জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবস

২ ফেব্রুয়ারি ।। জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবস (বাংলাদেশ)

প্রতি বছর প্রতি মাসের নির্দিষ্ট কিছু দিনে বিভিন্ন দেশে কিছু দিবস পালিত হয়। ঐ নির্দিষ্ট দিনে অতীতের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে স্মরণ করা বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতেই এই সমস্ত দিবস পালিত হয়। বাংলাদেশও তাঁর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের পালনীয় সেই সমস্ত দিবসগুলির মধ্যে একটি হল জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবস (National Food Safety Day – Bangladesh)।

প্রতি বছর ২ ফেব্রুয়ারি সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবস পালিত হয়। সমাজের সকল শ্রেণি ও সকল পেশার মানুষকে খাদ্য দ্রব্যের নিরাপত্তার বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন করে তোলাই এই বিশেষ দিন পালনের উদ্দেশ্য। প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছে, খাদ্য-প্রক্রিয়াকরণ সহ কৃষিকাজের ক্ষেত্রেও উন্নতমানের উচ্চ ফলনশীল বীজের ব্যবহার বাড়ছে। একইসঙ্গে রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে প্রক্রিয়াজাত খাবারে। এই প্রসঙ্গেই কোন খাদ্যগ্রহণ নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যসম্মত সেই বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর জন্যেই প্রতি বছর ২ ফেব্রুয়ারি পালন করা হয় জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবস।

২০১৮ সাল থেকে সমগ্র বাংলাদেশে পালিত হয়ে আসছে জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবস । মূলত বাংলাদেশের জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা অধিদপ্তর (BFSA)-এর প্রতিষ্ঠা দিবসকেই জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়ার কারণে বাংলাদেশে খাদ্য দূষণ এবং খাদ্যের সংস্পর্শজনিত নানাবিধ ঝুঁকির বিষয়টি থেকেই যায়। তাই বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বসহ বিবেচনা করা উচিত। খাদ্যে ভেজাল রোধ করা, খাদ্য থেকে কীটনাশকের উপস্থিতি দূর করা এবং খাদ্যকে ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ থেকে বাঁচাতে পারলেই বহু মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করার দরুন বাংলাদেশের খাদ্য মন্ত্রক এই খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি অধিক গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে। ভোক্তাদের নিরাপদ খাদ্য দিতে বদ্ধপরিকর বাংলাদেশ সরকার। পর্যাপ্ত পরিমাণে নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য মানুষের জীবন বাঁচিয়ে রাখে। অন্যদিকে খাদ্যের মধ্যে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, পরজীবি ইত্যাদি মিশে থাকলে তা অনিরাপদ হয়ে যায় এবং তা থেকে ডায়েরিয়া কিংবা প্রাণঘাতী ক্যান্সারের মত মারাত্মক রোগ-ব্যাধি হতে পারে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারা বিশ্বে প্রতি বছর প্রত্যেক ১০ জনের মধ্যে ১ জনের মৃত্যু হয় দূষিত খাবার খেয়ে এবং প্রতি বছর এইভাবে প্রায় ৪ লক্ষ ২০ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। এছাড়া প্রায় ৩ কোটি মানুষের শরীরে দূষিত অনিরাপদ খাবার খাওয়ার ফলে দীর্ঘকালীন অক্ষমতা বা কোনো ব্যাধি বাসা বেঁধেছে। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে এই হার তুলনায় বেশি। তার ফলে প্রতি বছর খাদ্যের সুরক্ষা এবং চিকিৎসা খাতে প্রায় ১১০০ কোটি ডলার খরচ হয়, বলা ভালো তা অপব্যয়িত হয়। বিশ্বায়নের কারণে বিভিন্ন ধরনের খাদ্যের চাহিদাও ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। তার জন্য খাদ্য-বাণিজ্য এবং পর্যটনের ক্ষেত্রে খাদ্যের নিরাপত্তা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। ২০১৩ সালে পাশ হয় বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা আইন, মূলত বাংলাদেশ জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ (BFSA) এই আইন প্রণয়ন ও তা বলবৎ করে। জাতীয় খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্য বাংলাদেশ সরকার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা পালন করতে শুরু করেছে। তার জন্য কোডেক্স প্রশিক্ষণের নানাবিধ উপকরণ সংগ্রহ করা, ছত্রাক-বিরোধী ব্যবস্থা তৈরির চেষ্টাও করা হয়েছে এখানে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সমগ্র বিশ্বে মানুষের যাবতীয় রোগ-ব্যাধি কমানোর জন্য খাদ্যের নিরাপত্তার দিকে জোর দিয়েছে। বাংলাদেশেও সেই সংস্থার উদ্যোগে খাদ্য নিরাপত্তা সংক্রান্ত নীতি তৈরি এবং ঝুঁকিপূর্ণ খাদ্যের কারণে রোগ সংক্রমণের বিষয়ে নজরদারির কর্মসূচিত গৃহীত হয়েছে সফলভাবে। উৎপাদক এবং ভোক্তাদের উভয়ের সহযোগিতা ছাড়া এই কর্মসূচি সফল হওয়া সম্ভব নয়।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকার জীবন বাঁচাতে এবং জনগণের স্বাস্থ্যের সুরক্ষার জন্য প্রথম এই দিবসটি পালন করে। ২০২০ সালে সকলের জন্য নিরাপদ খাদ্য সরবরাহের অঙ্গীকার নিয়ে জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবস পালিত হয় বাংলাদেশে। ২০২১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খাদ্যবাহিত বিভিন্ন রোগের উল্লেখ করে জনস্বাস্থ্যের নিরাপত্তার দাবি জানায় এবং এই বিশেষ দিনে বাংলাদেশ সরকার অসুরক্ষিত খাদ্যের সঙ্গে জড়িত জনস্বাস্থ্যের হুমকি প্রতিরোধ ও সে বিষয়ে আগাম সতর্কতা জারি করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। খামারে বা কারখানায় খাদ্য উৎপাদনের সময় থেকে সেই খাবার ভোক্তার ঘরে পৌঁছানো পর্যন্ত সর্বত্রই নিরাপত্তার বাঁধনে বাঁধতে হবে প্রক্রিয়াটিকে। একইসঙ্গে বিক্রেতারও দায় থাকে খাদ্য নিরাপত্তা রক্ষার। সকলকেই সেই ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০২০ সালের মুজিব বর্ষের মধ্যে এই বিশেষ দিনটি পালনের সময় তিনি জানিয়েছেন বাংলাদেশের খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থা যেন তার নিরাপত্তা এবং গুণমানের কারণেই সকলের কাছে সমাদৃত হয়ে ওঠে সেই দিকটি উন্নত করে তুলতে হবে। ২০২১ সালেও রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের জনগণের জন্য খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিতে জোর দিতে সার, বীজ ও সেচের পাশাপাশি কৃষিকাজে যন্ত্রের ব্যবহারে জোর দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন যাতে খাদ্যের উপাদন ও প্রক্রিয়াকরণ নিরাপদ থাকে। ২০২১ সালের এক বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন যে খাদ্য নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে সমগ্র দেশের বিভিন্ন জায়গায় মোট আটটি খাদ্য পরীক্ষার গবেষণাগার স্থাপন করা হয়েছে। তাছাড়া বিগত ১১ বছর ধরে বাংলাদেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে সফলতা এসেছে। বাংলাদেশকে সুস্থ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে তাই বাংলাদেশের জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা অধিদপ্তর একটি হটলাইন নম্বরের পরিষেবাও চালু করেছে যেখানে ভোক্তারা সর্বদা অভিযোগ বা সংবাদ জানাতে পারে।

প্রতি বছরই একটি বিশেষ প্রতিপাদ্যকে (Theme) সামনে রেখে সমগ্র বাংলাদেশে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা দিবসটি পালিত হয়। ২০১৮ সালে এই দিনের প্রতিপাদ্য ছিল ‘নিরাপদ খাদ্যে ভরবো দেশ, গড়বো সোনার বাংলাদেশ’ (Safe food and build a better Bangladesh)। ২০১৯ সালে ‘সুস্থ সবল জাতি চাই, পুষ্টিসম্মত নিরাপদ খাদ্যের বিকল্প নাই’ (Need a Healthy Nation, There is no alternatives to nutritious, safe food) এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশে এই বিশেষ দিনটি পালিত হয়েছিল। ২০২০ সালের প্রতিপাদ্যটি ছিল ‘সবাই মিলে হাত লাগাই, নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা চাই’ (Put hands together, ensure safe food)। সবশেষে ২০২১ সালে এই বিশেষ দিনের প্রতিপাদ্যটি ছিল ‘টেকসই উন্নয়ন- সমৃদ্ধ দেশ, নিরাপদ খাদ্যের বাংলাদেশ’ (Sustainable Development, rich country, safe food for Bangladesh)।

One comment

আপনার মতামত জানান