গোসানিমারি রাজপাট

গোসানিমারি রাজপাট ভ্রমণ

কোচবিহারের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী পর্যটন কেন্দ্র গোসানিমারি রাজপাট (Gosanimari Rajpat)। রাজপাট,  কামতেশ্বরী মন্দির, শালবাগান, রাজার গড় কিংবা সিঙ্গিমারি নদী নিয়ে গড়ে ওঠা এই গোসানিমারি রাজপাটের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক প্রাচীন ইতিহাস। বিস্তীর্ণ সবুজ ঘাসের প্রান্তর, মাঝে মাঝে খননকার্যের ফলে উঠে আসা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মাঝে নাগরিক ক্লান্তি ভুলে যেতে সপ্তাহান্তের দু-তিনদিনের ছুটিতে গোসানিমারি রাজপাট ভ্রমণ করে নিতেই পারেন।

উত্তরবঙ্গের কোচবিহার জেলার দিনহাটা মহকুমার অন্তর্গত এই গোসানিমারি রাজপাট। জায়গাটিকে অনেকে খলিসা গোসানিমারি নামেও ডেকে থাকেন। কোচবিহার শহর থেকে এই গোসানিমারি রাজপাটের দূরত্ব ৩৬ কিলোমিটার এবং দিনহাটা থেকে এর দূরত্ব মাত্র ১৪ কিলোমিটার।

নানাবিধ উপকথা, জনশ্রুতি আর কিছু ইতিহাস বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই রাজপাট ঢিবি। অনেকেই মনে করেন এই রাজপাট ঢিবিটি আসলে কামতাপুরী দূর্গের প্রধান অংশ ছিল। তবে এখন হয়তো তা ঢিবির মাটির নিচে চাপা পড়ে আছে। এই অঞ্চলে পঞ্চদশ শতকে কামতা নামে একটি রাজ্য ছিল যেখানে খেন বংশীয় রাজারা শাসন করতেন। সেই কামতা রাজ্যের রাজধানী ছিল কামতাপুর। খননকার্যের ফলে এখান থেকে পাওয়া গিয়েছে বিশাল ইঁটের প্রাচীর, পাতকুয়ো, পাথরের সৌধের ভগ্নাবশেষ, একটি পুষ্করিণী ইত্যাদি। মনে করা হয় নবম বা দশম শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যেই এগুলি তৈরি করা হয়েছিল। এছাড়াও পোড়ামাটির দেব-দেবীর মূর্তি, জীব-জন্তুর মূর্তি, ফলক, সুলতানি আমলের রুপোর মুদ্রা, লোহার জিনিপত্র এমনকি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তাম্র-মুদ্রাও পাওয়া গিয়েছে গোসানিমারি রাজপাট থেকে। এখানে যে সকল ভাস্কর্য পাওয়া গিয়েছে সেগুলিতে পাল-সেন যুগের নির্মাণশৈলীর প্রভাব দেখা যায়। মধ্যযুগে কামরূপ রাজ্য শাসন করত এই খেন বংশের রাজারা। এই বংশের শেষ রাজা মৃগাঙ্ক অপুত্রক হওয়ার কারণে তাঁর অনুগত নীলধ্বজ নামে এক ভুঁইয়া ১৪৪০ সালে গৌড় দখল করেন। তাঁর হাত ধরেই কামরূপ ও কামতায় খেন বংশের সূচনা হয়। ‘গোসানিমঙ্গল’ কাব্য থেকে জানা যায় যে খেন রাজাদের আরাধ্য দেবী ছিলেন কামতেশ্বরী। পরবর্তীকালে রাজা প্রাণনারায়ণ ১৬৬৫ সালে রাজপাট ঢিবির অনতিদূরেই নির্মাণ করেন কামতেশ্বরী দেবীর মন্দির। কামতা রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা নীলধ্বজ ১৪৪০ থেকে ১৪৬০ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তাঁর পুত্র চক্রধ্বজ ১৪৬০ থেকে ১৪৮০ সাল পর্যন্ত রাজ্য শাসন করেন। চক্রধ্বজের পুত্র নীলাম্বর ১৪৮০ সালে রাজা হয়ে রাজ্যবিস্তারে মনোনিবেশ করেন। বর্তমান কোচবিহার, দিনাজপুর, কৈবর্ত, কামরূপ, আসামের দাড়ৌ জেলা এমনকি বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলা পর্যন্ত রাজ্যবিস্তার করেন তিনি। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই গৃহযুদ্ধ শুরু হলে তার সুযোগ নিয়ে গৌড়ের তুর্ক-আফগানি শাসক আলাউদ্দিন হুসেন শাহ ১৪৯৮ সালে কামতা আক্রমণ করেন এবং এর মাধ্যমেই গোসানিবাড়ির খেন রাজত্ব ধ্বংস হয়। হুসেন শাহের হাত থেকে কামতা রাজ্যের শাসনক্ষমতা চলে যায় বারো ভুঁইয়াদের দখলে এবং তারও পরে রাজা বিশ্ব সিংহ এই রাজ্য দখল করে নেন। তারপর থেকে এই অঞ্চলে সূচিত হয় কোচ রাজবংশ। পরে ইংরেজরা এদেশে এলে তাঁদের মুখে মুখে এই কোচ শব্দটি ‘কুচ’-এ পরিণত হয় এবং এভাবেই এই জেলার নাম হয় ‘কুচবিহার’। ১৮০৮ সালে ড. বুকানন হ্যামিলটন এই গোসানিমারি ঢিবির একটি অসাধারণ স্কেচ করেন এবং এই অঞ্চলের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দেন। পরবর্তীকালে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এই অঞ্চলটি খননকার্যের ভার নেয়। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০০ সালের মধ্যে গোসানিমারি রাজপাট ঢিবিতে খননকার্য চালায় ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

মনে করা হয় এই ঢিবিটিই আগে কামতাপুর দুর্গ ছিল। এর চারপাশে আজও প্রায় ২২ কিলোমিটার চওড়া ঘোড়ার খুরের মত উঁচু মাটির প্রাচীর রয়েছে। আগে যেখানে ধরলা নদী বয়ে যেত সেদিকে এই প্রাচীরটি কেবল উন্মুক্ত ছিল। বর্তমানে এটি প্রায় ৩০ ফুট উঁচু এবং ৩৫ ফুট চওড়া। তবে ঐতিহাসিকেরা বলছেন যে এই ঢিবি আগে আরও উঁচু ছিল। দূর্গটির সাতটি প্রবেশদ্বার ছিল। এর চারদিকে ২৫০ ফুট চওড়া পরিখা ছিল। এমনকি সেই পরিখায় নিয়মিত জল সরবরাহের ব্যবস্থাও ছিল। ঢিবিতে ওঠার জন্য সুন্দর পাথরের সিঁড়ি বানানো হয়েছে। আদিগন্ত বিস্তীর্ণ সবুজ প্রান্তরে খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিতে নিতে সহজেই ক্লান্তি ভুলে যাওয়া যায়। ঢিবি থেকে নেমে দেখা যাবে একটি বিশাল ভাস্কর্যশালা রয়েছে যেখানে সংরক্ষিত আছে ঢিবির খননকার্যে পাওয়া সমস্ত জিনিসপত্র ও প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানসমূহ। ঢিবির উপরে ভিডিও করা বা ছবি তোলায় কোনও নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও এই ভাস্কর্যশালার ভিতরে ভিডিও করা নিষেধ। গোসানিমারি রাজপাট থেকে মাত্র আড়াই-তিন কিলোমিটার পথ পেরোলেই দেখা যাবে কামতেশ্বরী মন্দির। খেন রাজাদের নির্মিত আসল কামতেশ্বরী মন্দির ধ্বংস হয়ে গেলেও বর্তমান মন্দিরটিও বেশ ঐতিহ্যবাহী। মূল মন্দিরটিতে দেখা যাবে কামতেশ্বরী দেবীর মন্দির, তারকেশ্বর শিবলিঙ্গ। মন্দিরের চারপাশেই চারটি শিবলিঙ্গ দেখতে পাওয়া যায়। বলা হয় প্রতি বছর দুর্গাপূজায় এখানে মহিষ বলি দেওয়া হয়।

 গোসানিমারি রাজপাট আসতে গেলে প্রথমে নিউ কোচবিহার স্টেশনে ট্রেনে করে পৌঁছাতে হবে। তারপর স্টেশন থেকে গাড়ি ভাড়া করে কাকিনা রোড হয়ে ৩৪.৭০ কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে পৌঁছানো যায় গোসানিমারি রাজপাট। সময় লাগে কমবেশি ১ ঘন্টা ১৫ মিনিট। তবে কেউ যদি নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নামেন, সেক্ষেত্রে ২৭ নং জাতীয় সড়ক এবং ১২ এ নং রাজ্য সড়ক ধরে মোটামুটি পৌনে চার ঘন্টার মধ্যেই গোসানিমারি পৌঁছানো যায় গাড়িতে করে। তবে সময়ের দিক থেকে নিউ কোচবিহারে নামাই শ্রেয়।

এখানে আশেপাশে থাকার জায়গার অভাব নেই। কোচবিহার সদরে হোটেলের সংখ্যা বেশি। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ট্যুরিস্ট লজও রয়েছে অনেক। তবে ঘুরতে আসার আগে অবশ্যই হোটেল বা লজ বুক করে নেওয়া দরকার।

গোসানিমারি রাজপাট ভ্রমণ বলতেই প্রথমে বিশেষ দ্রষ্টব্যের মধ্যে পড়ে গোসানিমারি ঢিবি এবং এখানকার ভাস্কর্যশালা। রাজপাট ঢিবি পরিদর্শনকালে মাথায় রাখতে হবে কোনওভাবেই এই জায়গাকে নোংরা করা যাবে না। মোটামুটিভাবে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত এখানকার ফটক খোলা থাকে, কিন্তু ঢিবি ঘোরার জন্য কোনও টিকিটের ব্যবস্থা নেই। ঢিবির উপর হাঁটতে হাঁটতে ভাবতেই পারেন পায়ের নিচে মাটির তলায় লুকিয়ে আছে আরও কোনও অজানা ইতিহাস। গোসানিমারি ঘুরতে একদিন যথেষ্ট, ফলে শুধুমাত্র একদিনের জন্য এতদূরে না এসে এক ট্রিপে পুরো কোচবিহারটাই ঘুরে নেওয়া যায়। ফলে গোসানিমারি দেখে সাইটসিইং হিসেবে দেখে আসতে পারেন কোচবিহারের রাসমঞ্চ, কোচবিহার রাজবাড়ি, মদনমোহন মন্দির ইত্যাদি।

বছরের যে কোনও সময় গোসানিমারি রাজপাট ভ্রমণে আসা যায়। তবে বর্ষাকাল এড়িয়ে চলাই ভাল।

দিনহাটার শীতলপাটি খুবই বিখ্যাত। গোসানিমারি ঘোরার সময় খেয়াল থাকলে নিকটবর্তী বাজারে শীতলপাটি খোঁজ করে দেখতে পারেন এবং পেয়ে গেলে নিজের জন্য, আত্মীয়-স্বজন কিংবা বন্ধু-বান্ধবদের জন্য সংগ্রহ করে নিতেই পারেন।


ট্রিপ টিপস :

  • কীভাবে যাবেন –  নিউ কোচবিহার স্টেশন থেকে গাড়ি ভাড়া করে গোসানিমারি রাজপাট পৌঁছানো যায়। কমবেশি ১ ঘন্টা ১৫ মিনিট সময় লাগে।
  • কোথায় থাকবেন –  আশেপাশে বহু হোটেল বা লজ রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ট্যুরিস্ট লজও রয়েছে। চাইলে কোচবিহার সদরেও থাকতে পারেন।
  • কী দেখবেন – বিশেষ দ্রষ্টব্যের মধ্যে পড়ে গোসানিমারি রাজপাট ঢিবি ও ভাস্কর্যশালা। এছাড়াও কোচবিহারের রাজবাড়ি, রাসমঞ্চ, মদনমোহন মন্দির ইত্যাদিও সাইটসিইং হিসেবে ঘুরে নেওয়া যায়।
  • কখন যাবেন – বছরের যে কোনও সময় আসা যায় গোসানিমারি রাজপাট।
  • সতর্কতা –
    • ঘুরতে আসার আগে নির্দিষ্ট লজ বা হোটেল বুক করে নেওয়া দরকার।
    • গোসানিমারি ঢিবি ঘোরার সময় কখনও জায়গাটা নোংরা করা উচিত নয়।
    • ঢিবির উপরে পিকনিক করতে বসে যাবেন না।
    • ভাস্কর্যশালায় ঢুকে ভিডিও করা নিষিদ্ধ।

আপনার মতামত জানান