ভারতের স্বাধীনতা একদিনে আসেনি। বহু শহীদের বহু আত্মত্যাগের ফলে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পরে বহুকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা লাভ করেও ভারতবর্ষ আর এই স্বাধীনতার যজ্ঞে যে সকল বীর বিপ্লবী আত্মাহুতি দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে মদনলাল ধিংরা (Madan Lal Dhingra) এক অন্যতম নাম। ইংল্যাণ্ডে পড়াকালীন ভারতীয় আর্মি অফিসার উইলিয়াম হাট কার্জন উইলিকে হত্যার জন্য তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়। সেসময় লণ্ডনে তৈরি হয়েছে ‘ইণ্ডিয়া হাউস’ যেখানে সমস্ত ভারতীয় স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতেন আর সেখানেই বিনায়ক দামোদর সাভারকরের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে মদন ধিংরার। সাভারকরের ক্ষুরধার বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেন মদনলাল ধিংরা। জীবনের শেষ দিনে ফাঁসির ঠিক আগে ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনিতে ভারতমাতার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছিলেন তিনি। প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবী শ্যামজি কৃষ্ণবর্মা, বীর সাভারকর, মাদাম ভিকাজি কামা, ব্যারিস্টার সর্দার সিং রানা, বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখদের নামের পাশে আজও অক্ষয় হয়ে আছে মদনলাল ধিংরার নাম।
১৮৮৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর পাঞ্জাবের অমৃতসরে এক শিক্ষিত, অভিজাত পরিবারে মদনলাল ধিংরার জন্ম হয়। তাঁর বাবা ড. গিত্তামল ধিংরা একজন সিভিল সার্জেন এবং চক্ষুবিশেষজ্ঞ ছিলেন। অনেকে বলেন তিনিই ছিলেন পরাধীন ভারতের এমন এক ডাক্তার যিনি দক্ষতা ও পদোন্নতির শীর্ষে পৌঁছেছিলেন। তাঁর সাত সন্তানের মধ্যে মদনলাল ছিলেন ষষ্ঠ সন্তান। মদনলালের দুই ভাই পরবর্তীকালে ডাক্তার হন যাদের মধ্যে একজন ছিলেন এমআরসিপি (MRCP) আর অন্য দুই ভাই আবার ব্যারিস্টার হন পরবর্তীকালে। মদনলাল এবং তাঁর ভাইয়েরা সকলেই বিদেশে শিক্ষিত হয়েছেন।
১৯০০ সাল পর্যন্ত মদনলাল ধিংরা অমৃতসরের এমবি ইন্টারমিডিয়েট কলেজে পড়াশোনা করেন এবং তারপর তিনি লাহোরে গভর্নমেন্ট কলেজ ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। সেখানে পড়াশোনা শেষ করে লণ্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজ থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে ডিপ্লোমা অর্জন করেন মদনলাল ধিংরা। এই সময়েই দাদাভাই নওরোজির লেখা ‘পভার্টি অফ ইণ্ডিয়া’ বইটি পড়ে বিস্মিত হন তিনি এবং বুঝতে পারেন কীভাবে ভারতের সম্পদ লুণ্ঠিত হয়েছে, ভারতে নেমে এসেছে দূর্ভিক্ষের করালছায়া আর তাই তৎকালীন স্বরাজ আন্দোলন বা স্বদেশি আন্দোলনকে সমর্থন করেন তিনি। তিনি বেশ বুঝতে পারছিলেন শিল্প ও বাণিজ্য কাঠামো এমনভাবে তৈরি করেছে ব্রিটিশ সরকার যাতে দেশীয় শিল্পগুলি সব নষ্ট হয়ে যায়। ১৯০৪ সালে এম.এ পড়াকালীন ব্রিটেন থেকে আমদানি করা কাপড়ে কলেজের ব্লেজার তৈরি করে তা পড়তে হবে বলে নির্দেশ দিয়েছিলেন তাঁর কলেজের অধ্যক্ষ আর ধিংরা সেই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সকল ছাত্রদের একজোট করে প্রতিবাদে নামেন। আর সেই কারণে তাঁকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করে দেওয়া হয়। তাঁর বাবা অধ্যক্ষের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে বলেন এবং পুনরায় এইরকম কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকতে নিষেধ করেন। কিন্তু বাবার কথাও সেদিন মানেননি ধিংরা।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে সিমলা পাহাড়ের পাদদেশে কালকায় একটি সংস্থায় কেরানির কাজ নেন। বলাই বাহুল্য এটাই তাঁর কর্মজীবনে প্রবেশের প্রাথমিক অধ্যায় ছিল। ঐ সংস্থাটি ছিল মূলত টাঙ্গাগাড়ি পরিবহনের যারা সিমলায় ঘুরতে আসা ব্রিটিশ পরিবারকে পাহাড়ে চড়তে সাহায্য করতো। এই সংস্থা থেকেও বিতাড়িত হয়ে কারখানার শ্রমিকের কাজ করতে শুরু করেন মদনলাল ধিংরা। এখানে শ্রমিকদের একজোট করে একটি ইউনিয়ন গঠনের চেষ্টা করলে কারখানা থেকে এবারেও তাঁকে বিতাড়িত করা হয়। এরপর বম্বেতেও কিছুদিন কাজ করেন তিনি। এই সমস্ত কর্মকাণ্ড দেখে অত্যন্ত বিচলিত হয়ে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে দাদা বিহারিলাল ধিংরা অনেকবার বোঝান তাঁকে। অবশেষে ব্রিটেনে গিয়ে উচ্চশিক্ষা সম্পূর্ণ করতে সম্মত হন মদনলাল ধিংরা। ১৯০৬ থেকে ১৯০৯ সাল পর্যন্ত ইউনিভার্সিটি কলেজে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়াশোনা করেন তিনি। পড়াশোনার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করেছিলেন তাঁর দাদাই। মনে রাখতে হবে এই কলেজেই কিন্তু ১৮৫৬ থেকে ১৮৬৬ পর্যন্ত দাদাভাই নওরোজি গুজরাটি ভাষার অধ্যাপক ছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথও এখানে বেশ কিছুদিন ব্যারিস্টারি পড়েছিলেন।
তাঁর লণ্ডনে আসার এক বছর আগেই ১৯০৫ সালে শ্যামাজি কৃষ্ণবর্মা স্থাপন করেছিলেন ‘ইণ্ডিয়া হাউস’। এই বাড়িটি ছিল আসলে লণ্ডনবাসী সমস্ত ভারতীয় বিপ্লবীদের মিলনক্ষেত্র। এখানেই ধিংরার সঙ্গে পরিচয় ঘটে বিনায়ক দামোদর সাভারকর এবং শ্যামাজি কৃষ্ণবর্মার। উভয়েই ধিংরার প্রবল জাতীয়তাবোধ এবং দেশের জন্য ভালোবাসা দেখে তাঁকে স্বাধীনতা আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেন। সাভারকর কখনোই ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের মতো আবেদন-নিবেদন নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না, বরং তিনি সক্রিয় আন্দোলনেই বিশ্বাসী ছিলেন। সেই মতো ধিংরাকেও তিনি ব্রিটিশ হত্যার পরিকল্পনায় উদ্বুদ্ধ করে তোলেন। পরবর্তীকালে ইণ্ডিয়া হাউস থেকে সরে এসে টোটেনহাম কোর্ট রোডে একটি শ্যুটিং রেঞ্জে সাভারকরের প্রতিষ্ঠিত গুপ্ত সমিতি ‘অভিনব ভারত মণ্ডল’-এর সদস্যপদ গ্রহণ করেন মদনলাল ধিংরা। ঠিক এই সময় ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনাকে কেন্দ্র করে ধিংরা, সাভারকর এবং আরো অন্যান্য ছাত্র-বিপ্লবীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। রাজনৈতিক সক্রিয় কর্মকাণ্ডের জন্য তাঁর বাবা ধিংরাকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করেন এমনকি তাঁর এই সিদ্ধান্তের কথা সংবাদপত্রে প্রকাশের ব্যবস্থাও করেন। প্রথমে ভারতের ভাইসরয় জর্জ কার্জনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন ধিংরা এবং তাতে ব্যর্থ হন। তারপর তৎকালীন বাংলার প্রাক্তন গভর্নর ব্যামফিল্ড ফুলারকে হত্যার চেষ্টা করলে তাও পরিকল্পনার অভাবে সফল হয় না। অবশেষে কার্জন উইলিকে হত্যার পরিকল্পনা করেন মদনলাল ধিংরা। ১৮৬৬ সালে কার্জন উইলি তখন সদ্য ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন এবং ১৮৭৯ সালে তিনি ভারতীয় রাজনৈতিক বিভাগে যোগ দেন। মধ্য ভারত এবং রাজপুতানা অঞ্চলের বেশ কিছু জায়গায় কাজের সুবাদে তিনি চাকরিতে উচ্চপদে আসীন হন। ১৯০১ সালে সেক্রেটারি অফ স্টেট ফর ইণ্ডিয়ার রাজনৈতিক এইড-ডি-ক্যাম্প পদে উত্তীর্ণ হন। সাভারকর এবং তাঁর গুপ্ত বিপ্লবী সমিতি সম্পর্কে তিনি অনুসন্ধান চালাচ্ছিলেন। জানা যায় ধিংরার বাবার বেশ ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন কার্জন উইলি। ১৯০৯ সালের ১ জুলাই ইম্পেরিয়াল ইন্সটিটিউটে ‘অ্যাট হোম’ নামের একটি সমাবেশ আয়োজন করেন ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন। সেখানে কার্জন উইলি যখন তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে হল ছেড়ে বেরোচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময় তাঁর মাথা লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়েন ধিংরা। ঘটনাস্থলে লালকাকা নামের এক পারসি ডাক্তার এসে কার্জনকে বাঁচাতে চাইলে তিনি আরো দুটি গুলি করে তাঁকেও মেরে ফেলেন। সেই মুহূর্তেই আত্মহত্যার চেষ্টা করেন মদনলাল ধিংরা কিন্তু তাঁর সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। অবশেষে ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ধরা পড়লে ২৩ জুলাই ওল্ড বেইলি আদালতে তাঁর বিচারসভা বসে। বিচার চলাকালীন কোনো উকিলের সাহায্য না নিয়ে নিজেই নিজের প্রতিনিধিত্ব করেন ধিংরা এবং আদালতের সামনে তিনি স্বীকার করেন যে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অঙ্গ হিসেবে তিনি এই হত্যা করেছেন। তিনি এও জানান যে লালকাকাকে হত্যার উদ্দেশ্য ছিল না তাঁর। অবশেষে বিচারে মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয়। ফাঁসির দণ্ডাদেশ পেয়ে আদালতের সামনে দাঁরিয়ে বিচারককে তিনি বলেছিলেন এই মৃত্যদণ্ড তিনি মাথা পেতে স্বীকার করেন এবং মাতৃভূমির জন্য আত্মবলিদান দিতে পেরে তিনি গর্বিত। মৃত্যুর আগে তিনি বলেছিলেন যে তিনি যেন পুনরায় একই মায়ের কোলে জন্ম নিয়ে আবারো দেশের জন্য মরতে পারেন এবং দরিদ্র ঘরের সন্তানের পক্ষে এই আত্মবলিদান ছাড়া হয়তো তাঁর আর কিছুই দেওয়ার ছিল না তাঁর ভারতমাতাকে। শেষে ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনিতে মৃত্যুর আগে বলা তাঁর শেষ কথাটি সমাপ্ত হয়। তাঁর এই আত্মবলিদান পরবর্তীকালে বহু আইরিশ বিপ্লবীকে অনুপ্রাণিত করেছিল আয়ারল্যাণ্ডকে স্বাধীন করার আন্দোলনে। যদিও মহাত্মা গান্ধী মদনলাল ধিংরার এই কাজকে একেবারেই সমর্থন করেননি।
মদনলাল ধিংরা এই বিপ্লবী কর্মকাণ্ডকে মনে রেখে ‘দ্য ইণ্ডিয়ান সোশিওলজিস্ট’ পত্রিকা ঐ বছরের আগস্ট মাসের সংখ্যাটিতে ধিংরাকে নিয়ে একটি লেখা প্রকাশ করে। এছাড়াও লণ্ডনের ‘দ্য টাইমস’ পত্রিকা দণ্ডাদেশের পরে ধিংরার বক্তব্য প্রকাশ করে ‘কনভিকশন অফ ধিংরা’ শিরোনামে। মৃত্যুর পরে তাঁর শবদেহ হিন্দুমতে সৎকার করা হয়নি কারণ তাঁর পরিবার তাঁকে ত্যাজ্য করেছিল আর অন্য কোনো ভারতীয়কে ব্রিটিশরা এই শবদেহ দিতে চায়নি। ফলে ব্রিটিশরা নিজ উদ্যোগে ধিংরার শবদেহকে সমাধিস্থ করে।
২০০১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘বীর সাভারকর’ নামের হিন্দি চলচ্চিত্রে মদনলাল ধিংরার চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায় পঙ্কজ বেরিকে।
১৯০৯ সালের ১৭ আগস্ট পেন্টনভিল জেলে ফাঁসি হয় মদনলাল ধিংরার।
স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জীবনের কথা আত্মত্যাগের কথা যেভাবে আপনারা প্রকাশ করছেন সেজন্য ধন্যবাদ। তুষার কান্তি ষন্নিগ্রহী।
স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জীবনের কথা জানানোর জন্য আপনাদের ধন্যবাদ। তুষার কান্তি ষন্নিগ্রহী।