অর্জুনের বিয়ে

অর্জুনের বিয়ে

অর্জুনের বিয়ে অবশ্যই সাধারণ বিয়ে থেকে আলাদা। তার প্রথম স্ত্রী দ্রৌপদীকে বিয়ে করে আনার পর বাকি ভাইদের সাথেও দ্রৌপদীর বিয়ে দিতে হয়। কিন্তু দ্রৌপদীই অর্জুনের একমাত্র স্ত্রী ছিলেন না। এই তালিকায় আছে আরও তিনজনের নাম। তার মধ্যে সুভদ্রা তো সম্পর্কে অর্জুনের বোন। আর বাকি দুজন হলেন উলূপী এবং চিত্রাঙ্গদা যাদের সাথে অর্জুনের বিয়ে হয়েছিল যখন অর্জুন ব্রহ্মচর্য পালন করতে বারো বছর বনবাসে ছিলেন।

দ্রৌপদীর পিতা পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ চাইছিলেন তৃতীয় পাণ্ডব ধনুর্বীর অর্জুনের সঙ্গে দ্রৌপদীর বিয়ে দিতে। কিন্তু সেটি প্রকাশ না করে পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ একটি ধনু তৈরী করালেন যেটাতে অসাধারণ ধনুর্বীর না হলে কেউ গুণ পরাতে পারবেন না। তারপর মাটি থেকে অনেক উঁচুতে এমনভাবে একটি লক্ষ্য স্থাপন করলেন যে নিশানা বিদ্ধ করতে একটি ক্ষুদ্র ছিদ্রের মধ্য দিয়ে তীর ছুঁড়ে ঝুলন্ত মাছের চোখ ভেদ করতে হবে। তারপর ঘোষণা করলেন, যিনি ওই ধনুর্বাণ ব্যবহার করে লক্ষ্যভেদ করতে পারবেন তাঁকেই দ্রৌপদী বরমাল্য পরাবেন। অনেক রাজা এলেন, তাঁর মধ্যে দুর্যোধন, কর্ণ,জরাসন্ধ,শল্য প্রভৃতি রাজা ছিলেন। কিন্তু  কেউই ধনুতে গুণ পরাতে পারলেন না। তবে কর্ণ সহজেই ধনুতে গুণ পরিয়ে ফেললেন। কিন্তু দ্রৌপদী বেঁকে বসে জানালেন যে তিনি সূতজাতীয় কাউকে বিয়ে করবেন না। অপমানিত ও রাগান্বিত হয়ে কর্ণ স্বয়ম্বর সভা থেকে চলে গেলেন। এরপর আত্মগোপনে থাকা ব্রাহ্মণবেশী অর্জুন এলেন এবং তীর ছুঁড়ে সেই ঝুলন্ত মাছের চোখ ভেদ করে ফেললেন। আর দ্রৌপদী আনন্দচিত্তে সেই ব্রাহ্মণবেশী অর্জুনের গলায় বরমাল্য পরিয়ে দিলেন। ভীম ও অর্জুন দ্রৌপদীকে নিয়ে বাড়ি ফিরে মাতা কুন্তিকে বললেন, তাঁরা ভিক্ষা এনেছেন। কুন্তি ছিলেন ঘরের ভেতর। কি আনা হয়েছে না দেখেই বললেন, যা আনা হয়েছে সেটা পাঁচভাইকে মিলে ভোগ করতে। অর্জুন মায়ের আদেশ লঙ্ঘন করতে রাজি ছিলেন না। তখন পাণ্ডবরা স্থির করলেন দ্রৌপদী সবারই স্ত্রী হবেন।

দ্রৌপদীকে নিয়ে যাতে পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে ঝামেলা না হয় তাই নারদের পরামর্শে পঞ্চপাণ্ডব নিয়ম করেছিলেন দ্রৌপদী এক বছর এক এক পাণ্ডবের ঘরে থাকবেন। যদি দ্রৌপদী কোন একজনের সাথে থাকাকালীন অন্য পাণ্ডব তাঁদের ঘরে প্রবেশ করে তাহলে সেই পাণ্ডবকে বারো বছর ব্রহ্মচারী হয়ে বনবাসে যেতে হবে। নিয়ম করে সবই ঠিক চলছিল কিন্তু একদিন দুষ্টের দমনের জন্য অর্জুনকে তীর ধনুক আনতে যে ঘরে প্রবেশ করতে হল সেখানে ছিলেন যুধিষ্ঠির আর দ্রৌপদী। তার ফলে তাঁকে (অর্জুন) যেতে হল বারো বছরের বনবাসে।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

বনবাসে থাকার সময়ে অর্জুন একদিন যখন গঙ্গাতীরে গিয়েছিলেন, সেসময় অর্জুনের রূপে মুগ্ধ হয়ে নাগরাজের কন্যা উলূপী তাঁকে নিয়ে যান জলের গভীরে। সেই গভীরে নিয়ে যেতে যেতে তাঁকে প্রেমের প্রস্তাব দেন। কিন্তু অর্জুন তার ব্রহ্মচর্যের কথা বলেন। উলূপী জানান ওই নিয়ম দ্রৌপদীর জন্যই শুধু খাটবে। তখন অর্জুন তাঁকে বিয়ে করেন এবং বিয়ের  পরে একরাতের জন্য অর্জুনের স্ত্রী হন উলূপী। তাঁদের সন্তান ইরাবান।  সেই সন্তানকে নিয়ে উলূপী থেকে যান তাঁর নাগ-সাম্রাজ্যেই।

এরপর সেই ব্রহ্মচারীর ব্রতে  বনবাসে থাকাকালীনই অর্জুন আসেন সুদূর উত্তর পূর্বে মণিপুরে। সেখানে রাজা চিত্রবাহনের কন্যা চিত্রাঙ্গদাকে অর্জুনের পছন্দ হয়। তবে রাজা জানান তিনি (অর্জুন) তাঁর মেয়েকে বিয়ে করতেই পারেন।  কিন্তু বিবাহিতা স্ত্রীকে রেখে যেতে হবে মণিপুরেই।  কারণ বিয়ের পরে  চিত্রাঙ্গদার পুত্র সামলাবে মণিপুর রাজ্য। সেই শর্তে অর্জুন রাজি হয়ে যান এবং চিত্রাঙ্গদাকে বিয়ে করে তিন বছর মণিপুরেই থাকেন। তাঁদের একমাত্র সন্তান হলেন বভ্রূবাহন। এই পুত্রের হাতেই এক সময় অর্জুনের মৃত্যু হয়, আবার উলূপীর সাহায্যে বেঁচে ওঠেন।

আবার ফিরে আসা যাক অর্জুনের বিয়েতে। এ বার কৃষ্ণের বোন সুভদ্রা । কুন্তীর জন্মদাতা পিতা শূরের আরেক ছেলে হল বসুদেব, যিনি কৃষ্ণের পিতা। সেই অর্থে সুভদ্রা অর্জুনের বোন। কিন্তু  রৈবতক পাহাড়ে কৃষ্ণদের একটি উৎসবে অর্জুন সুভদ্রাকে দেখে তাঁর প্রেমে পরে যান। কিন্তু কি করবেন যখন বুঝে উঠতে পারছিলেন না তখন সাহায্যে এগিয়ে আসেন সুভদ্রার দাদা কৃষ্ণ। তাঁরই পরামর্শে ছদ্মবেশে সুভদ্রাকে হরণ করলেন অর্জুন।  ক্ষত্রিয়মতে এভাবে বিয়ে তো তখন সমাজের মান্যতা পেতই। কিন্তু অর্জুনের কাণ্ডে রেগে আগুন বলরাম। বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাঁকে শান্ত করেন কৃষ্ণ। ওদিকে আবার অন্য কাণ্ড। অপহৃতা সুভদ্রাকে তো নিয়ে গেলেন অর্জুন।  কিন্তু দ্রৌপদীর অনুমতি পাওয়া গেলে তবেই না নিজের ঘরে আসতে পারবেন। অর্জুন জানতেন দ্রৌপদীর অনুমতি এমনি এমনি পাওয়া যাবে না। তাই‚ সুভদ্রা গোয়ালিনীর সাজে গেলেন দ্রৌপদীর কাছে। তাঁর ব্যবহারে দ্রৌপদীর মন গলল । শ্রীকৃষ্ণের বোনকে নিজের সতীন হিসেবে মেনে নিতে আর অমত করলেন না দ্রৌপদী। সুভদ্রার গর্ভেই জন্ম নিয়েছিল অভিমন্যু।

তথ্যসূত্র


  1. "মহাভারত সারানুবাদ", দেবালয় লাইব্রেরী(প্রকাশক সৌরভ দে, তৃতীয় প্রকাশ) - রাজশেখর বসু, আদিপর্ব
  2. "কৃষ্ণা, কুন্তী ও কৌন্তেয়", আনন্দ পাবলিশার্স, নবম মুদ্রণ - নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

 

One comment

আপনার মতামত জানান