ভারতীয় আইন ব্যবস্থার ইতিহাস পর্যালোচনা করতে বসলে এমন অনেক মামলার সন্ধান মিলবে, সংবিধানের ওপর যেগুলি সরাসরি প্রভাব বিস্তার করে তার ভিত্তি আরও সুদৃঢ় করেছে। এমন একটি মামলা হল মানেকা গান্ধী বনাম ভারত মামলা । এই মামলাটিকে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মামলাও বলা যেতে পারে। লোকসভার সদস্য, প্রাণী অধিকার কর্মী এবং পরিবেশবিদ মানেকা গান্ধীর পাসপোর্ট ১৯৭৬ সালের পাসপোর্ট আইন অনুযায়ী ইস্যু করা হলেও পরে একটি চিঠি পাঠিয়ে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস সেই পাসপোর্ট ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেয়। মানেকা এরূপ আচরণের কারণ জানতে চাইলে কর্মকর্তারা তাঁকে কোনোরকম কারণ জানাননি। এই আচরণে ক্ষুব্ধ মানেকা সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদের অধীনে সুপ্রিম কোর্টে একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন এবং তাঁর মৌলিক অধিকার বিনষ্ট হওয়ার অভিযোগ করেন। মৌলিক অধিকারের সীমানা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে আদালতে এবং সেই সংক্রান্ত আরও কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। এই মামলাতেই আদালত গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল নিয়ম প্রতিষ্ঠা করে ও অনুচ্ছেদ ২১-এর অধীনে বর্ণিত ব্যক্তিগত স্বাধীনতার পরিধি প্রসারিত করে।
সঞ্জয় গান্ধীর পত্নী, লোকসভার সদস্য এবং প্রাণী ও পরিবেশবিদ মানেকা গান্ধীর পাসপোর্টকে কেন্দ্র করেই এই মামলাটির সূত্রপাত হয়েছিল। ১৯৬৭ সালের পাসপোর্ট আইন অনুযায়ী ১৯৭৬ সালের ১ জুন মানেকা গান্ধীর পাসপোর্টটি ইস্যু করা হয়। কিন্তু বছরখানেক অতিক্রম করতেই ১৯৭৭ সালের ২ জুলাই নয়াদিল্লির আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস পাসপোর্ট আইন ১৯৬৭-এর ধারা ১০(৩)(সি) অনুযায়ী সেই পাসপোর্টটিকে সাতদিনের মধ্যে সমর্পণ করে দেওয়ার জন্য চিঠি পাঠায় মানেকাকে। মানেকা গান্ধী অবিলম্বে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসারের কাছে একটি চিঠি পাঠান যাতে অনুচ্ছেদ ১০(৫) অনুযায়ী এরূপ আদেশ করার কারণ সম্পর্কে জানতে চান তিনি। কিন্তু আঞ্চলিক পাসপোর্ট কর্মকর্তারা কোনো কারণই জানাননি তাঁকে। বিদেশ মন্ত্রক থেকে কেবল জানানো হয় যে ‘জনগণের স্বার্থে’ এই আদেশ করা হয়েছিল কিন্তু কারণটি স্পষ্ট করে বলা হয়নি। কর্তৃপক্ষের এমন আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে মানেকা ৩২ অনুচ্ছেদের অধীনে সুপ্রিম কোর্টে একটি রিট পিটিশন দায়ের করেছিলেন। এই স্বেচ্ছাচারী আদেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ১৪, ১৯ এবং ২১ ধারার অধীনে নিশ্চিত করা মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ করেন তিনি। শুরু হয় মানেকা গান্ধী বনাম ভারত মামলা ।
এই পিটিশনের ফলে আদালতের সামনে যে সমস্ত প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল সেগুলি হল – প্রথমত, সংবিধানের তৃতীয় অংশে বর্ণিত মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা নিরঙ্কুশ কিনা এবং এই মৌলিক অধিকারের সীমানা কতদূর বিস্তৃত। দ্বিতীয়ত, ২১ অনুচ্ছেদে বিদেশ ভ্রমণের অধিকার অন্তর্ভুক্ত কিনা। তৃতীয়ত, অনুচ্ছেদ ১৪, ১৯ এবং ২১-এ বর্ণিত অধিকারগুলি একে অপরের সঙ্গে যুক্ত কিনা। চতুর্থত, আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসারের আদেশ প্রাকৃতিক বিচারের নীতির পরিপন্থী কিনা এবং পাসপোর্ট আইন ১৯৬৭-এর ধারা ১০(৩)(সি) মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করে কিনা।
মানেকা গান্ধীর প্রথম অভিযোগ ছিল কর্তৃপক্ষের এরূপ স্বেচ্ছাচারী আদেশ ধারা ২১-এ বর্ণিত তাঁর ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকারের ওপর একটি আক্রমণ। এছাড়াও পূর্ববর্তী সতওয়ান্ত সিং সাহানি বনাম রামারত্নম মামলার প্রসঙ্গ টেনে এনে মানেকা বলেন যে এই মামলাটিতে সুপ্রিম কোর্ট বিদেশ ভ্রমণের অধিকারকে ২১ অনুচ্ছেদের অন্তর্ভুক্ত বলে জানিয়েছিল। এছাড়াও তাঁর বিবৃতিতে বলা ছিল যে, পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করার জন্য পাসপোর্ট আইন দ্বারা নির্ধারিত কোনো পদ্ধতি নেই। আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কোন পদ্ধতি ছাড়া ২১ অনুচ্ছেদে বর্ণিত বিদেশ যাওয়ার অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না বলেও উল্লেখ করেন আবেদনকারী। তিনি আরও জানান যে পাসপোর্ট আইনের ধারা ১০(৩)(সি), সংবিধানে বর্ণিত অনুচ্ছেদ ১৪, ১৯(১)(এ) ও (জি) এবং ২১-এর অধীনে নিশ্চিত করা মৌলিক অধিকারগুলি লঙ্ঘন করে কারন এটি জীবন এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকারকে সীমাবদ্ধ করে রাখে। ১৪ ও ১৯ ধারার সঙ্গে ২১ ধারার পারস্পরিক সম্বন্ধের প্রশ্নটিও ওঠে এক্ষেত্রে। মানেকার অভিযোগের বিবৃতিতে ছিল, শোনার অধিকার (এক্ষেত্রে কারণ জানা বা শোনা) অর্থাৎ অডি অল্টারাম পার্টেম প্রাকৃতিক ন্যায়বিচারের নীতিগুলির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। প্রাকৃতিক ন্যায়বিচারের এই নীতিগুলি সংবিধানের কোনও বিধানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ না থাকলেও মৌলিক অধিকারের ধারণাটি এই নীতিগুলির মূল অংশকে মূর্ত করে। মানেকার বিবৃতিতে উল্লিখিত ছিল যে, ‘আইনের যথাযথ প্রক্রিয়া’ সম্পর্কে আমেরিকান ধারণা ভারত গ্রহণ করেনি। তবে আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতিকে অবশ্যই ন্যায্য এবং নিরাপদ হতে হবে যাতে তা কোনোভাবেই স্বেচ্ছাচারী না হয়ে যায়।
মানেকা গান্ধীর উক্ত যুক্তিগুলির বিপক্ষে সরকার পক্ষের আইনজীবীরাও পাল্টা কিছু প্রতিযুক্তি সাজাতে থাকেন। উত্তরদাতারা জানান, মানেকা গান্ধীকে পাসপোর্ট সমপর্ণ করতে বলা হয়েছিল কারণ তাঁকে শুনানির জন্য সেসময় সরকারী কমিটিতে উপস্থিত থাকতে হয়েছিল। উত্তরদাতারা এ.কে. গোপালন মামলার নীতির ওপর জোর দিয়ে বলেন যে, ২১ ধারায় ব্যবহৃত ‘আইন’ শব্দটিকে প্রাকৃতিক ন্যায়বিচারের মৌলিক মানদণ্ডের বিবেচনায় সংজ্ঞায়িত করা যায় না। এছাড়াও উত্তরদাতারা বলেন যে, ২১ অনুচ্ছেদে ‘আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি’, এরূপ একটি বাক্যাংশ রয়েছে এবং এই জাতীয় পদ্ধতি কেবল যুক্তিগ্রাহ্যতার পরীক্ষার ঊর্ধ্বেই নয় এই পদ্ধতির অনুচ্ছেদ ১৪ ও ১৯-এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ার প্রয়োজন নেই বলেও উল্লেখ আছে। তাঁরা বলেন, পাসপোর্ট আইন কোনোভাবেই মৌলিক অধিকারকে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়নি। এছাড়াও, জনস্বার্থে এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য কারোও পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করার জন্য সরকারকে তার কারণগুলি বলতে বাধ্য করা উচিত নয়। ভারতের অ্যাটর্নি জেনারেল যুক্তি দিয়েছিলেন যে, অনুচ্ছেদ ১৯(১)-এ বিদেশ ভ্রমণের অধিকার উল্লিখিত হয়নি, তাই সরকার যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তা যুক্তিযুক্ত।
এই ধরনের সওয়াল জবাব চলেছিল দীর্ঘদিন। অবশেষে সুপ্রিম কোর্ট দীর্ঘ শুনানির পর ১৯৭৮ সালের ২৫ জানুয়ারি মানেকা গান্ধী বনাম ভারত মামলার রায় ঘোষণা করেছিল। সাত বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে ছিলেন যথাক্রমে – এমএইচ বেগ (প্রধান বিচারপতি), ওয়াইভি চন্দ্রচূড়, ভিআর কৃষ্ণ আইয়ার, পিএন ভগবতী, এনএল উন্টওয়ালিয়া, এস. মুর্তজা ফজল আলী এবং পিএস কৈলাসম। অবশ্য বাকি সকলের রায়ের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন বিচারপতি কৈলাসম।
এখন ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে কোন কোন প্রসঙ্গ উঠে এসেছিল সেগুলি দেখে নেওয়া যাক। প্রথমত, আদালত কেন্দ্রীয় সরকারকে দোষারোপ করেছিল আবেদনকারীর কাছ থেকে পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করে রাখার কারণ ব্যাখা না করবার জন্য৷ আদালত আরও জানায় যে, এক্ষেত্রে আবেদনকারীর শোনার অধিকার অর্থাৎ অডি অল্টারাম পার্টেম লঙ্ঘিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল, পাসপোর্ট আইন, ১৯৬৭-এর ১০(৩) এর ধারা (সি) অনুযায়ী রাষ্ট্র জাতির সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতার স্বার্থে কিংবা নিরাপত্তা, বিদেশী দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বা জনগণের স্বার্থে যখন কোনো পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করবার সিদ্ধান্ত নেয় তখন কারণটির লিখিত রেকর্ড রাখতে হবে এবং সেই রেকর্ডের অনুলিপি পাসপোর্ট ধারকের কাছে সরবরাহ করতে হবে। মানেকা গান্ধীর ক্ষেত্রে যথাযথ কারণ দর্শানো হয়নি। আদালত জানিয়েছে পাসপোর্ট আইনের ধারা ১০(৩) অনুযায়ী পাসপোর্ট কর্তৃপক্ষের হাতে ক্ষমতা রয়েছে পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করার অতএব এটি অসাংবিধানিক নয়, তবে এক্ষেত্রে মানেকা গান্ধীকে শুনানির সুযোগ দেওয়া হয়নি এবং পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করার কোনো বৈধ কারণ যেহেতু জানানো হয়নি, এক্ষেত্রে এটি অপরাধের আওতাতেই পড়ে।
দ্বিতীয়ত, আদালত এ কে গোপালন মামলাটিকে বাতিল করে দিয়েছিল এবং সিদ্ধান্ত দিয়েছিল যে, ধারা ১৪, ১৯ এবং ২১-এর বিধানগুলির মধ্যে একটি পারস্পরিক বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। এই তিনটি ধারার মেলবন্ধনে আদালত ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল’ নিয়মের প্রতিষ্ঠা করে। বলা হয়, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতার প্রশ্ন উঠলে কোনো ব্যক্তিকে উক্ত তিনটি অনুচ্ছেদের সাংবিধানিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে যেমন, তেমন কোনো সরকারি পদক্ষেপ বা আইনকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করতে এই নিয়ম ব্যবহার করা আবশ্যক। আদালত জানায়, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা শব্দটিকে একটি সীমাবদ্ধ ও কঠোর অর্থে ব্যবহার করা উচিত নয়। এইভাবে ২১ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ব্যক্তিগত স্বাধীনতার পরিধির প্রসার ঘটায় সুপ্রিম কোর্ট। অন্যদিকে সতওয়ান্ত সিং মামলাকে গুরুত্ব দিয়ে আদালত জানায় যে, ২১ অনুচ্ছেদ বিদেশে যাওয়ার স্বাধীনতাকে নিশ্চয়তা প্রদান করে। আদালত জানায়, আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি ব্যতীত কোনো ব্যক্তিকে এই ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। যেহেতু রাষ্ট্র এই ধরনের ক্ষেত্রে কোনও ব্যক্তির অধিকার নিয়ন্ত্রণ বা নিষিদ্ধ করার বিষয়ে কোনও আইন তৈরি করেনি, তাই আবেদনকারীর পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করা ২১ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন। সুপ্রিম কোর্ট বলে যে, শুধুমাত্র রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ড তার অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকায় এর অর্থ এই নয় যে মৌলিক অধিকারগুলিও একইভাবে সীমাবদ্ধ। অবশেষে কোর্ট মানেকাকে তাঁর পাসপোর্ট ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল।
এই মামলার পর সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের সারমর্ম রক্ষা এবং সংবিধান প্রণয়নকারী সাংবিধানিক পরিষদের উদ্দেশ্য রক্ষার একরকম প্রহরী হয়ে ওঠে। ব্যক্তিগত স্বাধীনতার পরিসরকে বাড়ানো ছাড়াও বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার দিগন্তকে এমনভাবে প্রসারিত করেছে এই মামলাটি যে সেই অধিকারগুলি আর দেশের আঞ্চলিক সীমানা দ্বারা সীমাবদ্ধ নেই। সুপ্রিম কোর্টের এই সিদ্ধান্ত বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থাকে পুনরুদ্ধার করেছে এবং নিশ্চয়তা দিয়েছে যে তাদের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত হবে। অতএব বুঝতেই পারা যাচ্ছে যে, ভারতীয় বিচারালয়ের ইতিহাসে মানেকা গান্ধী মামলার গুরুত্ব কতখানি।
One comment