২০ মার্চ মাত্র ৪১ বছর বয়সে কিংবদন্তি ফুটবলার কৃশানু দে-র মৃত্যু হয়।

সম্প্রতি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম জিফাইভে কৃশানু দের জীবনের ওপর আট এপিসোডের একটি ওয়েবসিরিজ মুক্তি পেয়েছে। 

আপনার মতামত জানান