সমগ্র বিশ্বে লন টেনিস খেলার পাশাপাশি প্রায় একই ধরনের আরেক রকম টেনিস খেলা প্রচলিত যা টেবিল টেনিস নামে প্রচলিত। টেবিল টেনিস খেলা (Table Tennis) অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি খেলা। দুই বা চারজনের একেকটি দলের মধ্যে একটি বদ্ধ (indoor) পরিসরে এই খেলাটি অনুষ্ঠিত হয়। লন টেনিসের মাঠের বদলে এখানে খেলাটা হয় একটা টেবিলের উপর। একটি হালকা পিং পং বলের সাহায্যে এই খেলা হয় বলে একে অনেকে ‘পিং পং’ (Ping Pong) বা ‘হুইফ-হোয়াফ’ (Whiff-Waff) নামেও ডেকে থাকেন। এশিয়া মহাদেশে মূলত এই খেলা অত্যন্ত জনপ্রিয় হলেও বিশ্বের সব দেশেই এটি খেলা হয়ে থাকে। ১৯৮৮ সাল থেকে অলিম্পিকের ময়দানেও টেবিল টেনিস খেলার প্রচলন চলে আসছে।
ভিক্টোরিয়ান ইংল্যান্ডে টেবিল টেনিস খেলার জন্ম হয় এবং সেই সময় মূলত সমাজের উচ্চবিত্ত অভিজাত মানুষেরাই নৈশ আহারের পর বিভিন্ন পার্লারে এই খেলাটি খেলতেন। এরপরে ১৮৬০-৭০ সাল নাগাদ ব্রিটিশ মিলিটারি অফিসারেরা ভারতে এই খেলাটিকে এক নতুন রূপ দিতে থাকেন। একটি টেবিলের উপর মাঝ বরাবর এক সারি বই রেখে দেওয়া হত জাল হিসেবে আর অন্য দুটি বই দিয়ে র্যকেটের মত এই খেলাটি খেলা হত। সেই সময় পিংপং বলের বদলে গলফের বল ব্যবহার করা হত। ১৯০১ সালে ব্রিটিশ প্রস্তুতকারক জে. জ্যাকুইস অ্যান্ড সন্স লিমিটেড এই পিংপং নামটিকে জনপ্রিয় করে তোলে। এই কোম্পানিই প্রথম টেবিল টেনিস খেলার প্রয়োজনীয় সামগ্রী প্রস্তুত করে বাজারে আনে। পরবর্তীকালে এই কোম্পানি পিংপং নামের স্বত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পার্কার্স ব্রাদার্সের কাছে বিক্রি করে দেয়। ১৯২০ সাল নাগাদ পার্কার্স ব্রাদার্স এই পিংপং নামের বদলে টেবিল টেনিস নামটি চালু করে এবং সেই থেকেই এই নামটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ টেবিল-টেনিস খেলার একজন উদ্যোক্তা জেমস ডব্লিউ গিব ১৯০১ সাল নাগাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সফরকালে একটি সেলুলয়েড বল তৈরি করেন। ঐ বছরই ই. সি. গুড টেবিল টেনিস খেলার উপযোগী র্যাকেট নির্মাণ করেন কাঠের পাতের মধ্যে রাবার আটকে। ঐ সময় থেকেই ধীরে ধীরে বিভিন্ন জায়গায় টেবিল টেনিসের টুর্নামেন্ট আয়োজিত হতে শুরু করে। ১৯০২ সালে টেবিল টেনিস খেলার একটি অনানুষ্ঠানিক বিশ্ব টুর্নামেন্ট আয়োজিত হয়েছিল। সেই সময় লন টেনিসের মতোই টেবিল টেনিসেও স্কোরিং পদ্ধতি চালু ছিল। ১৯১০ সালের মধ্যেই ‘টেবিল টেনিস অ্যাসোসিয়েশন’ গড়ে ওঠে এবং ১৯২১ সালে আরেকটি নতুন টেবিল টেনিস অ্যাসোসিয়েশন গড়ে ওঠে। পরে ১৯২৬ সালে তার নাম হয় ইংলিশ টেবিল টেনিস অ্যাসোসিয়েশন, কিন্তু ঐ বছরই তা আবার ‘আন্তর্জাতিক টেবিল টেনিস অ্যাসোসিয়েশন’ নামে পরিচিত হয়। ১৯২৬ সালে বিশ্বের প্রথম আনুষ্ঠানিক টেবিল টেনিস টুর্নামেন্ট আয়োজন করে লন্ডন। ১৯৩৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব টেবিল টেনিস অ্যাসোসিয়েশন গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে সমগ্র বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়ছিল এই খেলাটি যদিও ১৯৩০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে কিছুদিনের জন্য খেলাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। পরবর্তীকালে ১৯৫০ সালে টেবিল টেনিসের র্যাকেটের মধ্যে একটা অতিরিক্ত স্পঞ্জের স্তর যোগ করা হল। এর ফলে খেলার মধ্যে একটা নতুন মাত্রা যোগ হল, বলে আঘাতের গতিও বাড়ল। ১৯৮০-এর দশকে পুনরায় গতি বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করা শুরু হল ‘স্পিড গ্লু’ (Speed Glue)। ১৯৮৮ সাল থেকেই প্রথম অলিম্পিকের ময়দানে টেবিল টেনিস খেলা জায়গা করে নিতে সক্ষম হল।
টেবিল টেনিস খেলার লক্ষ্য হল যে কোনও প্রকারে ১১ পয়েন্ট স্কোর করা। সমগ্র ম্যাচটি পাঁচ, সাত বা নয়টি গেমের সমন্বয়ে তৈরি হয়। এই খেলাটি একক বা দ্বৈত দুভাবেই খেলা যায়। একক টেবিল টেনিস খেলার ক্ষেত্রে প্রতি পক্ষে একজন করে খেলোয়াড় থাকেন এবং দ্বৈত খেলার ক্ষেত্রে প্রতি পক্ষে থাকেন দুজন করে খেলোয়াড়। টেবিল টেনিসের জন্য যে বল ব্যবহৃত হয় তার পরিধি ৪০ মিমি. এবং ওজন হয় ২.৭ গ্রাম। র্যাকেটগুলিকে ইউরোপীয় দেশগুলিতে ব্যাট বলা হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এগুলিকে ‘প্যাডল’ (Paddle) বলা হয়ে থাকে। র্যাকেটগুলির একদিকে লাল রঙ এবং অন্যদিকে কালো রঙ করা হয়ে থাকে। টেবিল টেনিসের টেবিলটি ২.৭৪ মিটার লম্বা, ৭৬ সেমি উঁচু এবং ১.৫২ মিটার চওড়া হয়ে থাকে। সাধারণভাবে নীল বা সবুজ রঙের এই টেবিলের মাঝ বরাবর ১৫.২৫ সেমি চওড়া একটি জাল লাগানো থাকে যা সমগ্র টেবিলটিকে দুটি অর্ধে বিভক্ত করে। বিপক্ষীয় খেলোয়াড়ের আঘাত করা বল যদি জালে স্পর্শ করে কিংবা টেবিলের লম্বা দিকে অথবা চওড়া দিকে ভ্রান্ত শট নেন কিংবা অন্য খেলোয়াড়ের মারা শট প্রতিহত করতে না পারেন, সেক্ষেত্রে বিপক্ষীয় খেলোয়াড় পয়েন্ট পান। কোনও খেলোয়াড় ঠিকঠাক সার্ভ করতে না পারলে বিপক্ষীয় খেলোয়াড় পয়েন্ট পান। বলকে ভলি (Volley) করা খেলায় অনুমোদিত নয় এবং একইভাবে বলে দুবার আঘাত করাও অনুমোদিত নয়। কোনও খেলোয়াড় বলে দুবার আঘাত করলে বিপক্ষীয় খেলোয়াড় পয়েন্ট পাবেন। টেবিল টেনিস খেলায় টেবিলের লম্বালম্বি বরাবর দাগগুলিকে ‘ইন’ হিসেবে ধরা হলেও, আড়াআড়ি অংশগুলি ‘ইন’ ধরা হয় না। তিন, চার বা পাঁচটি গেমে খেলা হয়। প্রতি গেমে জেতার জন্য ১১ পয়েন্ট স্কোর করতে হয়। এভাবে সর্বোচ্চ সংখ্যক গেম যে খেলোয়াড় জিততে পারেন, তাকেই খেলার বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। খেলার শুরুতে কে প্রথম সার্ভ করবেন তা নির্ধারিত হয় টসের মাধ্যমে। যে কোনও খেলোয়াড় পালাক্রমে দুবার সার্ভ করতে পারেন এবং এমনভাবে বলে আঘাত করতে হয় সার্ভের সময় যাতে তা সার্ভিস সাইডে একবার অন্তত বাউন্স করে এবং তারপরেই জাল টপকে বিপক্ষের কোর্টে যায়। যদি কোনও সময় দুজন খেলোয়াড়ের মধ্যে ১০-১০ পয়েন্টের সমতা দেখা দেয়, তখন আবার একবার করে প্রত্যেক খেলোয়াড় সার্ভ করেন এবং যে কোনও একজন খেলোয়াড় যদি ২ পয়েন্ট স্কোর করে ফেলেন, তবে তিনিই বিজয়ী ঘোষিত হন। ক্রিকেটে যেমন ওভার শেষ হলে ব্যাটসম্যান জায়গা বদল করেন, সেভাবেই প্রতিটি গেম শেষ হওয়ার পরে প্রতি পক্ষের টেনিস খেলোয়াড়েরা নিজেদের জায়গা বদল করেন।
২০০০ সালে সিডনি অলিম্পিকের পরে আন্তর্জাতিক টেবিল টেনিস ফেডারেশন খেলাটিকে দূরদর্শনের দর্শকদের জন্য উপভোগ্য করে তুলতে বেশ কিছু নিয়ম-কানুনে পরিবর্তন আনে। ২০০০ সালের অক্টোবর মাসেই বলের আকার ৩৫ মিমি. থেকে বাড়িয়ে ৪০ মিমি. করে দেওয়া হয়। এর ফলে বলের বায়ু-প্রতিরোধী ক্ষমতা বেড়ে যায় এবং খেলার গতি কমে যায়। সেই সময় খেলোয়াড়রা তাদের র্যাকেটের স্পঞ্জ স্তরটি আরও পুরু করার কারণে খেলার গতি এত বেড়ে গিয়েছিল যে তা টেলিভিশনের পর্দায় দেখা বা উপভোগ করা দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছিল। কয়েক মাস পরে খেলার ২১ পয়েন্ট স্কোরিং নীতি বদলে ১১ পয়েন্ট নীতি চালু করা হল। ২০০২ সালে খেলোয়াড়দের সার্ভিসিং-এরও কিছু নিয়ম-কানুন বদলানো হয়। সেই সময় নিয়ম করা হল যাতে বিপক্ষীয় খেলোয়াড় সার্ভিসিংটি বুঝতে পারে তার জন্য শূন্যে ন্যূনতম ১৬ সেন্টিমিটার লাফাতে হবে বলটিকে। ২০১৪ সালের জুলাই মাসের পর থেকে পিং-পং বলের উপাদানও বদলে দেওয়া হয়।
পূর্ব এশিয়া, ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টেবিল টেনিস খেলা অত্যন্ত জনপ্রিয়। সমগ্র বিশ্বে টেবিল টেনিসের সবথেকে বিখ্যাত প্রতিযোগিতাগুলির মধ্যে রয়েছে বিশ্ব টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপ, টেবিল টেনিস বিশ্বকাপ, অলিম্পিক এবং আইটিটিএফ ওয়ার্ল্ড ট্যুর। এছাড়াও ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ, এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ এবং সর্বোপরি এশিয়ান গেমস রয়েছেই। ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত পুরুষদের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ৬০ শতাংশ খেলায় জয়লাভ করেছে চিনা খেলোয়াড়েরা। টেবিল টেনিসের জগতে অস্ট্রিয়া, বেলারুস, জার্মানি, হংকং, পর্তুগাল, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, সুইডেন এবং তাইওয়ান খুবই উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। ১৯৯২ সালের অলিম্পিকে প্রথম সুইডেনের জ্যান ওভ ওয়াল্ডনার বিজয়ী হন এবং চিনের ডেং ইয়েপিং মহিলা হিসেবে প্রথম অলিম্পিক টেবিল টেনিস খেলোয়াড়ের সম্মান পান। তিনি মোট দুবার অলিম্পিকে জয়লাভ করেছিলেন।
ভারতেও টেবিল টেনিস একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় খেলা। ১৯৩৭ সালে কলকাতায় স্থাপিত হয়েছিল টেবিল টেনিস ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া। এই সংস্থা আন্তর্জাতিক টেবিল টেনিস ফেডারেশনের সক্রিয় সদস্য হিসেবে ভারতে টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতাগুলি নিয়ন্ত্রণ করে। গোথেনবার্গে আয়োজিত বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতীয় টেনিস খেলোয়াড়েরা দ্বাদশতম স্থান অধিকার করেছিল। ১৯৫২ সালে মুম্বাইতে আয়োজিত হয়েছিল বিশ্ব টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপ। সেটাই এশিয়ায় আয়োজিত প্রথম চ্যাম্পিয়নশিপ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু, গুজরাট এবং মহারাষ্ট্রে এই খেলা বেশ জনপ্রিয়। ২০১৯ সালে ভারতের পুরুষ টেবিল টেনিস দলটি দশম স্থান এবং মহিলা টেবিল টেনিস দলটি ২২তম স্থান অর্জন করে।