ভারতের একজন বিখ্যাত ট্র্যাক অ্যাণ্ড ফিল্ড দৌড়বিদ ছিলেন মিলখা সিং (Milkha Singh)। কমনওয়েলথ গেমসে প্রথম ভারতীয় পুরুষ অ্যাথলিট হিসেবে স্বর্ণপদক জয় করেছিলেন তিনি। পাকিস্তানের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান তাঁকে ‘দ্য ফ্লাইং শিখ’ অভিধায় ভূষিত করেছিলেন। কমনওয়েলথ গেমসের মতো ১৯৫৮ এবং ১৯৬২ সালের এশিয়ান গেমসেও স্বর্ণপদক জিতে ভারতের গৌরব বৃদ্ধি করেন তিনি। ১৯৬০ সালের অলিম্পিক গেমসে ৪০০ মিটার দৌড় ইভেন্টে অন্যতম কৃতী দৌড়বিদ ছিলেন তিনি, কিন্তু ২০০ মিটার পর্যন্ত দৌড়েই তিনি তাঁর গতি হারিয়ে ফেলেন। সেই অলিম্পিকে তিনি চতুর্থ স্থানে তাঁর দৌড় শেষ করেন। কিন্তু হেরে গিয়েও ৪০০ মিটার দৌড়ের একটি নতুন রেকর্ড তৈরি করেন তিনি ভারতীয় দৌড়বিদ হিসেবে। মাত্র ৪৫.৭৩ সেকেণ্ডে চতুর্থ স্থান অধিকার করা মিলখার এই রেকর্ড প্রায় ৪০ বছর কোনো ভারতীয় অ্যাথলিট ভাঙতে পারেনি। ১৯৫৬ সালের মেলবোর্ন অলিম্পিক, ১৯৬০ সালের রোম অলিম্পিক এবং ১৯৬৪ সালের টোকিও অলিম্পিকে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন মিলখা সিং। শৈশবে চোখের সামনে ঘটে যাওয়া পারিবারিক হত্যাকাণ্ড তাঁকে গভীরভাবে হতাশাগ্রস্ত করে তুলেছিল। কিন্তু সেই হতাশা থেকে একসময় মুক্ত হয়ে, সাফল্য অর্জন করেছিলেন মিলখা সিং। শেষ জীবনে দরিদ্র ও অভাবী ক্রীড়াবিদদের সহায়তার জন্য চ্যারিটেবল ট্রাস্ট খোলেন তিনি। তাঁর ক্রীড়া দক্ষতার কৃতিত্ব স্বরূপ ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কারে ভূষিত করে। ২০০৮ সালে সাংবাদিক রোহিত ব্রিজনাথ মিলখা সিংকে ‘ভারতের সর্বকালের সেরা ক্রীড়াবিদ’ বলে চিহ্নিত করেন।
১৯২৯ সালের ২০ নভেম্বর ব্রিটিশ শাসিত ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের গোবিন্দপুরায় একটি রাঠোর শিখ পরিবারে মিলখা সিংয়ের জন্ম হয়। তাঁর বাবা মায়ের পনেরোটি সন্তানের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মিলখা। যদিও দেশভাগের আগেই আট সন্তানের মৃত্যু হয়। দেশভাগের সময় তাঁর বাবা-মা এবং তিন ভাই বোন এক নৃশংস হত্যাকাণ্ডে মারা যান। চোখের সামনে তাঁর পরিবারকে মারা যেতে দেখে মানসিকভাবে চরম হতাশ হয়ে পড়েন তিনি। সে সময় পাঞ্জাবে হিন্দু আর শিখদের ক্রমান্বয়ী হত্যালীলা থেকে বাঁচতে ১৯৪৭ সালে দিল্লিতে এসে থাকতে শুরু করেন মিলখা সিং। তাঁর এক বিবাহিত দিদির সংসারেও তিনি বেশ কিছুদিন থাকেন এবং ঐ সময়পর্বেই টিকিট ছাড়া ট্রেনে ভ্রমণের জন্য তিহার জেলে কয়েক মাস থাকতে হয় মিলখা সিংকে। তাঁর বোন ঈশ্বর নিজের গয়না বিক্রি করে তাঁর জামিনের ব্যবস্থা করেছিলেন। দিল্লির পুরানা কেল্লা অঞ্চলের একটি উদ্বাস্তু শিবিরে কিছুকাল অতিবাহিত করেন তিনি।
ক্রমেই জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ডাকাতি করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কিন্তু তাঁর এক ভাই মালখান তাঁকে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে চাকরি করার পরামর্শ দেয়। প্রথম তিনবার চেষ্টা করেও চাকরি পাননি তিনি। চতুর্থবারের প্রচেষ্টায় ১৯৫১ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন মিলখা সিং। সেকেন্দ্রাবাদে ইলেক্ট্রিক্যাল মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে কাজ করতে শুরু করেন তিনি। এই সময়েই অ্যাথলেটিক্সের প্রতি আগ্রহী হন মিলখা। স্কুলে যাওয়ার সময় ১০ কিমি রাস্তা তিনি দৌড়েই যাতায়াত করতেন এবং সেই দেখে সেনা বিভাগে অ্যাথলেটিক্সের প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত হন মিলখা সিং। নতুন নির্বাচিত তরুণদের মধ্যে ক্রস-কাণ্ট্রি দৌড়ে ষষ্ঠ স্থান অর্জন করেন তিনি। পরবর্তীকালে তাঁর এই ক্রীড়াজগতে আসার পিছনে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরাট অবদানের কথা তিনি বারে বারে স্বীকার করেছেন।
১৯৫৬ সালের মেলবোর্ন অলিম্পিক গেমসে ২০০ মিটার ও ৪০০ মিটার দৌড় প্রতিযোগিতায় ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি। অনভিজ্ঞতার কারণে সে বছর অলিম্পিকে জিততে পারেননি তিনি, কিন্তু ৪০০ মিটার দৌড়ে প্রতিযোগী চার্লস জেনকিন্সের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ তাঁকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। অ্যাথলেটিক্সের পদ্ধতি সম্পর্কে গভীরভাবে শিখেছিলেন তিনি জেনকিন্সের কাছ থেকে। ১৯৫৮ সালে মিলখা সিং কটকে আয়োজিত ভারতীয় ন্যাশনাল গেমসে ২০০ মিটার এবং ৪০০ মিটার দৌড়ে রেকর্ড তৈরি করেন। ঐ বছরই একই ইভেন্টে এশিয়ান গেমসে অংশগ্রহণ করে স্বর্ণপদক জেতেন তিনি। এছাড়া ঐ বছর কমনওয়েলথ গেমসে ৪০০ মিটার দৌড়ে স্বর্ণপদক জেতেন তিনি। মাত্র ৪৬.৬ সেকেণ্ডে সম্পূর্ণ দৌড় সমাপ্ত করে নতুন এক রেকর্ড তৈরি করেন মিলখা সিং। স্বাধীন ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে মিলখা সিংই ছিলেন কমনওয়েলথ গেমসে স্বর্ণপদকজয়ী প্রথম পুরুষ অ্যাথলিট। ২০১৪ সালে বিকাশ গৌড়ার অ্যাথলেটিক্সের ব্যক্তিগত বিভাগে ভারতীয় পুরুষ হিসেবে স্বর্ণপদক জয়ের আগে মিলখা সিং-ই অ্যাথলেটিক্সে একমাত্র স্বর্ণপদকজয়ী ভারতীয় ছিলেন। ১৯৬০ সালে জওহরলাল নেহরু তাঁকে পাকিস্তানের দৌড়বিদ আবদুল খলিকের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে উৎসাহিত করেন এবং এই প্রসঙ্গে দেশভাগের সময়কার সব রক্তাক্ত স্মৃতি ভুলে যেতে অনুরোধ করেন। এই দৌড় প্রতিযোগিতার পরেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জেনারেল আইয়ুব খান মিলখা সিংকে ‘দ্য ফ্লাইং শিখ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। অনেকের মতে, রোম অলিম্পিকের আগে ফ্রান্সে ৪৫.৮ সেকেণ্ডের একটি রেকর্ড গড়েছিলেন মিলখা সিং, কিন্তু রোম অলিম্পিকে লৌ জোন্স ৪৫.২ সেকেণ্ডের রেকর্ড করে মিলখার রেকর্ড ভেঙে দেন। রোম অলিম্পিকেই ৪০০ মিটার দৌড়ের ফাইনালে চতুর্থ স্থান অর্জন করেন মিলখা সিং। ওটিস ডেভিস বাদে সকল প্রতিযোগীকেই পিছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছিলেন মিলখা, সকলেই ভেবেছিল তিনি কোনো একটা পদক ঠিকই অর্জন করবেন। কিন্তু ২৫০ মিটার অতিক্রম করার পরেই দৌড়ের গতি কমে যায় তাঁর। ফলে সেবার অলিম্পিকে একটি ব্রোঞ্জ পদকও জিততে পারেননি মিলখা সিং। এই স্মৃতিকে তিনি কখনোই ভুলতে পারেননি এবং একে জীবনের এক অন্যতম ভুল বলে স্বীকার করেছেন মিলখা।
১৯৬২ সালে জাকার্তায় অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে ৪০০ মিটার দৌড় এবং ৪ × ৪০০ মিটার রিলে দৌড়ে স্বর্ণপদক জয় করেন। ১৯৬৪ সালের টোকিও অলিম্পিকে ৪০০ মিটার, ৪ × ১০০ মিটার রিলে এবং ৪ × ৪০০ মিটার রিলে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন মিলখা সিং। কিন্তু ৪ × ৪০০ মিটার ইভেন্টের হিটে মিলখা সিং, মাখন সিং, অমৃত পাল এবং আজমীর সিং-এর ভারতীয় দল চতুর্থ স্থান অর্জন করায় প্রতিযোগিতা থেকে বাদ পড়ে ভারত। অনেকে দাবি করেন যে মিলখা সিং তাঁর ক্রীড়া জীবনের ৮০টি দৌড়ের মধ্যে ৭৭টিতেই জিতেছিলেন। কিন্তু এই দাবি ভ্রান্ত। ঠিক কতগুলি দৌড়ে অংশ নিয়েছিলেন তিনি, তার কোনো প্রামাণ্য সংখ্যা নেই, এমনকি ঠিক কতগুলি দৌড় জিতেছিলেন সেই পরিসংখ্যানের প্রমাণও নেই।
১৯৫৮ সালে এশিয়ান গেমসে তাঁর সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে তাঁকে সিপাহির পদ থেকে জুনিয়র কমিশনড অফিসারের পদে উন্নীত করা হয়। ঐ বছরই ভারত সরকার তাঁকে ভারতের চতুর্থ শ্রেষ্ঠ বেসামরিক সম্মান ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কারে ভূষিত করে। ২০০১ সালে ভারত সরকারের কাছ থেকে অর্জুন পুরস্কারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন মিলখা সিং। তাঁর যুক্তি ছিল এই পুরস্কার প্রবীণদের থেকে তরুণ অ্যাথলিটদের দেওয়া উচিত। এমনকি তিনি এও বলেন যে অনেক সময়ই অনুপযুক্ত লোকেদের এই পুরস্কার দেওয়া হয় আর মিলখার এই মন্তব্যে বিতর্ক দানা বাঁধে। মিলখা এক সাক্ষাৎকারে জানান, পদ্মশ্রী পাওয়ার পরে অর্জুন পুরস্কারের প্রস্তাব আসলে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর মাধ্যমিকের শংসাপত্র দেওয়ার সামিল। মিলখা সিংকে দেওয়া সমস্ত পদক নয়া দিল্লির জওহরলাল নেহেরু স্টেডিয়ামে এবং পরে পাতিয়ালার একটি স্পোর্টস মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রাখা হয়।
২০২১ সালের ১৮ জুন চণ্ডীগড়ে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মিলখা সিং-এর মৃত্যু হয়।