মাজদিয়া

মাজদিয়া

পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত নদীয়া জেলার কৃষ্ণগঞ্জ সম্প্রদায় উন্নয়ন ব্লকের অন্তর্গত একটি অন্যতম প্রসিদ্ধ ইতিহাস বিজড়িত জনপদ হল মাজদিয়া (Majdia)। এই জনপদ কৃষ্ণনগর সদর সাবডিভিশনের অন্তর্গত।

ভৌগোলিক অবস্থানের বিচারে মাজদিয়া ২৩.৪১০ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮.৭১০ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। হুগলি নদীর পূর্ব পাড়ে নদীবিধৌত সমভূমি অঞ্চল এই মাজদিয়া। যদিও আঞ্চলিকভাবে হুগলি নদী এখানে ভাগীরথী নামে পরিচিত। জলঙ্গী, চূর্ণি এবং ইছামতী নদী বয়ে গেছে এই জনপদের উপর দিয়ে। এই নদীগুলির কারণেই এই জনপদ খুবই বন্যাপ্রবণ, প্রায় বছরই অতিবৃষ্টিতে এখানে বন্যা হয়। ভাগীরথী এবং জলঙ্গী নদীর মধ্যবর্তী পলিগঠিত সমভূমি অঞ্চল ‘কালান্তর’ নামে পরিচিত।

মাজদিয়ার ইতিহাসের সবথেকে বড় একটি অংশ জুড়ে আছে শিবনিবাসকে কেন্দ্র করে। বর্গী আক্রমণের সময় এখানেই মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর রাজধানী স্থানান্তরিত করেছিলেন। অষ্টাদশ শতকে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রই এখানে শিবমন্দির স্থাপন করেন ‘শিবনিবাস’ নামে। ইতিহাসে জানা যায় নসরত খাঁ নামে এক দুর্ধর্ষ ডাকাতের বাস ছিল এই অঞ্চলে, তার নামেই এই অঞ্চল ‘নসরত খাঁর বেড়’ নামে পরিচিত ছিল। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র এই জায়গায় এসে নিজের সৈন্যশিবির গড়ে তোলেন এবং নসরত খাঁর অত্যাচার থেকে মানুষকে রক্ষা করেন। একদা চূর্ণি নদী ঘিরে রেখেছিল এই জনপদকে। এখানেই নতুন রাজধানীতে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র নিজের প্রাসাদ গড়ার পাশাপাশি ১০৮টি শিবমন্দিরও গড়ে তোলেন। এই জন্যেই এই অঞ্চলের নাম হয় শিবনিবাস। জনশ্রুতি রয়েছে যে, মাজদিয়ার গভীর অরণ্যে নসরত খাঁকে পরাস্ত করে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র যখন চূর্ণি নদীর জলে হাত-মুখ ধুচ্ছিলেন, সেই সময় একটি রুই মাছ তাঁর কাছে চলে আসে। এই দৃশ্য দেখে রাজার এক আত্মীয় বলেন, রাজভোগ্য বস্তু যখন না চাইতেই রাজার কাছে চলে এল, তখন এই স্থানই রাজার আবাস হিসেবে উপযুক্ত হবে। এখানে তাঁর প্রতিষ্ঠিত শিবমন্দিরের মাহাত্ম্যের জন্য একে কাশীর সমতুল বলে মনে করা হত। একসময় এখানেই জাঁকজমক সহকারে ভীম একদশী তিথিতে বিরাট মেলা বসত। ঐতিহাসিকদের মতে এই মেলা শুরু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় তিনশো বছর আগে। সেই সময় থেকেই নানাবিধ মনোহারী জিনিস, জামা-কাপড়, মিষ্টি, ঘড়ি, মাদুর, জুতো থেকে নলেন গুড় পর্যন্ত পাওয়া যেত এখানে। এছাড়াও মাজদিয়ার শিবনিবাসে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র বিদ্যাচর্চার জন্য একটি টোল স্থাপন করেছিলেন, কিন্তু তার আর কোন চিহ্ন পাওয়া যায় না এখন। ১০৮টি শিবমন্দিরের মধ্যেও মাত্র পাঁচটি মন্দির আজও অক্ষত আছে।


সববাংলায় সাইটে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য আজই যোগাযোগ করুন
contact@sobbanglay.com


 

মাজদিয়াতে একমাত্র উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান হিসেবে মাজদিয়া কলেজ তথা সুধীরঞ্জন লাহিড়ী মহাবিদ্যালয় খুবই পরিচিত। এছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে এখানে রয়েছে মাজদিয়া রেল বাজার হাই স্কুল এবং শিবমোহিনী কন্যা বিদ্যাপীঠ। এছাড়াও মাজদিয়ায় বহু প্রাথমিক বিদ্যালয়ও রয়েছে।

মাজদিয়ায় প্রধান উৎসব বলতে শিবরাত্রি। শিবনিবাসের মন্দিরগুলিতে শিবরাত্রি উপলক্ষে বহু ভক্তের সমাগম হয়। এছাড়া সাধারণভাবে বারোয়ারি দুর্গাপূজার রীতিও এখানে প্রচলিত। মাজদিয়ার নাঘাটা পূর্বপাড়ার বারোয়ারি দুর্গাপূজা খুবই বিখ্যাত।

এই জনপদের প্রধান আকর্ষণ যদি বলতে হয় তাহলে প্রথমেই উঠে আসবে এখানকার সুবিখ্যাত নলেন গুড়ের কথা। সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে নদীয়ার মাজদিয়া সর্বশ্রেষ্ঠ মানের নলেন গুড় উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত এখানে নলেন গুড় তৈরি হয়। খেজুর গাছে হাঁড়ি বা কলসি বেঁধে জমানো খেজুর রসকে জ্বাল দিয়ে সুগন্ধি ও সুস্বাদু নলেন গুড় প্রস্তুত করা হয়। প্রায় ৫০০ থেকে ৭০০ জন চাষী এই নলেন গুড় উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত আছেন। গুড় তৈরির পর বিভিন্ন আকারের মাটির খুড়িতে সেই গুড় ভরে তা বিক্রির জন্য পাঠানো হয় বাজারে। বহু ব্যবসায়ী সরাসরি এসে চাষীদের থেকেই গুড় কিনে নেন। এমনকি মাজদিয়া থেকে পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও এই গুড় রপ্তানি হয়। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, এই কাজের গুরুত্ব এবং লোকবল কমে আসছে। একদিকে যেমন গাছের সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান, তেমনি দক্ষ চাষীও সেভাবে পাওয়া যায় না। মাজদিয়ার এই সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের ভবিষ্যৎ তাই অনিশ্চিত।

মাজদিয়ার দর্শনীয় স্থান বলতে একমাত্র শিবনিবাসের শিবমন্দিরগুলির কথাই বলতে হয়। প্রথম মন্দিরটির নাম রাজরাজেশ্বর মন্দির যাকে অনেকে ‘বুড়ো শিবমন্দির’ বলে থাকেন। গথিক রীতিতে নির্মিত এই মন্দির তৈরি হয়েছিল ১৭৫৪ সালে। উল্লেখযোগ্য আকর্ষণ এই যে, পূর্ব ভারতের সবথেকে বড়ো কষ্টিপাথরে নির্মিত শিবলিঙ্গটি রয়েছে এই মন্দিরেই। প্রায় ৯ ফুট উঁচু এখানকার শিবলিঙ্গটি। দ্বিতীয় মন্দিরটির নাম রাজ্ঞীশ্বর মন্দির। চারচালা বিশিষ্ট এই মন্দির নির্মিত হয়েছিল ১৭৬২ সালে। এছাড়াও এখানে একটি রাম-সীতার মন্দিরও আছে। অনেক স্থানীয় মানুষ মনে করেন বিশপ হেয়ার সাহেব নৌকা করে ঢাকা যাওয়ার সময় এই মন্দিরগুলি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন।

আজও মাজদিয়া রেলস্টেশনে নেমে কিছুটা এগিয়ে গেলেই রাস্তার দুই পাশেসার দিয়ে সাইকেল নিয়ে গুড় বিক্রেতাদের হাঁক-ডাক শোনা যায়। মাজদিয়ার বাতাসে যেন শুধু গুড় জ্বাল দেওয়ার গন্ধ ভুরভুর করে। সঙ্গে পড়ন্ত বিকেলে শিবনিবাসের ঘন্টাধ্বনি ভেসে আসে। তখন মনে হবে এর থেকে বড়ো স্বর্গসুখ হয়তো আর নেই।

আপনার মতামত জানান