ধোনি

মহেন্দ্র সিং ধোনি

ভারতের জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক এবং আইসিসি বিশ্বকাপ জয়ী জাতীয় দলের অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি(Mahendra Singh Dhoni) ভারতীয় ক্রিকেটের একটি উজ্জ্বল নাম।

১৯৮১ সালের ৭ জুলাই বিহারের রাঁচিতে মহেন্দ্র সিং ধোনির জন্ম হয়৷ তাঁদের পৈতৃক নিবাস ছিল উত্তরাখণ্ড রাজ্যের আলমোড়া জেলার লামগাড়া ব্লকের লাওলি গ্রামে। তাঁর বাবা পান সিং রাঁচির মেকন লিমিটেডে জুনিয়র ম্যানেজারের পদে চাকরি করতেন । তাঁর মায়ের নাম দেবকী দেবী৷

মহেন্দ্র সিং ধোনির প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয়েছিল ডিএভি জওহর বিদ্যা মন্দির থেকে৷ পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি ব্যাডমিন্টন এবং ফুটবল খেলতে ভালোবাসতেন৷ ফুটবল দলে তিনি গোলরক্ষকের ভূমিকায় খেলতেন ৷ ধোনির ফুটবল টিমের কোচ তাঁকে ফুটবল বাদ দিয়ে ক্রিকেট খেলার পরামর্শ দেন এবং তাঁকে কমান্ডো ক্রিকেট ক্লাবে উইকেট কিপার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন ৷ ১৯৯৭-৯৮ এর মরসুমে বিনু মাকঁড় ট্রফির অনুর্ধ্ব ষোলো চ্যাম্পিয়নশিপে ধোনিকে নির্বাচিত করা হয় এবং তিনি সেখানে অসাধারণ ব্যাটিং করেছিলেন। দশম শ্রেণী পাশ করার পর ক্রিকেট খেলায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন ধোনি।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

মহেন্দ্র সিং ধোনি ক্রিকেট খেলার সূত্রে ২০০১ সালে খড়গপুর রেলস্টেশনে ট্র্যাভেলিং টিকিট পরীক্ষক (টিটিই) হিসেবে নিযুক্ত হন৷ ২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি এই চাকরি করেছিলেন।

১৯৯৮ সালে দেবল সহায়( বিহার ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের প্রাক্তন ভাইস-প্রেসিডেন্ট এবং সেই সময় রাঁচি জেলা ক্রিকেট সভাপতি) ধোনিকে সেন্ট্রাল কোল ফিল্ডস লিমিটেড (Central Coal Fields Limited ) দলের হয়ে খেলায় নির্বাচিত করেছিলেন। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত স্কুলে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়া ধোনি কেবল স্কুল ক্রিকেট এবং ক্লাব ক্রিকেট খেলতেন। সেন্ট্রাল কোল ফিল্ডসের হয়ে তিনি প্রথমে ব্যাট করার সুযোগ প্রথম পান এবং সেই সুযোগে তিনি সেঞ্চুরি করেছিলেন। দেবল সহায় তাঁর খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে বিহার ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনে কথা বলেন এবং বিহার দলে ধোনিকে নির্বাচন করার জন্য চাপ দেন৷ ধোনিকে রাঁচি দল, জুনিয়র বিহার ক্রিকেট দল এবং শেষ পর্যন্ত সিনিয়র বিহার রঞ্জি দলে ধোনিকে জায়গা করে দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। ধোনিকে ১৯৯৮-৯৯ মরসুমে বিহার অনূর্ধ্ব -১৯ এর দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেখানে ধোনি ভালো রান করেন। ১৯৯৯-২০০০ সাল নাগাদ ধোনি বিহারের হয়ে রঞ্জি ট্রফি খেলে পেশাদার ক্রিকেট জগতে অভিষেক করেন। অভিষেক ম্যাচে আসাম ক্রিকেট দলের বিপক্ষে দ্বিতীয় ইনিংসে ৬৮ রান করেন৷ পাঁচ ম্যাচে তিনি ২৮৩ রান করেছিলেন৷

২০০৩-২০০৪ মরসুমে জিম্বাবোয়ে এবং কেনিয়া সফরে ওয়ানডে ম্যাচে তিনি উইকেট কিপার হিসেবে খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। জিম্বাবোয়ের হয়ে খেলার সময় তিনি ৭ টি ক্যাচ এবং ৪ টি স্টাম্পিং করেছিলেন৷ এরপর কেনিয়া, ভারত -এ এবং পাকিস্তান-এ দল নিয়ে ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টে ধোনি ভারতকে পাকিস্তানের বিপক্ষে ২২৩ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে গিয়ে অর্ধশতক করেন৷ একজন উইকেট কিপার এবং ব্যটসম্যান হিসেবে তাঁর খেলা তৎকালীন ভারতীয় ক্রিকেটের অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলীর দৃষ্টি আকর্ষন করেছিল৷ আন্তর্জাতিক ভারতীয় ক্রিকেটে ধোনি জায়গা করে নেওয়ার পর ২০০৪-২০০৫ সালে বাংলাদেশ সফরে ওয়ান ডে ম্যাচে তিনি শূন্য রানে আউট হয়ে যান৷ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর খেলোয়াড় জীবনের শুরু খুব একটা ভালো ছিল না৷ তবুও তাঁর জেদ এবং পরিশ্রম তাঁকে সাফল্যের সিঁড়ি দেখিয়ে দিয়েছিল৷

একদিনের ক্রিকেট দলে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং তারপর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৭ ম্যাচের সিরিজে সহ-অধিনায়ক হিসেবে মনোনীত হন ধোনি। একদিনের ক্রিকেটের একটি ইনিংসে ৫ টি ক্যাচ এবং ১টি করে ২ সেপ্টেম্বর, ২০০৭ সালে মহেন্দ্র সিং ধোনি তাঁর অন্যতম প্রিয় খেলোয়াড় অ্যাডাম গিলক্রিস্টের আন্তর্জাতিক রেকর্ড ভেঙ্গে নতুন রেকর্ড গড়েন।। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ট্রাভিস ডাউলিনকে বোল্ড করে ২০০৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ধোনি প্রথমবারের মতো বোলার হিসেবে উইকেট লাভ করেন। ২০০৯ সালে মাত্র ২৪ ম্যাচে ৭০.৪৩ গড় রান সহ ১১৯৮ রান করে তাঁর সফলতম বছর পার করেন। ঐ বছর অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক রিকি পন্টিংয়ের সাথে যৌথভাবে সর্বোচ্চ রান করেছিলেন ধোনি।

২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকাতে অনুষ্ঠিত আইসিসি ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টির জন্য ধোনিকে ভারতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে মনোনীত করা হয়েছিল এবং তাঁর নেতৃত্বে ভারতীয় দল দ্বিতীয়বারের মত বিশ্বকাপ ছ্যাম্পিয়ন হয়৷ ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সাত ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের জন্য তিনি ভারতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে নির্বাচিত হন। এরপর ২০০৮ সালের নভেম্বরে নাগপুরে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে চতুর্থ ও শেষ টেস্ট চলাকালীন ভারতের পূর্ণকালীন টেস্ট অধিনায়ক হিসাবে ধোনির অভিষেক ঘটে। ধোনি দুটি বিশ্বকাপে ভারতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর অধিনায়কত্বে ভারত ২০১১ সালে বিশ্বকাপ জিতেছিল এবং ২০১৫ সালে সেমিফাইনালে উঠেছিল।

ধোনির নেতৃত্বে ২০১১ বিশ্বকাপে ভারত জিতেছিল। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ফাইনালে ২৭৫ সালে তাড়া করে ধোনি ব্যাটিং অর্ডারে নিজেকে ওপরে তুলে এনেছিলেন। একটি দুর্দান্ত ছয় মেরে তিনি ভারতকে বিশ্বজয়ী করেন।

মহেন্দ্র সিং ধোনির সবথেকে উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের মধ্যে পড়ে তাঁর অধিনায়কত্ব। ২০০৯ সালে ভারত প্রথমবারের মতো টেস্ট ক্রিকেট র‌্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে উঠে ছিল। মহেন্দ্র সিং ধোনি প্রথম ভারতীয় উইকেট কিপার যিনি টেস্ট ক্রিকেটে ব্যক্তিগত চারহাজার রান সম্পূর্ণ করেছিলেন। আবার চেন্নাইয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ধোনির করা ২২৪ রান এখনও পযন্ত যেকোন ভারতীয় অধিনায়কের করা তৃতীয় সর্বোচ্চ স্কোর। ফয়সালাবাদে পাকিস্তানের বিপক্ষে ধোনির প্রথম সেঞ্চুরিটি (১৪৮) ছিল কোনও ভারতীয় উইকেট কিপার হিসেবে দ্রুততম সেঞ্চুরি। ধোনি অধিনায়ক হিসাবে ৫০ টি ছয় মেরেছিলেন যেটি একটি ভারতীয় রেকর্ড।

ওয়ান ডে ক্রিকেটে ধোনি তৃতীয় ভারতীয় অধিনায়ক হিসেবে একশ’টি ম্যাচে জয়ের রেকর্ড করেছেন৷ ওয়ান ডে ম্যাচে দশহাজার রান সম্পূর্ণকারী চতুর্থ ভারতীয় এবং দ্বিতীয় উইকেট কিপার তিনি। তাঁর ক্রিকেট জীবনের বেশীরভাগ সময় তিনি ছয় নম্বর স্থানে খেলেছেন। ধোনি প্রথম ভারতীয় ক্রিকেটার এবং বিশ্বের নিরিখে পঞ্চম ক্রিকেটার যিনি ওয়ান ডে ম্যাচে দুশোটি ছয় মেরেছেন। তাঁর ওয়ান-ডে ক্রিকেট জীবনে ধোনি উইকেটরক্ষক হিসেবে ১০০ টি স্টাম্পিং করেছেন । ভারতীয় ক্রিকেটার হিসেবে প্রথম এবং বিশ্ব ক্রিকেটে ধোনি চতুর্থ স্থানে থাকা উইকেট রক্ষক যিনি ৩০০ টি ওয়ানডে ক্যাচ নিয়েছেন৷

টি২০ ম্যাচে তাঁর অধিনায়কত্বে সব থেকে বেশী ম্যাচ ভারত জিতেছে৷ ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক হিসেবে তিনি সব থেকে বেশী ম্যাচ খেলেছেন৷ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে ধোনির নেতৃত্বে ২০১০, ২০১১ এবং ২০১৮ সালে চেন্নাই সুপার কিংস জয়লাভ করে।

নিজস্ব ক্রিকেট খেলা ছাড়া মহেন্দ্র সিং ধোনি রাঁচির হকি টিমের সহ-মালিক। এছাড়া ইন্ডিয়ান সুপার লিগের ফ্র্যাঞ্চাইজি চেন্নাই ভিত্তিক ফুটবল ক্লাব চেন্নাইয়াইন এফসি- টিমের অভিষেক বচ্চন এবং ভিটা দানির সাথে ধোনিও সহ-মালিকের ভূমিকায় রয়েছেন৷

২০০৫ সাল থেকে গেমপ্ল্যান স্পোর্টস্‌ কোম্পানীর সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ রয়েছেন ধোনি। বর্তমানে ধোনি ২০টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিজ্ঞাপন করছেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- পেপসিকো, রিবক, এক্সাইড, টিভিএস মোটর্স, মহিশুর স্যাণ্ডেল সোপ, ভিডিওকোন, রিলায়েন্স কমিউনিকেশন্স, রিলায়েন্স এনার্জি, অরিয়েন্ট পিএসপিও ফ্যান, ভারত পেট্রোলিয়াম, টাইটান সোনাটা, ব্রেলক্রিম। তাঁর জীবনের উপর ভিত্তি করে M.S. Dhoni: The Untold Story নামে চলচ্চিত্র তৈরি করা হয়েছে৷

২০১৮ সালে ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কার পদ্মভূষণে মহেন্দ্র সিং ধোনি কে সম্মানিত করা হয়েছে৷ ২০০৯ সালে তিনি পেয়েছেন পদ্মশ্রী এবং ২০০৭-২০০৮ সালে তিনি রাজীবগান্ধী খেলরত্ন পুরস্কার পান৷ ২০০৮ এবং ২০০৯ সালে তিনি ICC ODI Player of the Year হয়েছিলেন৷ ২০০৬ সালে এম.টিভি তাঁকে যুব আইকন হিসেবে ঘোষনা করে৷ ২০১১ সালে দে মনফোর্ট ইউনিভার্সিটি(De Montfort University) তাঁকে ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়েছে৷

2 comments

আপনার মতামত জানান