মেহের মুস (Meher Moos) হলেন প্রথম ভারতীয় মহিলা যিনি ১৮০ টি দেশ ভ্রমণের বিরল কৃতিত্বের অধিকারিণী।। প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে তিনি আন্টার্কটিকাও ভ্রমণ করেছেন। ১৮ টি পাসপোর্টের মালিক মেহের মুসকে ভালোবেসে অনেকে ‘ম্যাগেলান মুস’ নামেও ডাকেন। একজন বিমান সেবিকা থেকে সারা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের পর্যটক হয়ে ওঠা এই ভারতীয় নারীর জীবন রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ।
মেহের হিরোইস মুস-এর জন্ম এবং বড় হয়ে ওঠা মহারাষ্ট্রে। স্কুল জীবন কেটেছে পাঞ্চগানি অঞ্চলের সেন্ট জোসেফ কনভেন্ট স্কুলে। সোফিয়া কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করার পর বম্বে (বর্তমানে মুম্বাই) শহরের গভর্মেন্ট ল’ কলেজ থেকে ১৯৬৫ সালে এল. এল. বি পাশ করেন মেহের।
২১ বছর বয়সে তিনি বিমান সেবিকা হিসাবে মেহের মুস কর্মজীবন শুরু করেন। শুরুতে এয়ার ইন্ডিয়ার কর্মী হয়ে তিনি প্রথম দিকে সাত বছর নাইরোবি- জাপান– নিউ ইয়র্ক রুটে কাজ করতেন৷ সেই সময় থেকেই মেহেরের ভ্রমণের তৃষ্ণা বেড়ে ওঠে। যদিও সেই সময় সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একপ্রকারের ঠান্ডা যুদ্ধের আবহ ছিল। স্বাধীনতার পরপর ভারতের অবস্থাও যথেষ্ট স্থিতিশীল ছিল না। অন্যদিকে আফ্রিকার কিছু অংশের মানুষ বর্ণবিদ্বেষের শিকার ছিল। সেই সময় একজন মহিলা হয়েও তাঁর গতি স্তব্ধ হয়নি। মেহের-এর বাবা এবং দাদু দুজনেই ছিলেন ভ্রমন পিপাসু মানুষ। তাঁর দাদু গান্ধীজীর দক্ষিণ আফ্রিকা সফরকালে তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন। মেহের মনে করেন তাঁর পর্যটক হয়ে ওঠার অনুপ্রেরণা তাঁর বাবা এবং দাদু।
১৯৭২ সালে মেহের ‘এয়ার হোস্টেস’ থেকে ‘গ্রাউন্ড স্টাফ’ টিমে বদলি হয়ে আসেন। কিন্তু ভ্রমণের অদম্য ইচ্ছায় কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ‘ট্যুরিজম’ বিভাগে যোগদান করেন। পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের বৌদ্ধ পর্যটন ভারতে প্রচার করা ছিল তাঁর প্রধান কাজ। এই কাজের সুবাদেই তিনি সেই সময় গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান লুম্বিনী -তে পৌঁছান। মেহের পছন্দ করতেন তথাকথিত অখ্যাত স্থান ভ্রমণ করতে। কিন্তু এই সমস্ত ভ্রমণের জন্য প্রচুর পরিমানে অর্থের প্রয়োজন হয়, একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষের কাছে তার যোগান না থাকাটাই স্বাভাবিক। ফলে অর্থাভাবে মেহেররের অনেক জায়গায় যাবার ইচ্ছা অপূর্ণ থাকে। চাকরি বাঁচিয়ে তাঁকে সমস্ত কাজ করতে হত। কোন রকমের ছুটি তিনি নিতেন না, এমনকি কোনো উৎসব উপলক্ষেও না যাতে বছরের শেষে তাঁর বেশ কিছুদিনের ছুটি সঞ্চয় হয়। তিনি একাধিক বার লোন অবধি নিয়েছেন ভ্রমণের জন্য। এমনকি কমপ্লিমেন্টারি বা ডিসকাউন্টেড টিকিটও তিনি সঞ্চয় করে রাখতেন।
সাত বছর একাধিক্রমে কাজ করার পর তিনি সিনিয়র আধিকারিকের পদে উন্নীত হন। এবং সেই সময় তিনি কিছু সংস্থা থেকে স্পনসরশিপ তথা আর্থিক সাহায্য পান তাঁর ভ্রমণের জন্য। জীবন ও মানুষের সম্পর্কে কৌতুহল এবং ভ্রমণের আবেগ মেহেরকে বিশ্বের বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন ও দুর্গম অঞ্চলে নিয়ে গিয়েছিল যেখানে সম্ভবতঃ কেবল ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক বা কোনো আবিষ্কারকই যেতে পেরেছিল। সেই সময়ে তাঁর ছুটি কেবল ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। মেহের কঙ্গোর পিগমিদের সাথে কিছুদিন এবং ইস্টার দ্বীপপুঞ্জে কিছুদিন কাটিয়েছিলেন সেই সময়। তার পরে সেপিক নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে হেডহান্টিং উপজাতিদের আবাসস্থলে থেকেছিলেন কিছুদিন। আমাজনের রেন ফরেস্ট থেকে শুরু করে ক্যারিবিয়ান আইল্যান্ড সমস্ত সৌন্দর্যের সাক্ষী থেকেছেন মেহের। বেদুইনদের সাথে একটা গোটা দিন কাটিয়েছিলেন সিনাই মরুভূমিতে। পেরুর মাচু পিচুর প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ, দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ ভানুয়ার আগ্নেয়গিরি ইত্যাদি অনেক স্থান তিনি ভ্রমণ করেছেন এবং এখানকার স্থানীয় মানুষদের জীবনযাত্রার সাক্ষী থেকেছেন তিনি। পাঁচ মাসের একাকী ভ্রমণে আফ্রিকার ৩৫টি দেশে তিনি গিয়েছিলেন। এরপর মেহের মার্কোপোলোর পথ অনুসরণ করেন। সমরখন্দ ও বোখারা হয়ে সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া এবং বিস্তৃত গোবি মরুভূমির দিকে এগিয়ে যান মেহের। ১৯৭২ সালে তিনি স্ক্যান্ডিনেভিয়ার তিনটি ল্যাপল্যান্ডে পৌছানোর আগে আর্কটিক বৃত্তে পা রাখেন। আফ্রিকা জুড়ে লিভিংস্টোনের পথ অনুসরণ করে তিনি সাহারা মরুভূমি পার করে দুর্গম টিমবুক্টুতে যাত্রা করেন। বলিভিয়ায় তিনি বিশ্বের সর্বোচ্চ বানিজ্যিকভাবে নাব্যতাযোগ্য হ্রদ টিকিকাকা হ্রদের ওপারে পাড়ি দিয়েছিলেন। তালিবানদের ধ্বংস করে দেওয়ার বহু বছর আগে স্মৃতিসৌধ বামিয়ান বুদ্ধের কাছে পৌছেছিলেন। এমনকি তিনি ইকুয়েডরের রাজধানী কুইটোতে নিরক্ষরেখার উপরে দাঁডিয়েছিলেন, তাঁর এক পা ছিল উত্তর গোলার্ধে আর অন্য একটি পা দক্ষিন গোলার্ধে। বিশ্বের বেশীরভাগ পর্বত শৃঙ্গ যেমন আন্দিজ, সিয়েরা নেভাদা, রকি, আল্পস, অ্যাটলাস, হিমালয়, ইত্যাদি তিনি ভ্রমণ করেছেন। তাছাড়া ইন্দোনেশিয়া, মেলানেশিয়া এবং পলিনেশিয়ার প্রত্যন্ত দ্বীপ, সমস্ত মহাসাগর, বিভিন্ন নদীর উপকূলও তাঁর কাছে অধরা ছিল না। আমাজন, কঙ্গো, জাম্বেসি, মিসিসিপি, ইয়াংসি -র প্রান্ত থেকে ইস্টার দ্বীপের তীর পর্যন্ত তিনি রওনা দিয়েছিলেন।
তাঁর সবথেকে মূল্যবান অভিজ্ঞতা হল ১৯৭৬ সালে আন্টার্টিকায় তাঁর অভিযান। এই অভিযান এক অপ্রত্যাশিত ঘটনার ফলাফল। আফ্রিকায় একটি সাক্ষাতে আমেরিকান – সুইডিশ এক্সপ্লোরার লার্স এরিক লিন্ডব্ল্যান্ডে মেহেরকে আন্টার্টিকার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া তাঁর জাহাজে আমন্ত্রণ জানান। সেই সময় আফ্রিকায় রাজনৈতিক অশান্তির আবহ ছিল, ফলে মেহেররের পাসপোর্ট ও ভিসা সংক্রান্ত কিছু জটিলতা তৈরি হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত মেহের সহ তাঁদের দলের সকল সদস্য সমস্ত জটিলতা কাটিয়ে বিমানে ওঠেন মাদাগাস্কারের উদ্দেশ্যে। কিন্তু বিমানটির হাইড্রলিকে ত্রুটি দেখা দেয়। ফলে তাঁরা তাঁদের সমস্ত পরিকল্পনা বদলে শেষ পর্যন্ত কেপটাউন থেকে জাহাজে চেপে যাত্রা শুরু করেছিলেন। তিনি মনে করেন এই যাত্রাপথ তিনি কখনোই ভুলতে পারবেন না। কেবল দেশের বাইরেই নয় মেহের ভারতের প্রতিটি প্রদেশও ভ্রমণ করেছেন এবং তিনি বলেছেন এই ভ্রমনগুলিই তাঁর কাছে সবথেকে বেশী আকর্ষণীয়। নিছক ভ্রমণ নয় তিনি মনে করেন ভ্রমণের আগে স্থান সম্পর্কে বিস্তারিত গবেষণা করা ভ্রমনার্থীদের জন্য একান্ত প্রয়োজন। বছরের পর বছর ধরে মেহের বিভিন্ন শীর্ষস্থানীয় পত্র- পত্রিকায় অসংখ্য ট্রাভেলগ লিখেছেন। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য সারা ভারত ও বিশ্ব ভ্রমণের তথ্যবহুল অডিও-ভিজুয়াল শো পরিচালনা করেছেন এবং বর্তমানে ছোটদের জন্য বই লেখার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মেহের যে কেবল ভ্রমন পিপাসু তাই নয় একজন আদ্যন্ত ভোজনরসিক এবং রন্ধনপটুও বটে। দেশ বিদেশের বিভিন্ন খাবার বানানোয় তিনি সিদ্ধহস্ত। বর্তমানে তিনি বিশ্বের সবথেকে বড় রেলযাত্রার পরিকল্পনা নিচ্ছেন। ৭৬ বছর বয়সী মেহের মুসের দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি দুর্বল। মেরুদন্ডের সমস্যায় ভুগছেন। তবুও তিনি হতাশ নন। বরং তাঁর ভ্রমণের অদম্য আবেগ তাঁকে এখনও কর্মোদ্যোগী করে রেখেছে।
তথ্যসূত্র
- https://timesofindia.indiatimes.com/
- https://youtu.be/
- https://www.cntraveller.in/
- https://www.thebetterindia.com/
