লিওনার্ড অয়লার

লিওনার্ড অয়লার

গণিতের ইতিহাসকে সারা বিশ্বের নিরিখে বিশ্লেষণ করতে বসলে যেসমস্ত গণিতবিদের কথা উঠে আসবে তাঁদের মধ্যে অন্যতম সুইস গণিতজ্ঞ লিওনার্ড অয়লার (Leonhard Euler)। বিশ্লেষণাত্মক জ্যামিতি, ত্রিকোনমিতি, ক্যালকুলাস, সংখ্যাতত্ত্ব ইত্যাদি গণিতের বিভিন্ন শাখায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন তিনি। গণিত ছাড়াও পদার্থবিদ্যা, আলোকবিদ্যা, যান্ত্রিক প্রকৌশল, জ্যোতির্বিদ্যা ইত্যাদি কয়েকটি বিষয়েও নিজের পান্ডিত্যের ছাপ রেখেছিলেন৷ গ্রাফ তত্ত্ব এবং টপোলজির অধ্যয়ন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অয়লার। প্রবর্তন করেছিলেন বেশকিছু গাণিতিক পরিভাষা। ক্যাপিটাল সিগমা, ছোটহাতের পাই ইত্যাদি গ্রীক অক্ষরকেও গণিতের মধ্যে যথাযথভাবে ব্যবহার শুরু করেন তিনি। এমনকি সঙ্গীতে গাণিতিক প্রয়োগ বিষয়েও আগ্রহী ছিলেন অয়লার। কেবল আঠারো শতকেরই নয়, তাঁকে কেউ কেউ বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতবিদও বলে থাকেন।

১৭০৭ সালের ১৫ এপ্রিল সুইজারল্যান্ডের বাসেলে লিওনার্ড অয়লারের জন্ম হয়। তাঁর বাবা পল অয়লার ছিলেন আর্চের একজন যাজক। পল একজন প্রোটেস্টেন্ট মন্ত্রীও হয়েছিলেন এবং আরেকজন প্রোটেস্টেন্ট মন্ত্রীর কন্যা মার্গারেট ব্রুকারকে বিবাহ করেছিলেন। এই পল এবং মার্গারেটের জ্যেষ্ঠপুত্র ছিলেন অয়লার। আনা মারিয়া এবং মারিয়া ম্যাগডালেনা নামে আরও দুটি ছোটো বোন এবং জোহান হেনরিখ নামে এক ছোটো ভাই ছিল অয়লারের। যখন লিওনার্ডের মাত্র একবছর বয়স তখন তাঁর পরিবার বাসেল ছেড়ে সুইজারল্যান্ডের রিহেন শহরে চলে গিয়েছিল। সেখানে তাঁর বাবা পল স্থানীয় গির্জার যাজক হয়েছিলেন। রিহেন শহরেই শৈশবের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছিলেন লিওনার্ড অয়লার। তাঁর বাবা পল অয়লার নিজে বাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন করেছিলেন এবং গণিতবিদ জ্যাকোব বার্নোলির বক্তৃতায় অংশ নিয়েছিলেন এমনকি দুজনে এক বাড়িতেও থেকেছিলেন। সেই বার্নোলির কাছে গণিত শিখেছিলেন পল কিছু পরিমাণ। ফলে পলের মধ্যেও অল্পবিস্তর গণিতের চর্চা ছিল।

বাবার কাছ থেকে লিওনার্ড প্রাথমিক গণিতশিক্ষা লাভ করেছিলেন। অয়লারকে যখন বাসেলের এক ল্যাটিন স্কুলে পাঠানো হয়েছিল তখন তাঁর বয়স আটবছর। সেসময় তিনি তাঁর ঠাকুমার (মায়ের মা) কাছে থাকতেন। সেই বাসেল স্কুলের অবস্থা এতটাই শোচনীয় এবং দরিদ্র প্রকৃতির ছিল যে, সেই স্কুল থেকে মোটেও তেমন ভালো গণিত শেখেননি তিনি, বরং বাবার কাছ থেকে শিখেই গণিতে তাঁর আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। এছাড়াও অয়লার তরুণ ধর্মতত্ত্ববিদ জোহানেস বার্কহার্টের কাছেও প্রাইভেট টিউশন পড়েছিলেন।

১৭২০ সালে লিওনার্ড বাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন। অবশ্য পল অয়লার চেয়েছিলেন ছেলে তাঁর মতোই গীর্জায় এসে প্রবেশ করুক, সেই কারণে মন্ত্রণালয়ের প্রস্তুতির জন্যই তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন তিনি। সেখানে পল অয়লারের গণিত শিক্ষক ও বন্ধু মৃত জ্যাকোব বার্নোলির ছোটভাই জোহান বার্নোলির কাছে প্রাথমিক গণিতের কোর্সটির জন্য পড়াশুনা শুরু করেছিলেন লিওনার্ড। অল্পদিনের মধ্যেই জোহান নিজের ছাত্রের অসাধারণ প্রতিভার ঝলক লক্ষ্য করতে থাকেন৷ এই সময়তেই বার্নোলির সমর্থনে যাজকের পরিবর্তে একজন গণিতবিদ হওয়ার জন্য পিতার সম্মতি পেয়েছিলেন তিনি। ১৭২৩ সালে দর্শনশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন লিওনার্ড এবং নিউটনদেকার্তের দার্শনিক ধারণার তুলনা করে একটি গবেষণা করেন। পরে, ১৭২৩ সালেই পিতার ইচ্ছানুসারে বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মতত্ত্বের পড়াশুনা শুরু করলেও তাতে উৎসাহ পাননি তিনি। ১৭২৬ সালে ‘ডি সোনো’ শিরোনামে শব্দের প্রচারের ওপর একটি গবেষণা সম্পন্ন করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন অয়লার। ১৭২৭ সালে তিনি প্যারিস একাডেমি প্রাইজ প্রবলেম প্রতিযোগিতায় প্রবেশ করেন। সেবছরের সমস্যাটি ছিল জাহাজের ওপর মাস্তুলের স্থাপনের সর্বোত্তম উপায়টি খুঁজে বের করা। যদিও ‘নৌ স্থাপত্যের জনক’ নামে পরিচিত পিয়েরে বোগুয়ের সেই প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন এবং অয়লার দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। বছরের পর বছর অয়লার এই প্রতিযোগিতায় মোট ১৫ বার অংশ নিয়েছিলেন, যার মধ্যে তিনি জয়ী হয়েছিলেন ১২ বার।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

১৭২৬ সালে জোহান বার্নোলির পুত্র নিকোলাস রাশিয়ায় মারা গেলে সেন্ট পিটার্সবার্গে ইম্পেরিয়াল রাশিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সে তাঁর পদটি শূন্য হয়ে যায়। সেসময় নিকোলাসের ভাই ড্যানিয়েল শারীরবিদ্যার শূণ্যপদটির জন্য বন্ধু লিওনার্ড অয়লারের কথা বলেন এবং ১৭২৬ সালের নভেম্বরে সেই প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করেন অয়লার।

১৭২৭ সালের ৫ এপ্রিল বাসেল ত্যাগ করেন তিনি৷ ১৭ মে লুবেক থেকে নৌকায় লিওনার্ড সেন্ট পিটার্সবার্গে পৌঁছন। একাডেমির মেডিকেল বিভাগের জুনিয়র পদ থেকে তিনি গণিত বিভাগের একটি পদে উন্নীত হয়েছিলেন। ড্যানিয়েল বার্নোলির সঙ্গে সেসময় ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় তাঁর। অয়লার রাশিয়ান ভাষা আয়ত্ত করেন ও সেন্ট পিটার্সবার্গে বসবাস করতে শুরু করে দেন৷ ১৭২৭ থেকে ১৭৩০ সাল পর্যন্ত তিনি রাশিয়ান নৌবাহিনীতে একজন মেডিকেল লেফটেন্যান্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এখানে উল্লেখ্য ১৭২৯ সালে তিনি বিটা এবং গামার ফাংশন প্রথম চালু করেছিলেন। ১৭৩০ সালে যখন একাডেমিতে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং পূর্ণ সদস্য হন তখন নৌবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দেন অয়লার। ড্যানিয়েল বার্নোলি সেখানে গণিতের সিনিয়র চেয়ার অলঙ্কৃত করতেন। কিন্তু ১৭৩৩ সালে তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গ ছেড়ে বাসেলে ফিরে গেলে অয়লারই সেই চেয়ারে নিযুক্ত হয়েছিলেন।
১৭৩৪ সালের ৭ জানুয়ারি অয়লার জিমনেসিয়ামের এক চিত্রশিল্পী জর্জ গেসেলের মেয়ে ক্যাথারিনা গেসেলকে বিবাহ করেছিলেন। তাঁদের মোট ১৩টি সন্তান হলেও তারমধ্যে মাত্র পাঁচটি শৈশবে বেঁচে ছিল।

এখানে উল্লেখ্য যে, ১৭৩০ সালের পরে তিনি কার্টোগ্রাফি, বিজ্ঞান শিক্ষা, চুম্বকত্ব, ফায়ার ইঞ্জিন, মেশিন এবং জাহাজ নির্মাণ সংক্রান্ত রাষ্ট্রীয় প্রকল্পগুলি পরিচালনা করেন। এসময় সংখ্যাতত্ত্বের ওপর গবেষণায় মনোনিবেশ করেছিলেন তিনি। ডিফারেন্সিয়াল ইকুয়েশনস, ক্যালকুলাস অব ভেরিয়েশনস, এবং র‍্যাশানাল মেকানিকস, এই তিনটি বিষয়কে আন্তঃসংযুক্ত হিসেবে দেখেছিলেন তিনি। এসময় ১৭৩৭ সালে অন্যান্য প্রবন্ধ এবং তাঁর উল্লেখযোগ্য গবেষণা গ্রন্থ ‘মেকানিকা’ প্রকাশ পায়, যেটি নিউটনিয়ান গতিবিদ্যাকে প্রথমবারের মতো গাণিতিক বিশ্লেষণের আকারে ব্যপকভাবে উপস্থাপন করেন। তাছাড়া ১৭৩৫ সালে অয়লারের পাওয়ার সিরিজের ব্যবহার তাঁকে বিখ্যাত ব্যাসেল সমস্যার সমাধান করতে সহায়তা করেছিল। ১৭৩৫ সাল নাগাদ প্রচন্ড শারীরিক অসুস্থতার কারণে মৃতপ্রায় হয়ে পড়েছিলেন অয়লার। আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, ১৭৩৮ সালে কার্টোগ্রাফিক কাজের প্রচন্ড চাপের ফলে তাঁর দৃষ্টিশক্তির সমস্যা দেখা দিয়েছিল।

১৭৪০ সাল নাগাদ অয়লারের খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৭৩৮ এবং ১৭৪০ সালে প্যারিস একাডেমির গ্র্যান্ড প্রাইজ জিতেছিলেন তিনি। ফ্রেডরিক দ্বিতীয় ১৭৪০ সালে তাঁর প্রতিষ্ঠিত বার্লিন একাডেমির জন্য অয়লারকে চেয়েছিলেন কিন্তু সেসময় পিটার্সবার্গ ছেড়ে যেতে চাননি লিওনার্ড। তবে সম্রাট আনার মৃত্যুর পর দ্বিতীয় ফ্রেডরিক অয়লারকে ১৬০০ একুস (ফরাসি মুদ্রা) দিতে রাজি হলে তিনি বার্লিনে চলে গিয়েছিলেন। ১৭৪১ সালে বার্লিন যাওয়ার অনুমতি আদায়ের উদ্দেশ্যে তিনি নিজের ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তির জন্য হালকা আবহাওয়ার প্রয়োজন দেখিয়ে একাডেমির কাছ থেকে সম্মতি আদায় করেছিলেন। প্রুশিয়ার ফ্রেডরিক দ্য গ্রেট দ্বারা অফার করা বার্লিন একাডেমিতে একটি পদ গ্রহণ করে ১৭৪১ সালের জুন মাসে পিটার্সবার্গ ছেড়ে বার্লিনে চলে যান তিনি। সেই একাডেমির জন্য অবিশ্বাস্য পরিমাণ কাজ করেছিলেন অয়লার। কর্মীদের নির্বাচন; বিভিন্ন আর্থিক বিষয় তত্ত্বাবধান; এবং, বিশেষ করে, বিভিন্ন ক্যালেন্ডার এবং ভৌগলিক মানচিত্রের প্রকাশনা পরিচালনা করা, যার বিক্রি একাডেমির আয়ের উৎস ছিল, ইত্যাদি দায়িত্ব সহকারে করতেন সেখানে। তিনি গ্রন্থাগার এবং বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা সংক্রান্ত একাডেমীর কমিটিতে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও রাষ্ট্রীয় লটারি, বীমা, বার্ষিক এবং পেনশন ও আর্টিলারি সংক্রান্ত সরকারের উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছিলেন অয়লার। ১৭৪৪ সালে প্রুশিয়ান একাডেমি অফ সায়েন্সের গাণিতিক ক্লাসের পরিচালক নিযুক্ত হন এবং একই বছরে প্যারিসের একাডেমি দ্বারা চুম্বকত্বের উপর কাজের জন্য একটি পুরস্কার প্রদান করা হয় তাঁকে। ১৭৫০ সালে অয়লার তাঁর বৃদ্ধ মা-কে ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে বার্লিনে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন, যেখানে ১৭৬১ সালে মৃত্যু পর্যন্ত মায়ের দেখাশুনা করেন তিনি। ১৭৫১ সালে অয়লার ‘প্রিন্সিপাল অব লিস্ট অ্যাকশন’ নামক একটি গবেষণার জন্য বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। সেবছরই অর্থাৎ ১৭৫১তেই জটিল সংখ্যার লগারিদমের সম্পূর্ণ তত্ত্ব প্রকাশ করেন তিনি।

বার্লিনে প্রায় ২৫ বছর বসবাস করেছিলেন তিনি, এবং সেখানে থাকাকালীন প্রায় ৩৮০টি নিবন্ধ রচনা করেছিলেন। ১৭৪৮ সালে প্রকাশিত হয় ‘ইনট্রোডাক্টিও ইন অ্যানালাইসিন ইনফিনিটোরাম’ নামের ফাংসান সংক্রান্ত একটি লেখা, আবার ১৭৫৫তে ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাসের ওপর তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য রচনা, ‘ইনস্টিটিউশনস ক্যালকুলি ডিফারেনশিয়ালিস’ প্রকাশিত হয়েছিল। সেই ১৭৫৫তেই রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সের এবং ফ্রেঞ্চ একাডেমি অফ সায়েন্সেসের একজন বিদেশী সদস্য নির্বাচিত হন অয়লার। বার্লিনে থাকাকালীন তিনি ক্যালকুলাসের ওপর বই তো রচনা করেইছিলেন, তাছাড়াও গ্রহের কক্ষপথের গণনা, জাহাজ নির্মাণ এবং নেভিগেশন, ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়েও গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন লিওনার্ড।
বার্লিন একাডেমির সভাপতি মাউপারতুইসের মৃত্যু হলে একাডেমির নেতৃত্ব নিজের হাতে তুলে নেন অয়লার। কিন্তু এসময় ফ্রেডরিকের সঙ্গে সম্পর্ক খানিকটা শিথিল হয়ে পড়েছিল তাঁর। ফ্রেডরিক ১৭৬৩ সালে  ডি’আলেমবার্টকে একাডেমির সভাপতিত্বের প্রস্তাব দিলে বিরক্ত হন অয়লার। যদিও ডি’আলেমবার্ট বার্লিন যেতে অস্বীকার করেছিলেন। এরপর একাডেমি পরিচালনায় ফ্রেডরিকের ক্রমাগত হস্তক্ষেপের কারণেই অয়লার বুঝতে পারেন একাডেমি ত্যাগ করার সময় এসেছে। এখানে উল্লেখ্য ফ্রেডরিকের ভাইঝি রাজকুমারীর শিক্ষক হওয়ার প্রস্তাব এসেছিল অয়লারের কাছে। সেই রাজকুমারীকে প্রায় ২০০টি চিঠি লিখেছিলেন তিনি। পদার্থবিদ্যা এবং গণিত বিষয়ে বিভিন্ন আলোচনা রয়েছে এই চিঠির সংকলনটিতে।

১৭৬০ সালে যুদ্ধের সময় রাশিয়ান সেনা অয়লারের খামার লুট করলে সম্রাজ্ঞী এলিজাবেথ ক্ষতিপূরণবাবদ ৪০০০ রুবেল দান করেছিলেন অয়লারকে। ১৭৬৬ সালে অয়লার বার্লিন ছেড়ে সেন্ট পিটার্সবার্গের একাডেমিতে ফিরে আসেন এবং সেবছরই পদার্থবিদ্যার চেয়ারে নিযুক্ত হন তিনি। ১৭৬৯ সালে এর সচিবও হয়েছিলেন। বার্লিনে থাকার সময়ও তিনি পিটার্সবার্গের একাডেমির সঙ্গে দারুণ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন এবং রাশিয়ায় ১০৯টি গবেষণাপত্রও প্রকাশ করেছিলেন৷ রাশিয়ায় ফেরার পরপরই প্রচন্ড অসুস্থতা ভোগ করেন এবং দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে পড়েন তিনি। ১৭৭১ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গের বাড়িতে একটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে এবং বাড়ির অধিকাংশ তো বটেই সেইসঙ্গে লাইব্রেরিও নষ্ট হয়ে গিয়েছিল তাতে। এই অগ্নিকান্ডের পরেই ১৭৭১ সালেই একটি ছানি অপারেশনের ফলে তাঁর দৃষ্টিশক্তি স্বল্প পরিমাণ ফিরে এলেও নিজের প্রয়োজনীয় যত্নের অভাবে সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যান তিনি। ১৭৭২ সালে চাঁদের গতির ওপর সাতশো পঁচাত্তর পৃষ্ঠার এক দীর্ঘ গবেষণা করেছিলেন তিনজনের সহায়তায়। ১৭৭৩ সালে চল্লিশ বছর বয়সে অয়লারের স্ত্রী মারা গেলে, তার তিনবছর পরে স্ত্রীয়ের সৎ বোন সালোমে অ্যাবিগেল গেসেলকে বিয়ে করেছিলেন অয়লার। ১৭৭৫ সালে তিনি প্রতি সপ্তাহে একটি করে গবেষণামূলক গাণিতিক পেপার তৈরি করতেন। তাঁর মানসিক গণনার দক্ষতা ছিল প্রখর। স্মৃতিশক্তি এতটাই ভালো ছিল যে, ভার্জিলের এনিড হুবহু আবৃত্তি করতে পারতেন।

লিওনার্ড অয়লারের সারাজীবনের কাজগুলিকে একত্র করলে প্রায় ৯০০টির মতো গ্রন্থ হতে পারে। একাধিক গুরুত্বপূর্ণ গাণিতিক সমস্যার সমাধান এবং গবেষণার পাশাপাশি তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদানের মধ্যে পড়ে, গাণিতিক বিভিন্ন চিহ্ন নির্মাণ। যেমন একটি বৃত্তের পরিধি এবং তার ব্যাসের অনুপাত বোঝাতে ব্যবহৃত ছোট হাতের পাই (π), যোগফল প্রকাশের জন্য গ্রীক অক্ষর ক্যাপিটাল সিগমা, সীমিত পার্থক্যের জন্য বড় হাতের ডেল্টা ইত্যাদি চিহ্নের ব্যবহার চালু করেছিলেন অয়লার। এছাড়াও ত্রিকোনমিতি, বীজগণিত, চন্দ্রতত্ত্ব বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। ১৭৫৭ সালে তিনি তরল গতিবিদ্যায় অদৃশ্য প্রবাহের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সমীকরণ প্রকাশ করেন , যেগুলো এখন অয়লার সমীকরণ নামে পরিচিত। সঙ্গীতে গাণিতিক ধারণার প্রয়োগ বিষয়ে আলোচনা করে লেখেন টেনটামেন নোভা থিওরিয়া মিউজিক। এমনই আরও নানান গবেষণায় তিনি সমৃদ্ধ করেছিলেন বিজ্ঞানের ভান্ডার।

১৭৮৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর মধ্যাহ্নভোজের পর ইউরেনাসের কক্ষপথ নিয়ে এক আত্মীয়ের সঙ্গে আলোচনা করাকালীন মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ফলে রাত এগারোটার দিকে ৭৬ বছর বয়সে লিওনার্ড অয়লারের মৃত্যু হয়।

2 comments

আপনার মতামত জানান