প্রতি বছর প্রতি মাসের নির্দিষ্ট কিছু দিনে বিভিন্ন দেশেই কিছু দিবস পালিত হয়। ঐ নির্দিষ্ট দিনে অতীতের কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে স্মরণ করা বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতেই এই সমস্ত দিবস পালিত হয়। ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়। ভারতে পালনীয় সেই সমস্ত দিবসগুলির মধ্যে একটি হল জাতীয় ইঞ্জিনিয়ার দিবস (National Engineers Day)।
প্রতি বছর ১৫ সেপ্টেম্বর সারা ভারত জুড়ে পালিত হয় জাতীয় ইঞ্জিনিয়ার দিবস। বিখ্যাত ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ার ভারতরত্ন প্রাপক মোক্ষাগুন্দম্ বিশ্বেশ্বরায়ার জন্মদিন স্মরণে প্রতি বছর এই দিনটিতে জাতীয় ইঞ্জিনিয়ার দিবস পালন করা হয়।
সমগ্র বিশ্ব জুড়েই বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় ‘ইঞ্জিনিয়ার দিবস’ পালিত হয় আর সেই রীতির সূত্র ধরেই ভারতেও স্যার এম. বিশ্বেশ্বরায়ার জন্মদিনে পালিত হয় জাতীয় ইঞ্জিনিয়ার দিবস। ৪ মার্চ তারিখে সমগ্র বিশ্বে আন্তর্জাতিক ইঞ্জিনিয়ার দিবস পালিত হলেও ভারতে এর কোনো উদ্যাপন হয় না। ১৯৬৮ সাল থেকে প্রতি বছর ১৫ সেপ্টেম্বর তারিখে ভারতে এই জাতীয় ইঞ্জিনিয়ার দিবস উদ্যাপিত হয়ে আসছে। ভারতের লক্ষ লক্ষ ইঞ্জিনিয়ার ছাত্র-ছাত্রীকে দেশগঠনের কাজে উৎসাহিত করে তুলতে, স্যার এম. বিশ্বেশ্বরায়ার পাশাপাশি অন্যান্য শ্রেষ্ঠ ইঞ্জিনিয়ারদের স্মরণ করার জন্য এই বিশেষ দিনটি আজও গুরুত্বপূর্ণ সকল ভারতবাসীর কাছে। বহু বিশ্বখ্যাত ইঞ্জিনিয়ার এই ভারতবর্ষ থেকেই উঠে এসেছেন। দেশগঠনের কাজে ভারতের এই শ্রেষ্ঠ ইঞ্জিনিয়ারদের অবদানকে মনে রেখে এবং স্যার এম. বিশ্বেশ্বরায়ার গুরুত্বকে স্মরণে রেখেই এই দিনটি পালনীয় দিবস হিসেবে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ঊঠেছে।
স্যার এম. বিশ্বেশ্বরায়া মাইসোরের ১৯তম দেওয়ান পদে নিযুক্ত ছিলেন প্রায় সাত বছর। ব্রিটিশ শাসিত ভারতীয় সাম্রাজ্যে তাঁকে নাইট কমান্ডার সম্মানে ভূষিত করেন রাজা পঞ্চম জর্জ। কর্ণাটকের কাবেরী নদীর উপর কৃষ্ণরাজা সাগর বাঁধ কিংবা মহারাষ্ট্রের লক্ষ্মী তালাব বাঁধ সবক্ষেত্রেই মুখ্য ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন এম. বিশ্বেশ্বরায়া। হায়দ্রাবাদে বন্যা নিরোধক ব্যবস্থা নির্মাণেও তাঁর অবদান স্মরণীয়। দাক্ষিণাত্য মালভূমির উপর ১৯০৩ সালে তিনি স্বয়ংক্রিয় ফ্লাডগেট নির্মাণ করান যা প্রাথমিকভাবে পুনের কাছে খরাভাসলা বাঁধে বসানো হয়। এই নতুন পদ্ধতির ফ্লাডগেটকে তিনি নাম দেন ‘ব্লক সিস্টেম’। এখানে সঠিকভাবে এবং সফলভাবে ফ্লাডগেটটি স্থাপনের পরে একইরকম আরো দুটি ফ্লাডগেট নির্মাণ করেন তিনি যেগুলি যথাক্রমে গোয়ালিয়রের তিগ্রা বাঁধ ও কর্ণাটকের কাবেরী নদীর উপর কৃষ্ণরাজা সাগর বাঁধে বসানো হয়। এই ফ্লাডগেট বসানোর ফলে বাঁধগুলি আগের থেকে অনেক বেশি পরিমাণে জল সঞ্চয় করে রাখতে শুরু করে বাঁধের ন্যূনতম কোনো ক্ষতি ছাড়াই। কাবেরী নদীর উপর কেআরএস বাঁধ ওরফে কৃষ্ণরাজা সাগর বাঁধ নির্মাণ তাঁর ইঞ্জিনিয়ার জীবনের অন্যতম সফল স্থাপনা। সুপারিনটেণ্ডিং ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ১৯০৭ সালে এম. বিশ্বেশ্বরায়া মিশর, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ায় কাজ করেছেন। ১৯০৯ সালে হায়দ্রাবাদের মুসী নদীর উপর নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু করেন তিনি এবং ক্রমেই সমগ্র হায়দ্রাবাদ শহরকে বন্যার বিপদ থেকে মুক্ত করার ব্যবস্থা নির্মাণ করে ভারতে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। বিশাখাপত্তনম বন্দরকে সমুদ্রের ক্ষয় থেকে রক্ষা করতে তিনি বিশেষ ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবস্থার উদ্ভাবন করেন। তৎকালীন এশিয়ার বৃহৎত্তম বাঁধ ছিল এটি। বিহারের গঙ্গা নদীর উপর মোকামা ব্রিজের সংস্কারের পিছনেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ১৯০৯ সালে তিনি ব্রিটিশ সরকারের চাকরি থেকে অবসর নেন এবং মাইসোরের রাজ্য সরকারের মুখ্যসচিবের পদে যোগ দেন। ৯০ বছর বয়সেও তিনি অক্লান্তভাবে নির্মাণ স্থাপত্য এবং ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করে গিয়েছেন। ১৯১৭ সালে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘ইউনিভার্সিটি বিশ্বেশ্বরায়া কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং’ ভারতে প্রতিষ্ঠিত প্রথম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিরোপা পায়। মাইসোরের দেওয়ান থাকাকালীন মাইসোরে বহুবিধ প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেন তিনি যা মাইসোরকে আধুনিকতম করে তোলে। ১৯৫৫ সালে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ‘ভারতরত্ন’ খেতাব অর্জন করেন তিনি।
এই দিনে ভারতের বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন প্রযুক্তিগত বিষয়ে দীর্ঘ কর্মশালা, সেমিনার, পুরস্কার জ্ঞাপন অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নানা বিষয়ে অনুষ্ঠান, শিক্ষামূলক বক্তৃতা, বাণিজ্যসহায়ক নানা কোর্স আয়োজন করা হয় এই দিনকে উপলক্ষ্য করে। প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে দিকপালদের সঙ্গে শিক্ষানবিশদের আলোচনার জন্যেও অনেক প্রতিষ্ঠান এই বিশেষ দিনটিকে নির্বাচন করে থাকে। আরো উন্নততর প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের জন্য শিক্ষানবিশ ইঞ্জিনিয়ারদের উৎসাহ দান, ভারত সরকার কর্তৃক বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্যগুলির প্রদর্শনী, তথ্যচিত্রের আকারে সমস্ত প্রযুক্তিগত উন্নতির দৃষ্টান্তগুলি তুলে ধরার মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মকে আকৃষ্ট ও উৎসাহিত করে তোলার চেষ্টা করা হয় এই জাতীয় ইঞ্জিনিয়ার দিবসে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ইঞ্জিনিয়ার দিবসের কথা মাথায় রেখেও অনেক প্রতিষ্ঠান সম্মানজ্ঞাপন অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। আজকের প্রযুক্তি-নিয়ন্ত্রিত যুগে দাঁড়িয়ে মানুষের সামান্যতম প্রয়োজনের জিনিসটিও প্রযুক্তি তৈরি করে চলেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রকৌশলীদের নানা নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে আরো উন্নত হয়ে উঠছে ক্রমশ। ১৯৮০ সালের পর থেকে আইটি (IT) জগতে এক বিপ্লব ঘটে যায় যার দরুণ একটা ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল দুনিয়া তৈরি হয়। আধুনিকতম আবিষ্কারের ব্যবহার ও উদ্ভাবনে এই প্রকৌশলীদের ছাড়া ভাবাই যায় না। অনলাইন শিক্ষা, অনলাইন বাণিজ্য, অনলাইন টাকা লেনদেন সবক্ষেত্রে কোনো না কোনো প্রকৌশলীর অবদান এর পিছনে লুকিয়ে আছে আর সেই অবদানকে আমাদের মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যেই জাতীয় ইঞ্জিনিয়ার দিবস পালন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
২০০৯ সাল থেকে প্রতি বছরই জাতীয় ইঞ্জিনিয়ার দিবস একেকটি বিশেষ ‘থিম’ (theme) অনুসারে পালিত হয়। ২০০৯ সালে প্রথম এই দিবসের প্রতিপাদ্য (theme) ছিল ‘সবুজই এই বছরের অন্যতম প্রতিপাদ্য’ (Green is the theme of this year)। এরপর বিগত পাঁচ বছরের প্রতিপাদ্যগুলির মধ্যে প্রথমে ২০১৭ সালের প্রতিপাদ্য ছিল ‘উন্নয়নশীল ভারতে ইঞ্জিনিয়ারদের ভূমিকা’ (Role of Engineers in a Developing India)। তারপর ২০১৮ সালে জাতীয় ইঞ্জিনিয়ার দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘ডিজিটাল রূপান্তর : এক নতুন শিল্পবিপ্লব’ (Digital Transformation : A New Industrial Revolution)। ২০১৯ সালে এই দিনের প্রতিপাদ্য ছিল ‘পরিবর্তনের জন্য ইঞ্জিনিয়ারিং’ (Engineering for Change)। ২০২০ সালে ‘আত্মবিশ্বাসী ভারতের জন্য ইঞ্জিনিয়াররা’ (Engineers for a Self-Reliant India) এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে পালিত হয়েছিল জাতীয় ইঞ্জিনিয়ার দিবস। সবশেষে ২০২১ সালে এই বিশেষ দিনের প্রতিপাদ্য হিসেবে স্থির করা হয় ‘একটি সুস্থ পৃথিবীর জন্য ইঞ্জিনিয়ারিং– ইউনেস্কোর ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিবেদনের উদ্যাপন’ (Engineering for A Healthy Planet- Celebrating the UNESCO Engineering)।
One comment