পান্নালাল ঘোষ

পান্নালাল ঘোষ

ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের ধারায় বাঁশি বাদক হিসেবে সুবিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ পান্নালাল ঘোষ (Pannalal Ghosh)। ওস্তাদ আলাউদ্দিনের শিষ্য ছিলেন পান্নালাল। হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পরিবেশনের ক্ষেত্রে এক অপরিহার্য বাদ্যযন্ত্র হিসেবে বাঁশির ব্যবহারকে বিখ্যাত করে তুলেছিলেন তিনি। তাঁকে ‘ভারতীয় ধ্রুপদী বাঁশি বাদনের পথপ্রদর্শক’ অভিধাতেও ভুষিত করা হয়।

১৯১১ সালের ২৪ জুলাই অধুনা বাংলাদেশের বরিশালে পান্নালাল ঘোষের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম অক্ষয় কুমার ঘোষ এবং মায়ের নাম সুকুমারী দেবী। পান্নালালের আসল নাম অমলজ্যোতি ঘোষ। ছোটবেলায় তাঁর মা তাঁকে ‘পান্না’ বলে ডাকতেন আর সেই থেকেই ঐ নামে  তিনি সকলের কাছে পরিচিত হন। তিনি জন্মেছেন এক সঙ্গীত-সাধক পরিবারে যেখানে তাঁর বাবা অক্ষয় কুমার, তাঁর ঠাকুরদাদা হরকুমার ঘোষ এবং তাঁর মামা ভবরঞ্জন সকলেই ছিলেন সেকালের বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী। তাঁর মা সুকুমারী দেবীও ঢাকার বিখ্যাত মজুমদার পরিবারের কন্যা হওয়ার সুবাদে স্বভাবত সুমিষ্ট কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন এবং তাঁর খুবই সুন্দর গানের গলা ছিল। তাঁর বাবা নিজে একজন অসামান্য সেতার-বাদক ছিলেন এবং বাবার কাছেই ছোটবেলায় সেতার বাজানোর তালিম নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বালক পান্নালাল রাখালের বাঁশি বাজাতে পছন্দ করতেন এবং সেতারে বাবার শেখানো সুরমূর্ছনা তুলতে চেষ্টা করতেন সেই বাঁশির সাহায্যে। তাঁদের পৈতৃক বাড়ি ছিল কীর্তনখোলা নদীর পাশেই। নয় বছর বয়সে ঐ নদীতে সাঁতার কাটার সময় একটি লম্বা বাঁশের লাঠি দেখতে পান পান্নালাল। সেটি আসলে একটি বিশালাকায় বাঁশের বাঁশি ছিল আর সেটা দেখেই সেই বাঁশি বাজানো শেখার প্রতি আকৃষ্ট হন তিনি। কিশোর পান্নালাল বহু জায়গা থেকে বহু মানুষের কাছ থেকে নানা ধরনের গান শুনে শুনে আয়ত্ত করে নিতেন। কিশোর বয়সে বরিশালে থাকার সময়েই স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন পান্নালাল। পরবর্তীকালে ১৯২৪ সালে মাত্র তেরো বছর বয়সে পারুল বিশ্বাসের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। পারুল নিজে একজন সুগায়িকা ছিলেন। ১৯২৮ সালে সক্রিয়ভাবে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নেন তিনি। একটি কুস্তির আখড়ায় তিনি যোগ দেন এবং সেখানে মার্শাল আর্ট, কুস্তি ও লাঠিখেলা শেখেন তিনি।

গুণী হারমোনিয়াম বাদক তথা বিখ্যাত ধ্রুপদী সঙ্গীতশিল্পী ওস্তাদ খুশি মহম্মদ খানের কাছে তিনি দু বছর যাবৎ তালিম নেন এবং তাঁর দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর পরে পণ্ডিত গিরিজাপ্রসাদ চক্রবর্তীর কাছে সঙ্গীতশিক্ষা সম্পন্ন হয় পান্নালালের। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন যে ওস্তাদ আবদুল করিম খান সাহেবের অনেক প্রভাব ছিল তাঁর উপর। তাঁর বাবার কাছ থেকেও বাল্যকালে সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্রের তালিম নিয়েছিলেন পান্নালাল ঘোষ। ফলে তাঁর মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মানুষের শিক্ষার এক অপূর্ব মিশেল ঘটেছিল বলা যায়।  

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

১৯২০ সালের শেষ দিকে জীবিকার সন্ধানে পান্নালাল কলকাতায় চলে আসেন এবং ১৯৪০-এর দশকে পেশাদারি সঙ্গীতজীবন শুরু করার জন্য বম্বেতে চলে যান তিনি। সেই সময় তাঁর বম্বে যাওয়ার সিদ্ধান্তটি যুগোপযোগী হয়েছিল বলেই পরবর্তীকালে তিনি মনে করেছেন। সেখানেই তাঁর অসামান্য সঙ্গীত প্রতিভার কদর ও সম্মান করার মত যোগ্য পরিমণ্ডল খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি। আঠারো বছর বয়স থেকেই তিনি ৩২ ইঞ্চি লম্বা বাঁশের বাঁশি বাজানোর প্রতি মনোনিবেশ করেন। তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের একজন অনুরাগী ভক্ত ছিলেন এবং স্বামী বিবেকানন্দের কাছ থেকে সরাসরি দীক্ষাও গ্রহণ করেন। তাঁর কর্মজীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলামের দ্বারাও গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন তিনি। সিদ্ধ রাগের মধ্যে আভোগী, বাগেশ্রী, বাহার, বসন্ত, ভৈরবী, ভীমপলশ্রী, ভুপ, ভুপাল তোড়ি, বেহাগ, চন্দ্রমৌলি, দরবারি, গৌড় সারঙ্গ, জৌনপুরি, কাফি, কেদার, মারওয়া, পিলু, মিঁঞা মল্লার, শুদ্ধ ভৈরবী ইত্যাদি রাগগুলি বাঁশিতে অসম্ভব নৈপুণ্যের সঙ্গে বাজাতে পারতেন পান্নালাল ঘোষ। ঐতিহ্যবাহী ঘরানার সঙ্গীতের প্রতি তিনি বেশি আকৃষ্ট হলেও নতুন চিন্তাকে প্রশ্রয় ও প্রাধান্য দিতেন তিনি। এর ফলেই বহু নতুন রাগের প্রচলন করেছিলেন তিনি। যেমন – আন্দোলিকা, চন্দ্রমৌলি, জয়ন্ত, কুমারী, পঞ্চাবতী, শুক্লাপলাশী, হংস নারায়ণী ইত্যাদি। তাঁর গায়কী এবং বাদ্যযন্ত্রের বাদনশৈলীর অসম্ভব সুন্দর তাল-মিল তাঁকে খুব দ্রুত বিখ্যাত করে তুলেছিল। ওস্তাদ ফৈজ খান, পণ্ডিত ওঙ্কারনাথ ঠাকুর এবং সুরশ্রী কেশরবাঈ কেরকার প্রমুখ কণ্ঠসঙ্গীতশিল্পীরা তাঁর গানের প্রশংসা করার পাশাপাশি ওস্তাদ আমীর হুসেন খান, ওস্তাদ আল্লারাখা প্রমুখ বিখ্যাত তবলাবাদকেরাও তাঁর তালজ্ঞানের অত্যন্ত প্রশংসা করেছেন। কখনও কোনও উপস্থাপনায় পান্নালালের তাল ভুল হয়েছে এমন ঘটনা বিরল বললেই চলে, একথা অনেকেই একবাক্যে স্বীকার করেছেন। সরাইকেল্লা রাজ্যের নাচের দলের সঙ্গীত পরিচালকের পদেও কাজ করেছেন পান্নালাল ঘোষ। ১৯৩০-এর দশকে তিনি ইউরোপেও সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন। ১৯৫৬ সালে দিল্লিতে অল ইন্ডিয়া রেডিও-র ন্যাশনাল অর্কেস্ট্রা কনডাক্টর হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। এই সময় কলিঙ্গ-বিজয়, ঋতুরাজ, জ্যোতির্ময় অমিতাভ ইত্যাদি বহু অর্কেস্ট্রা তৈরি করেছিলেন পান্নালাল ঘোষ। ‘আনজান’, ‘বসন্ত’, ‘নন্দকিশোর’, ‘বসন্ত বাহার’, ‘মুঘল-ই-আজম’ ইত্যাদি ছবিতে সুরারোপও করেছেন তিনি।

বাংলা চলচ্চিত্রের জগতে কমল দাশগুপ্ত, বীরেন দাস, অসিত বরণ, শচীনদেব বর্মণ, হিমাংশু দত্ত প্রমুখ বিখ্যাত সব সুরকারদের সুরে বাংলা গানে বাঁশিও বাজিয়েছিলেন তিনি। হিন্দুস্তান রেকর্ডিং কোম্পানিতে রত্নেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে বেতারে কীর্তন গানের প্রস্তাবেও রাজি হয়েছিলেন পান্নালাল ঘোষ। রেকর্ড ও বেতার দুই মাধ্যমেই সমানভাবে জনপ্রিয় হয়েছিলেন তিনি। কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে এইচএমভি এবং কলম্বিয়া স্টুডিও থেকে ডাক পেয়েছিলেন তিনি। সেই সময় প্রিয়নাথ গাঙ্গুলির পরিচালনায় ‘পাতালপুরী’ চলচ্চিত্রের জন্য গান লিখছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওর একজন স্বনামধন্য অর্কেস্ট্রাবাদক রাইচাঁদ বড়াল পান্নালাল ঘোষকে একজন বাঁশিবাদক হিসেবে পরিচিত হতে অনেক সহায়তা করেছিলেন। নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওতে সেই সময় ৪৫ টাকা মাসিক বেতনে কাজ করতেন তিনি। ১৯৩৪ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে এই স্টুডিও প্রায় সব ছবিতেই সঙ্গীতের ক্ষেত্রে পান্নালাল ঘোষের এক বিরাট অবদান ছিল। ১৯৪০-এর দশকে মুম্বাইতে চলে যান তিনি এবং ১৯৪০ সালেই জে পি আডবাণী পরিচালিত গ্রেট ইন্ডিয়া পিকচার্সের ‘স্নেহবন্ধন’ ছবিতে প্রথম এককভাবে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন পান্নালাল ঘোষ। এরপরে বম্বে টকিজের ‘আনজান’ ছবিতে অমিয় চক্রবর্তীর পরিচালনায় সঙ্গীত পরিবেশন করেন তিনি। ১৯৪১ সালে এই ছবিটি মুক্তি পায় এবং ছবির মধ্যেকার মেরে জীবন কি পথ পার কৌন, অ্যায় পশ্চিম কি ঘটা, প্যায়ারে প্যায়ারে সপ্‌নে হামারে ইত্যাদি গানে অশোককুমার আর দেবিকারানীর অনবদ্য অভিনয় বহুকাল পর্যন্ত দর্শকের মনে স্থায়িত্ব পেয়েছিল। এরপরে ১৯৪২ সালে বম্বে টকিজেরই বসন্ত ছবির গানগুলিও তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে যেখানে বাঁশি বাজিয়েছিলেন পান্নালাল ঘোষ। নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওতে রাইচাঁদ বড়ালের নির্দেশনায় অর্কেস্ট্রেশন শিল্পে পারদর্শী হয়েছিলেন তিনি।

কলকাতায় তাঁর উল্লেখযোগ্য ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন হরিপ্রদা চৌধুরী, আমিনুর রহমান, ফকিরচন্দ্র সামন্ত, পণ্ডিত মুকুল রায় এবং গৌর গোস্বামী। বম্বেতে ত্রিভুবন গোন্দকার, পণ্ডিত রাসবিহারী দেশাই, দেবেন্দ্র মুর্দেশ্বর, চন্দ্রকান্ত যোশী, নিত্যানন্দ হলদিপুর, সুরজ নারায়ণ প্রমুখ ছাত্ররা ছিলেন অন্যতম।

১৯৬০ সালের ২০ এপ্রিল ৪৮ বছর বয়সে দিল্লিতে থাকাকালীনই পান্নালাল ঘোষের মৃত্যু হয়।  

One comment

আপনার মতামত জানান