কুলিক পাখিরালয় ভ্রমণ

কুলিক পাখিরালয় ভ্রমণ

নিবিষ্ট চিত্তে বাইনোকুলার হাতে দূরের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় পাখির জল পান করা কিংবা নীল আকাশের বুকে পাখিদের অবাধ উড়ান ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দি করতে ভালোবাসেন যাঁরা তাঁদের কাছে ভারতের বিখ্যাত সব পাখিরালয়গুলি ভ্রমণের আদর্শ জায়গা। ভরতপুর কিংবা সালিম আলি জাতীয় পাখিরালয়ের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের মধ্যেই যে একখানা আদর্শ পাখিরালয় রয়েছে সে কথা অনেকেই ভুলে যান। এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম পাখিরালয় হিসেবে পরিচিত রায়গঞ্জের এই কুলিক পাখিরালয় পরিযায়ী পাখিদের এক পরম প্রশান্তিময় আশ্রয়। ম্যানেজমেন্ট এফেক্টিভনেস ইভ্যালুয়েশন অর্থাৎ এম.ই.ই-র প্রতিবেদন অনুযায়ী ভারতের অন্যতম বিখ্যাত পাঁচটি জাতীয় উদ্যান ও অভয়ারণ্যের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে রায়গঞ্জ বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্য যার অন্যতম অংশ এই কুলিক পাখিরালয়। হাল্কা শীতের আমেজে অল্পদিনের ছুটি কাটাতে অভয়ারণ্যের নির্জনতার মাঝে পাখিদের কূজন শুনতে বেরিয়ে পড়াই যায় কুলিক পাখিরালয়ের উদ্দেশ্যে।

উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জে এই কুলিক পাখিরালয় অবস্থিত। রায়গঞ্জ সদর শহর থেকে মাত্র ৪ কিমি দূরত্বে রায়গঞ্জ বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্যের অন্তর্গত এই পাখিরালয়। কলকাতা থেকে এর দূরত্ব ৪২৫ কিমি. এবং নিকটবর্তী শিলিগুড়ি থেকে ১৮১ কিমি। সমগ্র পাখিরালয়টি পয়ঁত্রিশ একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। তবে আশেপাশের আরও কিছু অংশ মিলিয়ে এর আয়তন প্রায় দুশো ছিয়াশি একর। কুলিক নদী বয়ে চলেছে অবিরত এই পাখিরালয়ের পাশ দিয়ে। এই নদীর নামেই পাখিরালয়টির নামকরণ হয়েছে। এছাড়া পাখিরালয়ের একেবারে গা ঘেঁষে চলে গেছে ৩৪ নং জাতীয় সড়ক।

১৯৭০ সাল নাগাদ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সামাজিক বনসৃজন প্রকল্পের আওতায় এই অঞ্চলের উন্নয়ন কার্য শুরু হয়েছিল। কদম, শিশু, জারুল, ইউক্যালিপটাস ইত্যাদি প্রজাতির বহু পর্ণমোচী গাছ সেই সময় লাগানো হয় এই অঞ্চলে। ধীরে ধীরে এই অরণ্যে আসতে শুরু করে এশীয় শামুকখোলের মতো অন্যান্য পরিযায়ী পাখির দল। প্রজননের ঋতুতেই মূলত পাখিদের আগমন ঘটে এখানে। ১৯৮৫ সালে কৃত্রিমভাবে নির্মিত এই অরণ্যকে সরকারিভাবে ‘রায়গঞ্জ বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্য’ নামে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।


সববাংলায় সাইটে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য আজই যোগাযোগ করুন
contact@sobbanglay.com


 

কিছুটা ইংরেজি ‘ইউ’ (U) আকারের এই অভয়ারণ্যে কুলিক নদীর পাশাপাশি কিছু কৃত্রিম নালাও রয়েছে। বেশ কিছু ছোট-বড় খাল এই অরণ্যে এসে মিশেছে যেখানে বর্ষায় জল জমলে পাখিদের আনাগোনা বাড়তে শুরু করে। এই খাল-নালার জলেই এশীয় শামুকখোল প্রজাতির পাখিদের প্রধান খাদ্য আপেল শামুক পাওয়া যায়। এই খাবারের খোঁজেই তাদের আগমন পর্যটকদের সন্ধানী দৃষ্টিকে সার্থকতা এনে দেয়। বলা হয় এই কুলিক পাখিরালয় এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম পক্ষীনিবাস। সমগ্র অঞ্চলের মধ্যে মাত্র ০.১৪ বর্গকিমি অঞ্চলই কোর অঞ্চল বলে চিহ্নিত। বাকি অংশটিকে বাফার অঞ্চল বলা হয়। প্রায় ১৬৪টি প্রজাতির পাখির আনাগোনা চলে কুলিক পাখিরালয়ে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলি থেকে প্রতি বছর এই পাখিরালয়ে হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি এখানে আসে। প্রতি বছর সাধারণত মে মাসের শেষদিক থেকে জুন মাস নাগাদ পাখিদের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়। এশীয় শামুকখোল, ফ্লাইক্যাচার, ড্রঙ্গো, এগ্রেট, স্টর্ক, হেরন ইত্যাদি পরিযায়ী পাখিদের পাশাপাশি মাছরাঙা, কাঠঠোকরা, ফিঙে, বাজ, চিল, পেঁচা ইত্যাদি দেশীয় পাখিদেরও দেখা মেলে এই পাখিরালয়ের নৈসর্গিক পরিবেশে। আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাস আসলে পরিযায়ী এই পাখিদের প্রজননের প্রকৃষ্ট সময়। তাই তার আগে থেকেই পাখিদের বাসা তৈরি করতে দেখা যায় এখানে। অক্টোবর-নভেম্বর মাস নাগাদ এখানে পাখিরা তাদের সন্তানদের আকাশে উড়তে শেখায় আর এই সময়টাই পাখি দেখার জন্য আদর্শ। জঙ্গলের মধ্যে বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে কিংবা খালি চোখেই দীর্ঘ সময় পাখি দেখার আশায় বসে থাকতে থাকতে নিজেকে দ্বিতীয় সালিম আলি ভাবাই যায়। পাখিদের নিজস্ব জীবনাচরণ হয়ত নির্জনে চোখে পড়ে যেতে পারে। দুর্লভ ও বিলুপ্তপ্রায় পাখিদের স্বচক্ষে দেখার অভিজ্ঞতার স্বাদই আলাদা। ২০০২ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী প্রায় সাতাত্তর হাজার পাখি এই পাখিরালয়ে আসে প্রতি বছর। সমগ্র বিশ্বের সারস জাতীয় পাখিদের সংখ্যা প্রায় এক লক্ষ তিরিশ হাজার যার মধ্যে বেশিরভাগ পাখিই রয়েছে এশিয়ায়। এই প্রজাতির পাখিরা সাধারণত দলবদ্ধভাবে কলোনি তৈরি করে থাকে যাকে ‘হেরনরি’ (Heronry) বলা হয়। এই কুলিক পাখিরালয়কে একটি আদর্শ হেরনরি বলা যায়। এশীয় শামুকখোল স্টর্ক, এগ্রেট, লিটল কর্মোর‍্যান্ট, নাইট হেরন, পণ্ড হেরন ইত্যাদি পাখিগুলি জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে বাসা তৈরি করে। বর্ষার আগমনের উপরে এই পাখিদের আসা-যাওয়া নির্ভর করে। বর্ষা কখনও তাড়াতাড়ি এলে, এই পাখিরাও তাড়াতাড়ি চলে আসে এখানে। প্রতি বছর এই পাখিদের দেখার জন্য বহু পর্যটক ভিড় করেন এখানে। বেশিরভাগ সময় এই পর্যটকদের ভিড় পাখিদের বিরক্ত করে, স্থানীয় পরিবেশও ক্ষতিগ্রস্ত হয় পর্যটকদের জন্য। এই কারণে রায়গঞ্জের সামাজিক বনসৃজন দপ্তর কাছের ভাট্টাদিঘিতে একটি পিকনিক স্পট চালু করার পরিকল্পনা নিয়েছে যাতে পাখিরালয়ের কোনরকম ক্ষতি না হয়।

পশ্চিমবঙ্গের যে প্রান্ত থেকেই আসুন না কেন, ট্রেনে করে নামতে হবে শিলিগুড়ি স্টেশনে আর এই শিলিগুড়ি থেকে খুব সহজেই গাড়ি করে কুলিক পাখিরালয়ে পৌঁছানো যায়। সেক্ষেত্রে ১২ নং জাতীয় সড়ক ধরে মোটামুটি ১৬০ কিমি পথ পেরিয়ে সোজা চলে আসতে হবে রায়গঞ্জ বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্যে। এছাড়া সড়ক পথে এলে গাড়িতে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে ৪২৫ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে কুলিক পাখিরালয়ে আসা যায়। বিমানে আসতে গেলে নিকটবর্তী বাগডোগরা বিমানবন্দরে নেমে সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে মোটামুটি ৩-৪ ঘন্টার পথ পেরিয়ে পৌঁছানো যাবে কুলিক পাখিরালয়ে।

রায়গঞ্জে থাকার জায়গার মধ্যে সবথেকে নির্ভরযোগ্য স্থান হল পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন উন্নয়ন নিগমের ‘দিনান্তে ট্যুরিজম প্রপার্টি’। এছাড়াও বেশ কিছু বেসরকারি হোম-স্টে বা হোটেল রয়েছে কুলিকের আশেপাশে। তবে সরকারি আবাসে থাকতে অন্তত তিন-চার মাস আগে থেকে বুকিং করে নেওয়াই ভাল কারণ মরশুমে ভিড় বেশি হয় পর্যটকদের আর তাই ঘর সেভাবে খালি পাওয়া নাও যেতে পারে।

এখানে বিশেষ দ্রষ্টব্য বলতে পাখিরালয়টিই রয়েছে। ভালমতো এই পাখিরালয়ের ভিতরটা ঘুরে দেখা যায়, সময় কাটানো যায়। পাখি দেখতে ধৈর্য চাই, তাই অযথা অধৈর্য হয়ে জোরে জোরে কথা বলা, দৌড়-ঝাঁপ না করাই ভাল। এই পাখিরালয়ে পাখিদের পাশাপাশি রয়েছে বিশাল বিশাল বৃক্ষ। শিয়াল, খেঁকশিয়াল, খরগোশ, বনবিড়াল ইত্যাদি প্রাণীরও বাসস্থান এই পাখিরালয়ের অরণ্য। একইসঙ্গে এখানকার জলাশয়ে, কুলিক নদীতে দেখা মিলতে পারে কাঁকড়াদের। হাতে ক্যামেরা থাকলে টুক টুক করে পাখিদের ছবি তুলতে তুলতেই কখন যে বেলা গড়িয়ে যাবে টের পাওয়া যাবে না। অরণ্যের মধ্যে রয়েছে একটি নজরমিনার যা থেকে সমগ্র অভয়ারণ্যের একটি সুন্দর দৃশ্য চোখে পড়ে। অরণ্যের ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জলাশয় থেকে শামুক খুঁটে খাওয়া সারস বা শামুকখোলের দেখা মিলতেই পারে। ট্যুরিস্ট লজের বারান্দায় বসেও এই অরণ্যের শোভা উপভোগ করা যায়। শান্তিপ্রিয় মানুষ হলে, এখানেই তিন-চার দিন কাটিয়ে দিতে পারেন। তাজা অক্সিজেন সমৃদ্ধ বাতাস বুক ভরে জমিয়ে নিয়ে তারপর ফিরে আসা যাবে আবার।

অন্যান্য সাইটসিইং-এর মধ্যে পড়বে রায়গঞ্জের ইতিহাস-বিখ্যাত কিছু জায়গা। যেমন – বিন্দোল গ্রামের কাছে ভৈরবী মন্দির, আত্রেয়ী নদীর কাছের বাংলাদেশ সীমানা, বহিন রাজবাড়ি, দুর্গাপুর রাজবাড়ি, বুরহানা ফকির মসজিদ ইত্যাদি। তবে এগুলি দেখতে গেলে গোটা একটা দিন হাতে রাখা জরুরি। সীমান্তে বেশিক্ষণ সময় কাটানো যাবে না, প্রয়োজন পড়তে পারে পরিচয়পত্রেরও।

কুলিক পাখিরালয়ে আসার সবথেকে আদর্শ সময় হল অক্টোবর-নভেম্বর মাস। শীতের অন্য সময় এলে সেভাবে পাখি দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে সাধারণভাবে শীতকালই কুলিক পাখিরালয় ভ্রমণের আদর্শ স্থান।

ট্রিপ টিপস

কীভাবে যাবেন – পশ্চিমবঙ্গের যেকোন প্রান্ত থেকে রায়গঞ্জগামী ট্রেন ধরে রায়গঞ্জে নামতে হবে। কিংবা অন্য কোনো ট্রেনে নিকটবর্তী গাজোল বা বারসোই স্টেশনেও নামা যায়। তারপর সেখান থেকে গাড়ি বা বাসে করে রায়গঞ্জে আসা যায়। গাড়িতে এলে ৩৪ নং জাতীয় সড়ক ধরে আসতে হবে। বিমানের ক্ষেত্রে নিকটবর্তী বাগডোগরা বিমানবন্দরে নেমে গাড়ি নিয়ে ৩-৪ ঘন্টার পথ পেরিয়ে পৌঁছানো যায় কুলিক পাখিরালয়।

কোথায় থাকবেন – পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন উন্নয়ন নিগমের দিনান্তে ট্যুরিজম প্রপার্টি নির্ভরযোগ্য থাকার জায়গা। তাছাড়াও বেশ কিছু বেসরকারি হোটেলও রয়েছে এখানে।

কী দেখবেন – কুলিক পাখিরালয়ের নানা প্রজাতির পরিযায়ী পাখি দেখার সুযোগ একেবারেই হাতছাড়া করবেন না। পাশাপাশি বহিন রাজবাড়ি, দুর্গাপুর রাজবাড়ি, আত্রেয়ী নদীর ধারে বাংলাদেশ সীমান্ত সময় থাকলে ঘুরে আসা যায়।

কখন যাবেন – অক্টোবর-নভেম্বর মাস এখানে আসার আদর্শ সময়।

সতর্কতা – অরণ্যে পাখি দেখার সময় চিৎকার, জোরে কথা বলা উচিত নয়। দৌড়ানো বা লাফাঝাঁপি না করাই ভালো। জঙ্গলের মধ্যে খাবারের প্যাকেট, জলের বোতল একেবারেই ফেলে আসা উচিত নয়। জঙ্গলের পশু-পাখিদের বিরক্ত করা যাবে না একেবারেই। আর হোটেলে থাকার ক্ষেত্রে অন্তত তিন-চার মাস আগে থেকে বুকিং করে আসা ভালো।

বিশেষ পরামর্শ – অরণ্যের নির্জনতায় ভরপুর শান্তিতে দু-তিন দিন কাটিয়ে দেওয়া যায় কুলিক পাখিরালয়ে। অরণ্যে ভ্রমণের পাশাপাশি টুরিস্ট লজের বারান্দায় বসেও এর নৈসর্গিক শোভা উপভোগ করা যায়। হাতে ক্যামেরা থাকলে পাখিদের ছবি তুলতে ভুলবেন না।

One comment

আপনার মতামত জানান